ঝরে পড়া শিশুদের শিক্ষা: দিশা’র দুর্নীতি অনুসন্ধানে দুদক
১২ মে ২০২৪ ০৮:১২
যশোর: উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো’র আওতায় যশোরে সেকেন্ড চান্স এডুকেশন কর্মসূচি বাস্তবায়নে বেসরকারি সংস্থা যশোরের ‘দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা’র কোটি কোটি টাকার হরিলুট ও দুর্নীতির অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটি এরই মধ্যে দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে সম্পর্কিত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ এবং অভিযোগকারীদের বক্তব্য নিয়েছে। পাশাপাশি ‘দিশা’র ব্যাংক হিসাব স্থগিতও করা হয়েছে।
এদিকে এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ না করতে দিশার পক্ষ থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যম অফিসে নামে-বেনামে ফোন কল ও ব্যক্তিগত যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে বলে একাধিক গণমাধ্যম কর্মী জানিয়েছেন। সেইসঙ্গে সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য প্রলোভনও দেখানো হচ্ছে বলে দাবি একটি সূত্রের।
অভিযোগকারীদের দাবি, যশোরে সেকেন্ড চান্স এডুকেশন কর্মসূচি বাস্তবায়নকারী সংস্থা ‘দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা’ ৭৩ কোটি টাকার এই প্রকল্পে অন্তত কয়েক কোটি টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছে। ঝরে পড়া শিশুদের জন্য এ প্রকল্পের স্কুলগুলোর বাড়ি মালিকদের সিংহভাগই ভাড়া পাননি, বেতন বকেয়া রয়েছে শিক্ষক-সুপারভাইজারদের। শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয়েছে নিম্নমানের পোশাক ও ব্যাগ। নিয়োগ দেওয়া হয়নি পরিচ্ছন্নতা কর্মী, সরবরাহ করা হয়নি উপকরণ।
এ ছাড়া ব্যাংকের মাধ্যমে এসব অর্থ পরিশোধের কথা থাকলেও তা করা হয়নি। বরং প্রকল্পের যাবতীয় বিল-ভাউচার তৈরি করে টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। এমনকি প্রকল্পের আয়-ব্যয়ের যে ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেওয়া হয়েছে, সেটিও নিজেদের তৈরি করা। এসব বিষয় তুলে ধরে দুদক চেয়ারম্যান বরাবর অভিযোগ করেছেন শিক্ষক-কর্মকর্তারা। সেই অভিযোগ আমলে নিয়ে প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশে অভিযোগের অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশের ঝরে পড়া শিশু-কিশোরদের শিক্ষার আওতায় আনতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদফতর উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো’র আওতায় ২০২০ সালে সেকেন্ড চান্স এডুকেশন (সাব-কম্পোনেন্ট ২.৫’ আউট অব স্কুল চিল্ড্রেন-ওওএসসি প্রোগ্রাম, পিইডিপি-৪) কর্মসূচি গ্রহণ করে। কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রতিটি জেলা থেকে একটি লিড এনজিও নির্বাচন করা হয়। যশোরে লিড এনজিও হিসেবে ‘দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা’ ছয়টি উপজেলা ও যশোর পৌরসভায় (দুটি এরিয়ায় বিভক্ত করে ১ ও ২) প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায়। কিন্তু ২০২২ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরুতেই দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা’র বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে।
অভিযোগকারীদের দাবি, কার্যক্রম শুরুর আগেই ঝরে পড়া শিশুর তথ্য সংগ্রহে জরিপকারীদের ৮০ শতাংশ টাকা পরিশোধ করা হয়নি। ২০২৩ সালের ৩০ জুন প্রকল্প শেষ হলেও শিক্ষক ও সুপারভাইজারদের বেতন পরিশোধ করা হয়নি। ঝরে পড়া শিশুদের স্কুলের জন্য ভাড়া নেওয়া ঘরের ভাড়া পাননি সিংহভাগ বাড়ি মালিক।
সূত্র জানায়, যশোর পৌরসভাসহ ছয়টি উপজেলার ৪৮১টি স্কুলকেন্দ্রের (শিখন কেন্দ্র) সিংহভাগেরই ভাড়া বকেয়া রয়েছে। এই খাতে বকেয়ার পরিমাণ দুই কোটি ১৬ লাখ টাকা। শিক্ষকদের প্রতিমাসে পাঁচ হাজার টাকা বেতন দেওয়ার কথা থাকলেও তারা নিয়মিত সেই টাকা পাননি। অধিকাংশেরই অধের্কের বেশি বেতন বকেয়া। এমনকি পাঁচ হাজার টাকার সোশ্যাল বেনিফিটের একটি দিয়ে আরেকটি হজম করে ফেলার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। সোশ্যাল বেনিফিটের এই একটি খাতেই ২৪ লাখ টাকার অনিয়ম হয়েছে দাবি ভুক্তভোগীদের।
এ ছাড়া, প্রতিটি শিখন কেন্দ্রে পরিচ্ছন্নতা কর্মী নিয়োগ ও উপকরণ সরবরাহ করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। পরিচ্ছন্নতা কর্মীর খাতে দুই বছরে ১২ হাজার টাকা হিসেবে ৪৮১টি শিখন কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে ৫৭ লাখ ৭২ হাজার টাকা। এই সব টাকাই ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরি করে এনজিও কর্তৃপক্ষ তুলে নিয়েছেন বলে অভিযোগকারীদের দাবি।
বাঘারপাড়ার জহুরপুর ইউনিয়নের নরসিংহপুর গ্রামের কেন্দ্রের শিক্ষক জেসমিন নাহার সারাবাংলাকে জানান, তিনি স্কুলের ছাত্র সংগ্রহ থেকে শুরু করে দুবছর শ্রম দিয়েছেন। বেতন পেয়েছেন মাত্র এক মাসের। স্কুলের ভাড়ার জন্য চাপ দেওয়ায় তাকে বাদ নিয়ে নতুন শিক্ষক নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি বকেয়া বেতন পাননি।
দুদকে অভিযোগকারীদের একজন বাঘারপাড়া উপজেলার প্রোগ্রাম সুপারভাইজার আব্দুর রহিম। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘শিক্ষকদের অনেক মাসের বেতন বাকি, শিখন কেন্দ্রের ভাড়া বাকি। কেন্দ্রের ভাড়া ৫০০ টাকা ধরিয়ে দিয়ে মালিকদের শিখিয়ে দেওয়া হচ্ছে তদন্তে গেলে ১২০০ টাকা ভাড়া পান বলে জানাতে। এটা জানালে পরে ওই টাকা ভাড়া দেওয়া হবে।’
তিনি জানান, শিক্ষকদের সোশ্যাল বেনিফিটের টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। কোনো কেন্দ্রেই পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়নি। তিনি নিজেও ১১ মাসের বেতন পাবেন। অথচ এসব টাকা প্রকল্প থেকে তুলে নিয়েছেন দিশার কর্মকর্তারা। ৭৩ কোটি টাকার প্রকল্পে অন্তত ৩০ কোটি টাকার অনিয়ম হয়েছে। দুদকে অভিযোগ করার পর কর্মকর্তারা তার কাছে এসে আপসের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তিনি মাথা নত করেননি। তিনি এই দুর্নীতিবাজদের শাস্তি চান।
এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রধান কার্যালয়ে অভিযোগের পর দুদক সমন্বিত যশোর জেলা কার্যালয় এসব অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করেছে। সংস্থার কার্যক্রমের নথিপত্র-তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করছে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদের সাক্ষাৎকারও নিয়েছে। এ ছাড়া দিশা’র ব্যাংক হিসাবও সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে। ব্যাংকের নথিপত্রও পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
যশোর উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো’র সহকারী পরিচালক হিরামন কুমার বিশ্বাস সারাবাংলাকে বলেন, ‘দিশা’র বিরুদ্ধে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুদক তদন্ত করছে। দুদক আমার কাছে যেসব কাগজপত্র চেয়েছিল, আমি সেসব সরবরাহ করেছি।’
এদিকে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থার নির্বাহী পরিচালক রাহিমা সুলতানা বলেন, ‘অনিয়ম-দুর্নীতির সব অভিযোগ মিথ্যা। তবে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুদক তদন্ত করছে।’ ব্যাংক হিসাব স্থগিত করার কথা স্বীকার করলেও তার দাবি, আবেদন করে হিসাব চালুর পর শিক্ষকদের বেতন দিয়েছেন।
দুদক যশোর সমন্বিত কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. আল-আমিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো’র আওতায় যশোরে সেকেন্ড চান্স এডুকেশন কর্মসূচি বাস্তবায়নে এনজিও দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অনুসন্ধান চলছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত তদন্ত কর্মকর্তা প্রকল্পের কাগজপত্র পর্যালোচনা, সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য ও তথ্য-উপাত্ত অনুসন্ধান করে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দেবেন। এরপর আইন অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এদিকে শনিবার বিকেল থেকে যশোরসহ জাতীয় গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত একাধিক সাংবাদিককে ‘দিশা’র পক্ষ থেকে বিভিন্নভাবে ফোন করে সংবাদ না প্রকাশ করার জন্যে অনুরোধ করা হয়েছে। কাউকে কাউকে অন্যদের দিয়েও ‘ম্যানেজ করা’র চেষ্টা করা হয় বলেও খবর পাওয়া গেছে। তাছাড়া ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও ভিন্নভাবেও অনুরোধ করা হচ্ছে যাতে সংবাদ প্রকাশ না করেন সাংবাদিকরা।
তবে এসব অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে যশোর প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন স্থানে একাধিকবার সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন ভুক্তভোগীরা। তাছাড়া গত দুই বছর বিভিন্ন সময় স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিকসহ টেলিভিশনেও বিভিন্ন সংবাদ প্রচার ও প্রকাশ হয়েছে।
সারাবাংলা/পিটিএম
অনুসন্ধান উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা দুদক দুর্নীতি সেকেন্ড চান্স এডুকেশন