Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শহিদ মিনারে কমরেড রনোকে শেষ বিদায়, সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১৩ মে ২০২৪ ১৩:৩৯

শহিদ মিনারে কমরেড রনোকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। ছবি: আজমল হক হেলাল

ঢাকা: মার্কসবাদী তাত্ত্বিক বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা কমরেড হায়দার আকবর খান রনোকে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে শেষ বিদায় জানিয়েছে তার দল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বামধারার রাজনৈতিক দলগুলো এবং সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সর্বস্তরের জনগণ।

সোমবার (১৩ মে) সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে রনোর মরদেহ পুরনো পল্টনে সিপিবির কেন্দ্রীয় কার্যালয় ‘মুক্তি ভবনে’ নেওয়া হয়। এই প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ গত শুক্রবার (১০ মে) রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।

বিজ্ঞাপন

তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সকাল সাতটা থেকে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি বন্ধুপ্রতীম সংগঠনগুলোর সভাপতি-সেক্রেটারিসহ পার্টির নেতাকর্মীরা পুরানা পল্টনের কমিউনিস্ট পার্টি অফিসে সামনে জড়ো হন।

কমিউনিস্ট পার্টি অফিসের সামনে শ্রদ্ধা নিবেদনের শুরুতে আন্তর্জাতিক সংগীত পরিবেশন ও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান পার্টির সভাপতি মো. শাহ আলম, সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমসহ কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা।

অ্যাম্বুলেন্স থেকে তার মরদেহ বহন করে মুক্তিভবনে কালো কাপড়ে আচ্ছাদিত নির্ধারিত স্থানে রাখেন পার্টির শীর্ষ নেতারা। তারপর কফিন ঢেকে দেওয়া হয় সিপিবি’র পতাকা দিয়ে। পুষ্পমাল্য দিয়ে চলে শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব।

দলের সভাপতি মো. শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান, সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, নারী নেত্রী মাহফুজা খানমসহ পার্টির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে তাদের দীর্ঘদিনের ‘কমরেড’কে শেষ বিদায় জানান।

বিজ্ঞাপন

এরপরে কালো পতাকা ও লাল পতাকা নিয়ে একটি র‌্যালিসহকারে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে হায়দার আকবর খান রনোর মরদেহ নেওয়া হয়। সেখানে সর্বস্তরের জনগণ তাকে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। বাদ জোহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে তার দাফন করা হবে।


প্রয়াত নেতার স্মরণে দলীয় কার্যালয়ে সিপিবির পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়, তোলা হয় শোকের কালো পতাকা। নেতা-কর্মীদের বুকেও ছিলো কালো ব্যাজ।

সিপিবির সভাপতি শাহ আলম বলেন, ‘একে একে ষাটের দশকের প্রজন্ম চলে যাচ্ছেন। যে দশকটি ছিল বাংলাদেশের জন্য ঐতিহাসিক দশক, এই প্রজন্মের ওপর ভর করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। সেই দশকের প্রজন্ম চলে যাচ্ছেন, কিন্তু এদেশের স্বপ্ন পূর্ণ হচ্ছে না, এটাই হল জাতির জন্য বিপদজনক অবস্থা। হায়দার আকবর খান যেটা দিয়ে গেছেন। যে আদর্শ ধারণ করেছেন, সেই আদর্শ অবিনাশী। তার আদর্শের পথ, সেটাই হল মানবমুক্তির পথ। এটাই আমরা বিশ্বাস করি। এই পতাকা আমরা এগিয়ে নিয়ে যাব।’

তিনি আরও বলেন, ‘আজ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মার্কিন তরুণ সমাজ ক্ষেপে উঠেছে। মার্কিন সাম্রজ্যবাদের বিদায় হবে। একদিন অবশ্যই সমাজতন্ত্রের জয় হবে। তাই হায়দার আকবর খান রনো যে লড়াই করেছেন, সে লড়াই আমরা এগিয়ে নিয়ে যাব।’

হায়দার আকবর খান রনোর মেয়ে জামাই মনিরুজ্জামান রাজু বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সকল নেতা-কর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘আমরা গর্বিত। কমরেড হায়দার আকবর খান রনো দেশ ও জাতির মুক্তির জন্য লড়াই করে গেছেন। তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি অবিচল।’

শ্রদ্ধা নিবেদনের পরে নেতা-কর্মীরা কফিন নিয়ে পুরানা পল্টন সিপিবি অফিসের সামনে থেকে র‌্যালিসহকারে যান কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে। সেখানে প্রথমে গার্ড অব অর্নার জানানো হয়। এরপরে কমিউনিস্ট পার্টি, আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বামধারার সব রাজনৈতিক দল ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। বেলা ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত হায়দার আকবর খান রনোর কফিন কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে রাখা হয়।

সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে তার জানাজা হয়। সেখান থেকে বনানীতে মায়ের কবরের পাশে তাকে দাফন করা হবে বলে জানান হায়দার আকবর খান রনোর মেয়ে রানা সুলতানা।

হায়দার আকবর খান রনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র থাকাকালীন গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জড়িত হন। ১৯৬২ সালের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে তার সক্রিয় রাজনীতি শুরু। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সর্ববৃহৎ ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ১৯৬৯ সালে তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনের শীর্ষস্থানীয় নেতা হিসেবে উঠে আসেন। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক। ১৯৬৯ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।


১৯৭০ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের রণাঙ্গনের সৈনিক এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও নেতা ছিলেন তিনি। হায়দার আকবর খান রনো ১৯৮২-১৯৯০ এর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন ও ১৯৯০ এর গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক ও নেতা ছিলেন। রাজনৈতিক কারণে তাকে ৪ বার কারারুদ্ধ হতে হয়েছিল এবং সাতবার আত্মগোপনে যেতে হয়েছিল।

তিনি দীর্ঘদিন ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য ছিলেন। ২০১০ সালে মতভিন্নতার কারণে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ছেড়ে হায়দার আকবর খান সিপিবিতে যোগ দেন। ২০১২ সালে তাকে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য করা হয়। এরপর তিনি সিপিবির উপদেষ্টা হন।

২০২২ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। তার ২৫টি বই প্রকাশ হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে- ‘শতাব্দী পেরিয়ে’, ‘ফরাসী বিপ্লব থেকে অক্টোবর বিপ্লব’, ‘পুঁজিবাদের মৃত্যুঘণ্টা’, ‘সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের সত্তর বছর’, ‘মার্কসবাদের প্রথম পাঠ’, ‘মার্কসীয় অর্থনীতি’, ‘গ্রাম শহরের গরীব মানুষ জোট বাঁধো’, ‘মার্কসবাদ ও সশস্ত্র সংগ্রাম’, ‘কোয়ান্টাম জগৎ- কিছু বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক প্রশ্ন’, ‘রবীন্দ্রনাথ শ্রেণি দৃষ্টিকোণ থেকে’, ‘মানুষের কবি রবীন্দ্রনাথ’, ‘বাংলা সাহিত্যে প্রগতির ধারা’, ‘পলাশী থেকে মুক্তিযুদ্ধ’, ‘স্তালিন প্রসঙ্গে’, ‘অক্টোবর বিপ্লবের তাৎপর্য ও বর্তমান প্রেক্ষাপট’।

আরও পড়ুন: সিপিবি কার্যালয়ে রনোর মরদেহ, শ্রদ্ধা শেষে নেওয়া হবে শহিদ মিনারে

সারাবাংলা/এএইচএইচ/এমও

কমরেড রনো মানুষের শ্রদ্ধা শহিদ মিনার

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর