ডোনাল্ড লু ঢাকা আসছেন আজ, কেন আলোচনায় এ সফর
১৪ মে ২০২৪ ০৮:৩০
ঢাকা: যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ঢাকা আসছেন আজ মঙ্গলবার (১৪ মে)। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে একবার ঢাকা এসেছিলেন লু। তার সেই ঢাকা সফর নির্বাচনি ডামাডোলে যথেষ্টই গুরুত্ব পেয়েছিল। এবারও এরই মধ্যে তার এই ঢাকা সফর যথেষ্ট আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সরকারি ও বিরোধী দলীয় নেতাদের মধ্যে এ নিয়ে বাক্য বিনিময়ও হয়েছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে এই প্রথম ঢাকা সফরে আসছেন লু। এর আগে তিনি গত বছরের জানুয়ারিতে ঢাকা এসেছিলেন। বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ওই সময় যথেষ্ট উচ্চকিত ছিল। দেশটির সেই কূটনৈতিক তৎপরতার অংশ হিসেবেই মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের এই কর্মকর্তার গত বছরের জানুয়ারির সফরটি ছিল তাৎপর্যপূর্ণ।
ওই সফরের প্রায় এক বছর পর এ বছরের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই নির্বাচনের আগে গত নভেম্বরে ফের আলোচনায় আসেন ডোনাল্ড লু। ওই সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনের আগে শর্তহীন সংলাপের চিঠি দিয়েছিলেন তিনি।
নির্বাচন ঘিরে এসব তৎপরতার কারণেই লু দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ছিলেন অন্যতম উচ্চারিত এক নাম। এবারে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর মার্কিন সরকারের কোন বার্তা নিয়ে লু ঢাকা আসছেন, তা নিয়েই কৌতূহল কাজ করছে নানা মহলে।
আরও পড়ুন-
- ২ দিনের সফরে ঢাকায় ডোনাল্ড লু
- ডোনাল্ড লু’র চিঠি অগ্রহণযোগ্য: ওয়ার্কার্স পার্টি
- ডোনাল্ড লু’র চিঠি তফসিলে প্রভাব ফেলবে না: ইসি সচিব
- ডোনাল্ড লু’র বক্তব্য নিয়ে সরকার মিথ্যাচার করেছে: ফখরুল
- ‘ডোনাল্ড লু’র আসার খবরে বিএনপি ফের ক্ষমতার স্বপ্নে বিভোর’
- অর্থবহ সংলাপের সময় আর নেই— ডোনাল্ড লুর চিঠির উত্তরে আ.লীগ
কী বলছে আওয়ামী লীগ-বিএনপি
ডোনাল্ড লুর বাংলাদেশ সফর নিয়ে এরই মধ্যে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বাক্য বিনিময় হয়ে গেছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘টেলিভিশনে মার্কিন উপপররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশে আসার খবর দেখে বিএনপি নেতারা চাঙা হয়ে গেছেন। তারা আবারও ক্ষমতার স্বপ্নে বিভোর হয়ে গেছেন। আরে বেকুবের দল, লু আসছেন বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সঙ্গে সম্পর্ক আরও এগিয়ে নিতে। বিএনপির স্বপ্ন পূরণের জন্য আমেরিকাও আর আসবে না, কেউ আসবে না।’
রাজপথের বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকেও লুর ঢাকা সফর নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন সাংবাদিকরা। জবাবে তিনি বলেন, ‘কে আসলো আর কে গেল, তা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই। কারণ আমাদের দলের প্রধান শক্তিই হলো জনগণ।’ সোমবার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানও একই ধরনের মন্তব্য করেন।
নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘ডোনাল্ড লু আমাদের কাছে এতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতটা গুরুত্বপূর্ণ কুকি-চিনের আচরণ, যেটা নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার ব্যর্থ হচ্ছে। ডোনাল্ড লু তো অনেক দূরের মানুষ। আমরা শঙ্কিত আমার নিজের দেশের অবস্থা নিয়ে। আমরা শঙ্কিত আমাদের দেশের যে ব্যাংক লুটেরা, তাদের মুক্ত করার জন্য সরকারের যে অপচেষ্টা, সেটা নিয়ে।’
কী থাকছে ডোনাল্ড লুর সফরে
ডোনাল্ড লুর সফরসূচি প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তিন দিনের সফরের প্রথম দিনে (মঙ্গলবার) প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের দেওয়া নৈশভোজে যোগ দেবেন লু। দ্বিতীয় দিন (বুধবার) তিনি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন। বৈঠক করবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ও পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গেও। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও লুর মতবিনিময়ের কথা রয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, তিন দিনের সফরে ডোনাল্ড লু সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক করবেন। সফরে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য-বিনিয়োগ, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন, নাগরিক অধিকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা প্রাধান্য পাবে।
বিশ্লেষকরা লুর এই সফরের আলোচ্যসূচিতে মানবাধিকার এবং গণতান্ত্রিক চর্চাকেও অন্যতম বিষয় হিসেবে মনে করছেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক-কূটনৈতিক সম্পর্কের গতিপথ কেমন হবে, সে বিষয়টিও এই সফরে প্রাধান্য পাবে বলে মনে করছেন তারা।
পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচুর মেকানিজম আছে, ডায়ালগ আছে। সেগুলো কীভাবে কার্যকর রাখা হবে, সেসব বিষয়ে আলোচনা হবে। রোহিঙ্গা ইস্যুটা অবশ্যই আলোচনায় থাকবে। পারস্পরিক সম্পর্কের সব উপাদানই থাকবে।
লক্ষ্য ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল?
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, ডোনাল্ড লু তার ঢাকা সফরে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার ও জলবায়ু পরিবর্তনসহ যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সহযোগিতার বিষয়ে সরকারি কর্মকর্তা, নাগরিক সমাজের নেতা ও অন্য বাংলাদেশিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন।
তবে লু এবার কেবল বাংলাদেশেই সফর করছেন না। তিনি মূলত ১০ মে ভারত পৌঁছানোর মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়া সফর শুরু করেছেন। বর্তমানে অবস্থান করছেন শ্রীলংকায়। সেখান থেকেই আজ (মঙ্গলবার) দুপুরের মধ্যে ঢাকা পৌঁছানোর কথা রয়েছে তার।
লুর এই তিন দেশ সফরের বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা জোরদার করতে ডোনাল্ড লুর সফর ভূমিকা রাখবে। অবাধ, উন্মুক্ত ও সমৃদ্ধ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের বহিঃপ্রকাশ থাকবে এই সফরে।
এরই মধ্যে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক জোরদার করতে লু চেন্নাইয়ে মার্কিন কনস্যুলেট কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। আবার শ্রীলঙ্কার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারি জোরদারেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদারের বিষয়টি নানাভাবে গুরুত্ব পেলেও লুর এই সফরে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল অন্যতম আলোচ্য বিষয় হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। চীন এই অঞ্চলে মিত্রদের নিয়ে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে। এর বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র আবার তার মিত্রদের নিয়ে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছে কৌশলগত সম্পর্কের জোট কোয়াড। ভারত কোয়াডের সঙ্গী হলেও বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল বা কোয়াড কোনোটিতেই সুনির্দিষ্টভাবে নেই। তবে দুই পক্ষ থেকেই বাংলাদেশকে দলে ভেড়ানোর চেষ্টা রয়েছে। লুর সফরে সেটিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল মো. শহীদুল হক ডয়েচে ভেলেকে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র এখন ইন্দো-প্যাসিফিক বিষয়ে বেশি জোর দিচ্ছে। তারা রাখাইন এস্টেটের ভবিষ্যতের দিকে জোর দিচ্ছে। বাংলাদেশকে হয়তো তারা এই প্রক্রিয়ায় আরও বেশি যুক্ত করতে চাইবে। ডোনাল্ড লুর সফরের গুরুত্ব সে দিকে বলেই আমরা মনে হয়। এখন তারা ভূ-রাজনীতিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির অবশ্য দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের দিকেই বেশি মনোযোগ দেখছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান তো জানা। নির্বাচনের পর তাদের পররাষ্ট্র দফতর বিবৃতি দিয়ে অবস্থান জানিয়েছে। সেখানে তারা সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার কথা বলেছে। তাদের এখন হয়তো মনোযোগ অর্থনৈতিক দিকে। এর সঙ্গে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও রাজনীতি নিয়ে তারা বলেই যাবে।
সারাবাংলা/টিআর
ইন্দো-প্যাসিফিক কোয়াড ডোনাল্ড লু ডোনাল্ড লুর ঢাকা সফর ঢাকা সফর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মার্কিন সহকারী মন্ত্রী সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী