মার্কিন গাড়ি নির্মাতারা চীনে বাজার হারিয়েছে যেভাবে
১২ মে ২০২৪ ২২:৪৪
চীনের বাজারে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে মার্কিন গাড়ি নির্মাতা কোম্পানিগুলো। স্থানীয় চীনা গাড়ি নির্মাতারা বাজার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিদেশিদের ছাড়িয়ে গেছে। সরকারি বিনিয়োগ এবং ভর্তুকি নিয়ে চীনা কোম্পানিগুলো বৈদ্যুতিক যানবাহন প্রযুক্তি এবং সফটওয়্যার প্রতিযোগিতায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে। চীনের বাজারে মার্কিন গাড়ি বিক্রি নাটকীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে। কয়েক বছর আগেও চীনের বাজার ছিল মার্কিনিদের দখলে।
২০০৯ থেকে ২০২২ পর্যন্ত চীনের বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা কোম্পানিগুলোকে কর ছাড় ও ভর্তুকি মিলিয়ে ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা দিয়েছে সরকার। ২০১৮ থেকে ২০২২ পর্যন্ত চীনের গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি বিওয়াইডি সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি সহায়তা পেয়েছে ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
চীনের আইন অনুযায়ী, বিদেশি কোম্পানিকে চীনের কোনো কোম্পানির সঙ্গে মিলে ব্যবসা পরিচালনা করতে হয়। এই সুযোগে চীনা গাড়ি নির্মাতারা বিদেশি গাড়ি প্রস্তুতকারকদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখে নেয়, যা তাদের এই অঞ্চলে কাজ করার জন্য আরও বেশি দক্ষ করে তুলেছে। ফলে সফল চীনা কোম্পানিগুলো ব্রিটিশ ব্র্যান্ড এমজি, লোটাস এবং সুইডেনের ভলভোসহ বিদেশি ব্র্যান্ডের চীনা শেয়ার কিনে নিয়েছে। এতে চীনভিত্তিক কোম্পানিতে বাইরের বিনিয়োগও প্রবেশ করেছে। যেমন চীনের বিওয়াইডিতে ওয়ারেন বাফেটের বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের বিনিয়োগ রয়েছে।
গত ৩০ বছর ধরে চীন ও পার্শ্ববর্তী বাজারগুলো নিয়ে গবেষণা করে আসছে ডান ইনসাইটস নামক একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা মাইকেল ডান বলেন, ‘আমি নাটকীয় কিছু শোনাতে চাই না। আমি কেবল বাস্তববাদী হতে চাই। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে, ফোর্ড, জেনারেল মোটরস (জিএম), হুন্দাই, কিয়া, নিশান চীনে টিকতে পারবে না। তারা এখন আর চীনাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারছে না।’
চীনে অটোমোবাইল শিল্পের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮০ দশকের শুরুর দিকে। সে সময় চীনের দুটি কোম্পানি দুই বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে অংশীদারিত্বে ব্যবসা শুরু করে। চীনের এসএআইসির সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চার চালু করে জার্মান কোম্পানি ভক্সওয়াগন। আর বিএআইসি যুক্ত হয় মার্কিন কোম্পানি আমেরিকান মোটরসের সঙ্গে। ১৯৮৩ সালে ভক্সওয়াগন সেন্টেনা তৈরি হয় চীনের সাংহাইয়ের কারখানায়। ওই বছর এই গাড়িটি চীনের বাজারে বিক্রি হয় ১৭০০ ইউনিট। বাজারে আধিপত্য শুরু করে ভক্সওয়াগন সেন্টেনা। সেসময় মূলত সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এসব গাড়ি কিনত।
১৯৯৪ সালে চীনের অটো পলিসির কারণে বিদেশি কোম্পানিগুলো আরও বেশি বিনিয়োগের সুযোগ পায়। আইন অনুযায়ী, কোনো বিদেশি কোম্পানিকে চীনে অটোমোবাইল ব্যবসা করতে হলে ৫০ শতাংশ শেয়ার দিয়ে কোনো চীনা প্রতিষ্ঠানকে অংশীদার করে নিতে হবে। তবে কোনো একটি ধরনের গাড়ির জন্য দুটির বেশি চীনা জয়েন্ট ভেঞ্চার রাখা যাবে না।
তৎকালীন বিশ্বের সর্ববৃহৎ গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল মোটরস ১৯৯৭ সালে চীনের বাজারে প্রবেশ করে। তারা চীনের সাংহাই অটোমেটিভ ইন্ডাস্ট্রি কর্পোরেশনের (এসএআইসি) সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চারে গাড়ি নির্মাণ শুরু করে।
চীনের অর্থনীতি যত উদার হতে থাকে ততই গাড়ির বাজার বাড়তে থাকে। ২০০০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত চীনে গাড়ি বিক্রি বেড়ে যায় ১০ গুন পর্যন্ত। ২০০০ সালে চীনে গাড়ি বিক্রি হয়েছিল ১০ লাখ ইউনিট। ২০০৯ সালে বিক্রি বেড়ে দাঁড়ায় এক কোটি ইউনিট।
২০০৯ সালে চীন হয়ে উঠে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গাড়ির বাজার। জেনারেল মোটরস তার চীনা জয়েন্ট ভেঞ্চারসহ ২০১৭ সালে চীনে সর্বোচ্চ ৪০ মিলিয়ন গাড়ি বিক্রি করে। ২০১৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত জেনারেল মোটরস প্রতি বছর দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি আয় করে চীনের বাজার থেকে। কিন্তু ২০১৭ সাল থেকে চীনের বাজারে জেনারেল মোটরসের পতন শুরু হয়। ২০২৩ সালে চীনের বাজারে জেনারেল মোটরসের গাড়ি বিক্রি নেমে আসে ২১ লাখে। ২০০৯ সালের পর এই প্রথম চীনের বাজারে এত কম গাড়ি বিক্রি হয় জেনারেল মোটরসের। অন্যান্য বিদেশি কোম্পানিও চীনে বাজার হারাতে থাকে। স্টেলেন্টিস জিপের চীনা জয়েন্ট ভেঞ্চার ২০২২ সালে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে। চীনের কোম্পানিগুলোর উত্থানে পড়তে থাকে বিদেশিদের বাজার। কারণ, ততদিনে চীনা গাড়ি নির্মাতারা এই শিল্পে দক্ষতা অর্জন করে নেয়।
চীনা কোম্পানিগুলো প্রথম দিকে রফতানি শুরুর পরপরই সাফল্য পায়নি। শুরুর দিকে চীনা কোম্পানির তৈরি গাড়ি মানসম্পন্ন ছিল না। ইউরোপে বহু চীনা গাড়ির দুর্ঘটনা নিয়ে খবর প্রকাশ হয়। দুর্ঘটনার কবলে পড়ে দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া চীনা গাড়ির ছবিতে ইন্টারনেট সয়লাব হয়ে পড়ে। ৫-১০ বছর পর অবশ্য ছবি পাল্টাতে শুরু করে। চীনের তৈরি গাড়ি মানের দিক থেকে বিদেশি কোম্পানিগুলোকে চ্যালেঞ্জ জানায়।
এর মধ্যে চীনের কোম্পানিগুলো বিদেশি কোম্পানির শেয়ার কেনা শুরু করে। ২০০৫ সালে প্রথমবার ব্রিটিশ কোম্পানি এমজির চীনা শেয়ার কিনে নেয় নানজিং অটোমোবাইল গ্রুপ (এনএসি)। ২০০৭ সাল থেকে তারা চীনে গাড়ি তৈরি শুরু করে। ২০১০ সালে চীনের কোম্পানি জিলি কিনে নেয় মার্কিন কোম্পানি ফোর্ড ও সুইডেনের ভলভোর চীনা ব্যবসা। ২০১৭ সালে জিলি কিনে নেয় ব্রিটিশ স্পোর্টসকার নির্মাতা লোটাসের ব্যবসা। এর মধ্যে আরও কয়েকটি চীনা কোম্পানি বিদেশি গাড়ি নির্মাতাদের চীনের ব্যবসা কিনে নিয়ে নিজেই গাড়ি উৎপাদন শুরু করে।
দুই প্রতিদ্বন্দ্বি যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান গাড়ি শিল্পে আগে থেকেই অনেক এগিয়ে। ফলে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রবেশ করতে হলে চীনের প্রয়োজন হয় বিশাল বিনিয়োগ ও কোম্পানিগুলোর জন্য অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা। ২০০৮ সালে বিশ্বমন্দার সময় চীন পরিবহণ খাতে ৫৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে। এছাড়া দেশব্যাপী হাইস্পিড রেলপথ, বিমানবন্দর, মহাসড়ক ও বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন খাতে চীন বিনিয়োগ করে আরও ২৬৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর পরের বছর চীন ছোট ব্যক্তিগত গাড়িতে কর ছাড় দেয়। অভ্যন্তরীণ গাড়ি উৎপাদন ও বিক্রি বাড়াতে এই নীতি গ্রহণ করে বেইজিং। এসব বিনিয়োগে চীনের গাড়ি শিল্প রমরমা হয়ে উঠে।
গত এক দশকে চীনা বাজার নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। চীনে গাড়িকে চলন্ত কম্পিউটার বা স্মার্টফোনের মতো ব্যবহার এখন নতুন বাস্তবতা। সম্প্রতি গাড়ি উৎপাদন ব্যবসায় যোগ দিয়েছে সেলফোন নির্মাতা শাওমি ও হাওয়াইয়ের মতো টেক কোম্পানি। চীন ইলেকট্রিক গাড়ির জন্য ব্যাটারি তৈরিতে এগিয়ে। চীনের রয়েছে স্বল্প খরচে বিশাল শ্রম বাজার। ফলে চীনের কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা মার্কিনিদের জন্য অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
ঠিক এ কারণেই মার্কিন গাড়ি নির্মাতা কোম্পানিগুলোকে এখনই চীনে রণভঙ্গ দেওয়া উচিত নয় বলে মনে করেন গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ক্রিসলারয়ের প্রাক্তন নির্বাহী পরামর্শক বিল রুসো। তিনি বলেন, ‘এই কারণেই মার্কিন গাড়ি নির্মাতাদের চীনে বিক্রয় বিপত্তি সত্ত্বেও ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। গত কয়েক বছরে এই পরিবর্তনগুলো চীনে টেকসই হবে। আপনি যদি চীনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করেন, তাহলে চীন যখন আপনার বাড়ির উঠোনে চলে আসবে তখন কী করবেন?’
সারাবাংলা/আইই