হিমালয়ের চূড়া হার মেনেছে চট্টগ্রামের বাবর আলীর কাছে
১৯ মে ২০২৪ ১৬:৫৭
চট্টগ্রাম ব্যুরো: লিয়াকত আলী ও লুৎফুন্নাহার দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান বাবর আলী। বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল ছেলে ডাক্তার হবে। ছেলে সেই স্বপ্ন পূরণ করেছেন। কিন্তু সেই পেশায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে হাঁটলেন না ছেলে। বরং হাঁটতে শুরু করলেন পাহাড়-সমতলের দুর্গম পথে, পথে। হাঁটতে, হাঁটতে বাবর আলী স্বপ্ন দেখলেন এভারেস্ট জয়ের।
রোববার (১৯ মে) সকালে বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্টের চূড়ায় লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়ে বাবর আলী জানান দিলেন, তিনি স্বপ্ন পূরণ করেছেন। ষষ্ঠ বাংলাদেশি হিসেবে তিনি জয় করলেন এভারেস্ট। তবে বাবরের লক্ষ্য আরও বড়, তিনি এবার জয় করতে চান পৃথিবীর চতুর্থ পর্বতশৃঙ্গ লোৎসে।
সন্তানের বিজয়ে বাবরের বৃদ্ধ বাবা-মা খুশিতে আত্মহারা, একইসঙ্গে শঙ্কিতও। ছেলে ঠিকমতো শৃঙ্গচূড়া থেকে নেমে তাদের বুকে ফিরে না আসা পর্যন্ত কাটবে না এ শঙ্কা।
শুধু কী বাবর আলীর স্বজনরা, চট্টগ্রামও আজ ভাসছে আনন্দে সন্তানের এমন অনন্য অর্জনে। বাবরের সংগঠন ভার্টিকাল ড্রিমার্স তাদের ফেসবুক পেইজে লিখেছে- এর আগে চার বাংলাদেশি এভারেস্ট জয় করলেও চট্টগ্রাম থেকে বাবরই প্রথম। তাই চট্টগ্রামবাসী তার এই বিজয়ে উদ্বেলিত।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভিনন্দনের বন্যা বইছে। ছড়াকার আলেক্স আলীম ফেসবুকে বাবর আলীকে অভিনন্দন জানিয়ে একটি ছড়া পোস্ট করেছেন। লিখেছেন, ‘…হার মেনেছে, হার মেনেছে হিমালয়ের চূড়া/মুখে মুখে হাসির ঝিলিক, ছেলে কিংবা বুড়া।’ চট্টগ্রামসহ সারাদেশের মানুষের মনের কথাটুকুই যেন ফুটে উঠেছে এ ছড়ায়।
বাবর আলীদের বাড়ি চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার বুড়িশ্চর গ্রামের নজু মিয়া হাট এলাকায়। বাবা লিয়াকত আলী কুয়েত প্রবাসী ছিলেন। ২০১৭ সালে দেশে ফিরে বর্তমানে অবসর জীবনযাপন করছেন। মা লুৎফুন্নাহার বেগম গৃহিণী।
তিন ভাই, এক বোনের মধ্যে বাবর দ্বিতীয়। বড় ভাই ব্যারিস্টার, অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। দ্বিতীয় বাবর আলী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে এমফিল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিজিটি সম্পন্ন করেন। একমাত্র বোন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কক্সবাজার জেলা আদালতে কর্মরত আছেন। সবার ছোট ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করে বর্তমানে বিকাশের মার্চেন্ট ডেভেলপমেন্ট এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে আছেন।
ছেলের এভারেস্ট জয়ের অনুভূতি জানিয়ে লিয়াকত আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘খুব ভালো লাগছে। ওর একটা শখ ছিল, এভারেস্ট জয় করবে। ধীরে ধীরে সে স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে গেছে। ইনশল্লাহ আমার ছেলে এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছে গেছে। এটা বাবা হিসেবে আমার জন্য খুবই আনন্দের, উল্লাসের এবং খুশির বিষয়। আমি তার দীর্ঘায়ূ কামনা করি।’
গত ৩০ মার্চ চট্টগ্রামে সংবাদ সম্মেলনে এসে বাবর আলী তার এভারেস্ট জয়ের স্বপ্নের কথা জানিয়েছিলেন। পরদিন ১ এপ্রিল থেকে শুরু হয় তার এভারেস্ট জয়ের অভিযান। ৪ এপ্রিল নেপালের কাঠমান্ডু থেকে পৌঁছান লুকলাতে। ১০ এপ্রিল এভারেস্টের বেইজ ক্যাম্পে পৌঁছান তিনি। এরপর একমাস ধরে অপেক্ষার পালা। ১৪ মে শুরু হয় চূড়ান্ত অভিযান। ওইদিনই তিনি দ্বিতীয় ক্যাম্পে, ১৮ মে তৃতীয় ক্যাম্পে এবং ১৯ মে ভোরে ক্যাম্প ফোরে পৌঁছান। ১৯ মে সকালে তিনি ‘ডেথ জোন’ নামে পরিচিত ২৯ হাজার ৩১ ফুট উচ্চতায় শৃঙ্গে আরোহণ করে লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়ে দেন।
ভার্টিকাল ড্রিমার্সের পক্ষে বাবরের এভারেস্ট অভিযানের সমন্বয়ক ফরহান জামান বলেন, ‘এভারেস্টের পথে যাত্রা অর্থাৎ উচ্চতায় পৌঁছানোর আগে সেখানকার পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয়। ১০ এপ্রিল বাবর এভারেস্টের বেইজ ক্যাম্পে পৌঁছালেও উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। ১৪ মে মাঝরাতে বেইজ ক্যাম্প থেকে শুরু হয় বাবরের যাত্রা। প্রথমদিনেই সরাসরি পাড়ি দেন ২১ হাজার ৩০০ ফুট অর্থাৎ ক্যাম্প-২ এ পৌঁছান।’
‘সেখানে দুইরাত কাটিয়ে ১৭ মে ২৪ হাজার ৫০০ ফুট উচ্চতার ক্যাম্প-৩ এবং ১৮ মে পৌঁছান ২৬ হাজার ফুট উচ্চতার ক্যাম্প-৪ এ, যেটাকে ডেথ জোন বলা হয়। মাঝরাতেই আবারো শুরু হয় বাবরের অভিযান। ভোরের সূচনায় বাবর ২৯ হাজার ৩১ ফুট উচ্চতার এভারেস্ট শৃঙ্গের শীর্ষে উড়িয়ে দেন বাংলাদেশের পতাকা,’ – বলেন ফরহান জামান।
দুস্তর পথ পাড়ি দিচ্ছে ছেলে, মায়ের কী আর মন মানে ! ঘুমকাতুরে লুৎফুন্নাহার বেগমের নাওয়া-খাওয়া শিকেয় ওঠে। ঘুম বিদায় নেয় চোখ থেকে। নামাজে সিজদা দিয়ে পড়ে থাকেন মা সন্তানের মঙ্গল কামনায়।
লুৎফুন্নাহার বেগম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সবসময় টেনশনে ছিলাম। এখনও আছি। আমি এমনিতেই খুবই ঘুমপাগল। দিনে ১০-১২ ঘন্টা ঘুমাতাম আমি। কিন্তু যখন থেকে বাবর এভারেস্টের দিকে যাত্রা করল, ঘুম আমার চোখ থেকে চলে গেছে। গত দেড় মাসে মনে হয় দিনে আমি দুই ঘন্টাও ঘুমাতে পারিনি। নামাজ পড়ে আল্লাহকে বলেছি- আল্লাহ আপনি আমার ছেলেকে সুস্থভাবে আবার আমার কাছে ফিরিয়ে দেন। আল্লাহ আমার ছেলেকে তার লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছেন। আনন্দ লাগছে অবশ্যই। কিন্তু আমি তো মা। যতক্ষণ পর্যন্ত সে পাহাড় থেকে নেমে আসবে না, ততক্ষণ তো আমার টেনশন যাবে না।’
ছোটবেলা থেকেই দূরন্ত প্রকৃতির ছিলেন বাবর। পড়ালেখায়ও ছিলেন মেধাবী। খেলাধূলায়ও সামনের কাতারে। তারুণ্যে এসে ভ্রমণের নেশায় পেয়ে বসে। কিছুদিন চিকিৎসা পেশায় থাকলেও পরে ছেড়ে দেন। ২০১৯ সালে পায়ে হেঁটে ও পরে সাইকেলে দেশের ৬৪ জেলা ভ্রমণ করেছেন। এসব ভ্রমণে বার্তা দিয়েছেন পরিবেশ রক্ষার। ২০২৩ সালের ১৩ এপ্রিল কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর থেকে সাইকেলযাত্রা শুরু করেছিলেন বাবর আলী। এক মাসের চেষ্টায় প্রায় চার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারী গিয়ে থামেন তিনি।
এভারেস্ট জয়ের আগে আরও অনেক পর্বতশৃঙ্গ জয় করেন বাবর। ৪ হাজার ৯৮৪ মিটার উচ্চতার সারগো রি থেকে ৬ হাজার ৮১২ মিটার উচ্চতার মাউন্ট আমা দাবলাম – অন্তঃত ৯টি পর্বতশৃঙ্গ জয়ের রেকর্ড আছে বাবরের ভাণ্ডারে। এসব অর্জন নিয়ে পাওয়া পদকে শোভা পাচ্ছে তার বাসার দেয়ালে।
লিয়াকত আলী বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই খুব দূরন্ত ছিল। আবার লেখাপড়ায়ও ভালো ছিল। খেলাধূলার সব ইভেন্টে মোটামুটি তার অংশগ্রহণ থাকতো। আমার তিন ছেলে এক মেয়ের মধ্যে সে আউটস্ট্যান্ডিং ছিল বলা যায়।’
লুৎফুন্নাহার বেগম বলেন, ‘লেখাপড়ায় ভালো ছিল, ডাক্তার হিসেবেও ভালো ছিল। খেলাধূলা করতো ছোটবেলা থেকে। তবে কোনো কুঅভ্যাস ছিল না। কখনও খারাপ কিছুর সঙ্গে মেশেনি। শখ শুধু একটা, পাহাড়ে-পর্বতে ঘোরাঘুরি। এটা তো একটা ডেঞ্জারাস শখ। এজন্য আমরা টেনশনে থাকি।’
বাবরের আগে আরও পাঁচজন এভারেস্ট জয় করেন। ২০১০ সালের ২৩ মে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্টের শীর্ষে ওঠেন মুসা ইব্রাহীম। ২০১১ ও ২০১২ সালে দু’বার এভারেস্ট জয় করেন এম এ মুহিত। প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে ২০১২ সালের ১৯ মে এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করেন নিশাত মজুমদার। একই মাসের ২৬ মে ওয়াসফিয়া নাজরীন জয় করেন এভারেস্ট।
২০১৩ সালের ২০ মে এভারেস্ট জয় করে নামার পথে মারা যান সজল খালেদ, যিনি পঞ্চম বাংলাদেশি হিসেবে পর্বতজয় করেছিলেন। সেই অনাকাঙ্খিত মৃত্যুর পর গত ১১ বছরে আর কোনো বাংলাদেশি এভারেস্টের পথ মাড়াননি। ১১ বছর পর বাবর আলী আবার লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়ে বাংলাদেশিদের জন্য স্বপ্নযাত্রার পথে হাতছানি দিলেন।
৪৫ লাখ টাকা ব্যয়ের এ অভিযানে বাবরের পাশে দাঁড়ায় ভিজ্যুয়াল নিটওয়্যার লিমিটেড। এছাড়া এভারেস্ট ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, ঢাকা ডাইভার্স ক্লাব, বীকন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, ব্লু জে, চন্দ্রবিন্দু প্রকাশনী, গিরি, ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সও বাবরের স্বপ্নপূরণের সহযাত্রী হয়েছে। আর দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সামাজিক ও ক্রীড়া সংগঠনের প্রতিনিধি, বন্ধু-স্বজনরাও গণতহবিল সংগ্রহ করে বাবরের পাশে দাঁড়ান।
তবে দূরন্ত বাবর এখানেই থামছেন না। ফরহান জামান জানিয়েছেন, আগামী রোববার অর্থাৎ ২৬ মে এভারেস্টের সঙ্গে লাগোয়া পৃথিবীর চতুর্থ পর্বতশৃঙ্গ ২৭ হাজার ৯৪০ ফুট উচ্চতার লোৎসে বিজয়ের অভিযান শুরু করবেন বাবর, যেখানে এখনও পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশির পদচিহ্ন পড়েনি।
বাবরের মা-বাবা অবশ্য এর চেয়ে আর বেশি প্রত্যাশা করেন না। ছেলে সুস্থভাবে বাবা-মায়ের বুকে ফিরবে, এটাই তাদের এখন একমাত্র চাওয়া। এরপর ছেলে আবার চিকিৎসা পেশায় থিতু হবেন, সেটাই কামনা করেন তারা।
লিয়াকত আলী বলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত বাবর আমাদের বুকে ফিরে আসবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের টেনশন যাবে না। ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা শঙ্কামুক্ত হতে পারবো না। ছেলে ফিরে আসুক নিরাপদে, তার অর্জন অবশ্যই আমাদের জন্য গর্বের। তাকে আজ সারা বাংলাদেশ চিনেছে, সে তার ইচ্ছাপূরণ করেছে, বাবা-মা হিসেবে আমাদের জন্য এটা অবশ্যই গর্বের, আনন্দের। তবে আমরা চাই, এবার সে ডাক্তার হিসেবে এগিয়ে যাক, আমাদের ইচ্ছাটা সে পূরণ করুক।’
লুৎফুন্নাহার বেগম বলেন, ‘ওর (বাবর) লালিত স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। ওর বাবা অনেক আশা করে ওকে ডাক্তার বানিয়েছে। সে একজন বড় ডাক্তার হবে, এটা আমাদের লালিত স্বপ্ন। সে যাতে ডাক্তারিটা করে, তার আগামী জীবনটা যেন সুন্দর হয়, এটাই আমাদের চাওয়া।’
সারাবাংলা/আরডি/ইআ