‘বৈষম্য সৃষ্টির জন্য পুরস্কার থাকলে বাংলাদেশ নোবেল পেত’
১১ মে ২০২৪ ২২:৫৪
ঢাকা: বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের এমপি বলেছেন, জাতি আজ চরম সংকটময় সময় পার করছে। দিন যতই যাচ্ছে সংকটের গভীরতা ততই বাড়ছে। আগে আমরা যেটাকে সংকট বলেছি, এখন মনে হচ্ছে সেটি কোনো সংকটই ছিলো না। দেশের বেশির ভাগ মানুষ আয় দিয়ে সংসার চালাতে পারছে না। জিনিসপত্রের দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। টাকার অবমূল্যায়নে ডলারের দাম বেড়ে গেছে, মূল্যস্ফীতি হচ্ছে। ডলার সংকটের কারণে সরকার আমদানি সংকোচন করেছে। জনগণের কথায় সে চলে না, তার কথায় জনগনকে চলতে বাধ্য করছে। একটা শক্তিশালী গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, তাদের রাজনৈতিক দল বলে মনে হয় না। বৈষম্য সৃষ্টির জন্য কোনো পুরস্কার থাকলে বাংলাদেশ নোবেল পুরস্কার পেত।
শনিবার (১১ মে) বনানীতে জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে ঢাকা মহানগর উত্তর এর মত বিনিময় সভায় জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের এ কথা বলেন।
জিএম কাদের বলেন, ‘কলকারখানা বন্ধ হয়ে মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টি হয়েছে। বেশির ভাগ মানুষ কাজ পাচ্ছে না, খেতে পাচ্ছে না। এমন বাস্তবতায় একটি শ্রেণি ইউরোপের স্টাইলে জীবন যাপন করছে। সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে বিশাল অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছে তারা। বিশ্ব সংস্থাগুলোর জরিপে দেশে ধনী ও দরিদ্রের বৈষম্য বাড়ছে। একটি শ্রেণি আধাপেট খেয়ে বেঁচে আছে। অনেকে অর্থের অভাবে চিকিৎসা করতে পারছে না। এই বৈষম্যের জন্য মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। আমাদের সব চেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা। দেশের মানুষ চেয়েছিল নিজেদের একটি দেশ হবে। প্রজাতন্ত্র মানে প্রজারাই দেশের মালিক। আমাদের দেশ আমরাই চালাবো। সবাই সমান অধিকার ভোগ করবে। বৈষম্যহীন ন্যায় বিচার ভিত্তিক সমাজ গড়ার মাধ্যমে জনগণের দেশ জনগণই চালাব।’
তিনি বলেন, ‘জনগণই সরকার গঠন করবে, জনগণের ইচ্ছেমত দেশ চলবে। ভাইয়ে ভাইয়ে বৈষম্য থেকে আমরা মুক্তি পাবো। স্বাধীনতার সেই অর্জন নেই, দেশের ওপর সাধারণ মানুষের মালিকানা ছিনতাই হয়ে গেছে। এখন জনগণের কথা বলার অধিকার নেই, কথা বলতে গেলেই নানান ধরনের সমস্যা। জনগণের কথা শোনারও যেন দরকার নেই। বর্তমান সরকার শক্তি-সামর্থ দিয়ে এই দেশটাকে দখল করে ফেলেছে। এখন জনগণের কথার কোন দাম নেই, এখন তাদের কথায় জনগনকে চলতে হচ্ছে। বর্তমান সরকার সিন্দাবাদের দৈত্য হয়ে জনগণের কাঁধে চেপে বসেছে।’
বিরোধী দলের নেতা বলেন, ‘স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য বহুবার দেশের মানুষ জীবন দিয়েছেন। পাকিস্তানিদের শোষণ ও বৈষম্য থেকে মুক্তি পেতেই আমরা একটি দেশ চেয়েছিলাম। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে, আর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিলো হাজার বছর আগে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করা মানে, আমরা রাষ্ট্রীয় কোন কাজে অংশ নিতে পারবো না। আমাদের শোষণ ও বঞ্চিতহ করার চেষ্টা করেছে পাকিস্তানীরা। তার প্রতিবাদেই আমাদের মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন।’
জিএম কাদের বলেন, ‘শহীদ মিনারে ব্যানার লাগানো উচিত ছিল বৈষম্য নিপাত যাক, বৈষম্য সৃষ্টিকারীরা নিপাত যাক। বাংলাদেশের ইতিহাসে বর্তমান সময়ের মত এত বৈষম্য আর হয়নি। যারা সরকারি দল করে তারা সব ধরনের নিয়ম নীতির বাইরে। সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে তারা। চাকরি, ব্যাবসা থেকে শুরু করে সব কিছুতেই প্রথম প্রশ্ন আপনি সরকারি দলের সদস্য কিনা। দ্বিতীয় প্রশ্ন আপনার পরিবারের কেউ সরকারি দলের বাইরে অন্যকোন দল করে কিনা। যে রাষ্ট্রের জন্য মানুষ জীবন দিলো সেই রাষ্ট্র আজ চলে গেছে একটি গোষ্ঠির হাতে। যারা আওয়ামী লীগের বাইরে তারা অবাঞ্ছিত। অবস্থা এমন যেনো.. থাকলে দাশ হিসেবে থাকেন, না থাকলে যান। কথা বলার অধিকার নেই কারো।’
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের আরো বলেন, ‘রাজনীতিতে গুণগত একটি পরিবর্তন এসেছে। একটি শ্রেণি কিছু সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। তারা ভাবছে, সরকার তো জেকে বসেছে, থাকবেই। তাদের সঙ্গে লাইন দিয়ে যেটুকু পাওয়া যায়। আবার সরকার যাদের নিচ্ছে না, তাদের বাধ্য হয়ে সরকারের বিপক্ষে থাকতে হচ্ছে। তারা না চাইলেও জনগণের পক্ষে দাঁড়াতে হচ্ছে। আমাদের কিছু জায়গা দিয়েছে এটিই হচ্ছে, সর্বনাশ। এভাবে চলতে থাকলে সামনের দিকে দেশে আর রাজনীতি থাকবে না, বিরাজনীতিকরণ চলছে। জনগনকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আজকাল নির্বাচনে লোকজন যায় না, তাদের বক্তব্য আমরা গেলেই কী আর না গেলেই কী। একদলীয় শাসন ব্যবস্থা সিন্দাবাদের দৈত্য হয়ে মানুষের কাঁধে বসে আছে। সামনের দিকে রাজনীতি আরো কঠিন হবে। সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা মানুষের পাশে থাকবো নাকি সুযোগ-সুবিধার পক্ষে থাকবো। জনগণের পক্ষে থাকতে হলে ত্যাগ স্বীকারের মানষিকতা থাকতে হবে। যারা সুযোগ-সুবিধার লোভে পড়েছে, এটা স্বল্প সময়ের জন্য। সামনের দিকে হয়তো তাদের প্রয়োজনীয়তা থাকবে না। যারা সরকারের দালালী করেছে, তাদের কিন্তু লাথি দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে।’
গোলাম মোহাম্মদ কাদের আরো বলেন, ‘বিদ্যুতের চাহিদা ১৩ থেকে ১৬ হাজার মেগাওয়াট। হঠাৎ করে গত বছর ১৭ হাজার হয়ে গিয়েছিলো। তখন ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া ১০ হাজার মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ প্লান্ট বসিয়ে রাখা হয়েছিল। ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নেওয়া হয়নি। অথচ ২৭ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়েছে। ব্যবহার করতে পারছেন না, তাহলে বানালেন কেন? প্রয়োজনের চেয়ে কিছু বেশি বানাতে পারেন। তারপরও তো লোডশেডিং আছে। ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ। বসিয়ে বসিয়ে পয়সা দেওয়া হচ্ছে, মানুষ কষ্ট পাচ্ছে, কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আরো উৎপাদন কেন্দ্র বানানো হচ্ছে, সেগুলোতেও বসিয়ে বসিয়ে পয়সা দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘ঋণের ২০ ভাগ নেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ খাতে। অথচ বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। লোকসান কমানোর জন্য বছরে ৩ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। ৩ টাকা থেকে বছরে ৮ টাকা হয়েছে ইউনিট। সামনে আরও তিনগুণ বেড়ে যেতে পারে। এই টাকা দেওয়া হচ্ছে বসিয়ে রাখা বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে। এমন কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যারা কোনো দিনই বিদ্যুৎ উৎপাদন করে নাই। আমরা জানি, ক্যাপাসিটি চার্জ ছাড়া চুক্তি হয়। ব্যবসায়ীরা ঠিক করবে কেমনে তারা ব্যবসা করবে। এই সেক্টরে ব্যবসায়ী আনা হয়নি, কিছু সুবিধাভোগী লোক আনা হয়েছে। কোনো ব্যবসা ছাড়াই তাদের হাজার হাজার কোটি টাকা দেওয়া হচ্ছে। সামনে বিদ্যুতের দাম বাড়বে, মালামালের দাম বাড়বে, জনগণের কষ্ট আরও বাড়বে।’
তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা আছে। বিদ্যুৎ খাতে আমাদের দরকার ২ হাজার ১৩৪ মিলিয়ন ঘনফুট, সেখানে আমরা দিচ্ছি ১ হাজার ৬৮১ দিচ্ছি মিলিয়ন ঘনফুট । শিল্পখাতে ৯৩১ মিলিয়ন ঘনফুট দরকার সেখানে দেওয়া হচ্ছে ৭৩৩ মিলিয়ন ঘনফুট। ৩ হাজার ৮ শো মিলিয়ন ঘনফুট যেখানে দরকার সেখানে ৮শো মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি দিতে পারছি না। যেটুকু দিতে পারছি তার ৩ ভাগের ২ ভাগ দেশ থেকে দেওয়া হচ্ছে। আর ১ ভাগ বিদেশ থেকে এলএনজির মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের গ্যাস ১ থেকে ৩ ডলারে পাওয়া যায় কিন্তু বিদেশ থেকে কিনতে ৩০ থেকে ৪০ ডলার খরচ করতে হয়।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে এখনো যথেষ্ট পরিমানে গ্যাস মজুদ আছে। রিপোর্ট অনুযায়ী এখনো দেশে ৩৮ ট্রিলিয়ান কিউবিক ফিট গ্যাস মজুদ আছে। আমরা গ্যাস উত্তোলন না করে পারসেজের দিকে গিয়েছি। আমরা যে গ্যাস দিচ্ছি তার একটি বড় অংশ পাচ্ছি বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ড থেকে। গেলো নভেম্বরে বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ডের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল, আল্লাহর রহমতে আমরা বোনাস পাচ্ছি। এটি যে কোনো সময়ে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাহলে, যে পরিমাণ গ্যাস আমরা আমদানি করছি, আরো সেই পরিমান গ্যাস আমদানি করতে হতে পারে। এই জ্বালানি না দিলে বিদ্যুৎসহ সব কিছু বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা একটা বড় ঝুঁকির মধ্যে পড়েছি। কারণ, সরকার সময় মতো এক্সপ্লোরেশন করেনি। আমাদের দেশি কোম্পানীগুলো বলেছে আমরা যতটা অনুসন্ধান করেছি তার অর্ধেকেই গ্যাস পেয়েছি। বিদেশিরা আমাদের তুলনায় কম গ্যাস পেয়েছে। ৮ থেকে ১০ বছর আগে যদি আমাদের প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলনের উদ্যোগ নেওয়া হতো তাহলে আমাদের এমন বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না।’
জি এম কাদের আরও বলেন, ‘দেশ বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে আছে। যদি হঠাৎ করে বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ড বন্ধ হয়ে যায় তাহলে ওই পরিমাণ গ্যাস ইমপোর্ট করতে ২ বিলিয়ন ডলার লাগবে বর্তমান বাজার অনুযায়ী। শুধু টাকা নয় আনলোড, ট্রান্সমিশন এর সুবিধাও নেই। দূরদর্শিতার অভাবে এই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। শুধু পারসেজের দিকে নজর দেওয়ার কারণে কিছু লোকের বিপুল পরিমাণ মুনাফা হয়েছে। অন্যায্যভাবে জনগণের সম্পদ চলে যাচ্ছে। দেশ বাঁচাতে হলে এগুলো দেখতে হবে।’
সারাবাংলা/এএইচএইচ/একে