Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দেড় যুগ পরেও আইলার ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে উপকূলবাসী

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
২৫ মে ২০২৪ ১১:০১

খুলনা: আজ ২৫ মে—আইলা দিবস। ২০০৯ সালের এই দিনে ঘূর্ণিঝড় আইলার তাণ্ডবে খুলনার কয়রা উপজেলায় লবণ পানিতে ভেসে হাজার কোটি টাকার সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘূর্ণিঝড় আইলার হানার ১৫ বছর পার হয়ে গেলেও উপজেলার মানুষ এখনও সেই দুঃসহ স্মৃতি বহন করে চলছেন।

বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় আইলায় ক্ষত ও ক্ষতির চিহ্নগুলো সুন্দরবন সংলগ্ন কয়রার উপকূলবাসীরা আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন। আজ কয়রার বিভিন্ন গ্রামে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পালিত হচ্ছে আইলা দিবস। নতুন প্রজন্মকে সেই দিনের সেই ভয়াবহ স্মৃতি অর্থাৎ কষ্টের দিনগুলোর কথা জানাতে এমন আয়োজন করা হয় কয়রায়।

বিজ্ঞাপন

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কয়রার পবনার বেড়িবাঁধ ভাঙার কারণে দক্ষিণ মঠবাড়ী গ্রামকে দুইভাগ করে সৈয়দখালী নামক একটি শাখা নদী তৈরি হয়েছিল। যেখানে আজও স্কুল কলেজ, মাদরাসার শিক্ষার্থীসহ স্থানীয় হাজারো মানুষকে প্রতিদিন ভেলায় ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হতে দেখা যায়। যার একপারে প্রতাপস্বরনী হাইস্কুল, উত্তরচক কামিল মাদরাসা, মহিলা মাদরাসা, প্রাইমারি স্কুল ও কমিউনিটি ক্লিনিক এবং অপর পারে গ্রামের অর্ধেক অংশ।

পবনা গ্রামের বাসিন্দা সুফিয়া বেগম বলেন, ‘এই খালে বাঁধ না হওয়ায় আমাদের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া থেকে ঝরে পড়ছে। আমরা এই দেড় যুগ শিশুদের ১ম শ্রেনি ও ২য় শ্রেনিতে পড়ার জন্য স্কুলে পাঠাতে পারি না। আগে স্কুলে নৌকা পার হয়ে যেত, কিন্তু এখন ভেলায় পার হয়ে যেতে হয়। শিশুরা ভয়ে ভেলায় উঠতে চায় না। এমনকি এমন কোনো সপ্তাহ নেই যে দু’ পাঁচ জন শিশু নিয়ে ভেলা উল্টে যায় না। এতে শিশুরা পানিতে পড়ে যায় এবং বই খাতা সব ভিজে যায়।’

একই গ্রামের বাসিন্দা রহিম বলেন, ‘এই ভেলা পার হয়ে হাইস্কুল, মাদরাসা ও কলেজের ছাত্ররা যায়। প্রায় গাদাগাদি করে ছেলেমেয়েরা ভেলায় উঠায় ভেলা উল্টে পানিতে পড়ে বই, খাতা ভিজে নষ্ট হয় প্রায়ই। অনেকের পক্ষেই আর এসব কেনা সম্ভব হয় না। তখন তারা আর স্কুলে আর যেতে চায় না।’

বিজ্ঞাপন

২য় শ্রেনির ছাত্রী সুমাইয়া বলে, ‘আমরা স্কুলে যেতে ভেলায় উঠতি গেলে সরাত খাই পুড়ি যাই। আর পুড়ি গিলি পানিতে ডুবে মারা যাবানে তাই ভয় করে স্কুলে যেতে।’

অনুরূপ আইলার ক্ষতচি‎‎হ্ন আজও দৃশ্যমান বিভিন্ন রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ একাধিক বাড়ি-ঘরে। এছাড়া উপজেলার ৪ ও ৫ নং কয়রা এবং হরিহরপুর, পদ্মপুকুর, গাতীরঘেরি, হাজত খালী গ্রামের অনেক পরিবার আজও বেড়িবাঁধের ওপর বসবাস করছেন।

এদিকে আইলা পরবর্তী দীর্ঘ ১৫ বছর হরিহরপুর গ্রামের কপোতাক্ষ নদীর বেড়িবাঁধের ওপর বসবাস করছেন ৭২ বছরের বৃদ্ধ অন্ধ আনার মোল্লা ও তার স্ত্রী ফুলি বিবি। তারা বলেন, ‘আইলায় আমাদের কয়েক কাঠা জমির ওপর থাকা বাড়ি-ঘর এখন ওই চোরামুখা গেটের খালের মধ্যে। সেখানে এখন ১০/১২ হাত পানি। দুই ছেলে ও দুই মেয়ে অন্য এলাকায় বসবাস করে, আর আমরা বুড়বুড়ি সেই থেকে বাঁধের ওপর খুপড়ির মধ্যে থাকি।’

তারা জানান, কপোতাক্ষ নদী চরে চিংড়িপোনা ধরে কোনো রকমে দুই জনের খাবার জোগান। তবে কেউ এখন আর খোঁজ নেয় না। একটা সরকারি ঘর পেলে সেখানে জীবনের বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দিতে চান।

শুধু আনার মোল্লা নয়, ৫ নং কয়রা বাঁধের ওপর বসবাস ৭৫ বছরের রহিম বক্সসহ করিমন বিবি, জহিরন ও ভদি বিবিদের। অথচ একদিন তাদেরও ঘরবাড়ি সবই ছিল। কিন্তু আইলার কারণে সবকিছু কয়রা নদী গ্রাস করায় তাদের ঘরে ফেরার সুযোগ নেই।

কয়রা সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এসএম বাহারুল ইসলাম বলেন, ‘শুধু আইলা নয় আম্পান ও সর্বশেষ ইয়াসের তাণ্ডবে কয়রা ইউনিয়নের মতো অন্য ইউনিয়নেও অনেক ক্ষত চি‎হ্ন রয়েছে। নির্বাচিত হয়েই ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাট সংস্কার করে যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ শুরু করেছি। প্রাকৃতিক দুর্যোগে গৃহ ও ভূমিহীন অসহায় পরিবারের তালিকা তৈরি করে দ্রুত ঘর নির্মাণসহ সব ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সহযোগিতার প্রস্তুতি নিয়েছি।’

এদিকে বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় রেমেলের জন্ম হওয়ার আশঙ্কার কথা শুনে উপজেলাবাসী আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। তারা তাকিয়ে আছেন মেঘের দিকে- কখন আবহাওয়া বিপর্যয় আসে।

উপজেলার সাত ইউনিয়নের মধ্যে এখন চারটির বেড়িবাঁধ বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে কয়রা সদর ইউনিয়নের মদিনাবাদ লঞ্চঘাট থেকে গোবরা পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার, হরিণখোলা-ঘাটাখালী এলাকায় এক কিলোমিটার, ৬ নম্বর কয়রা এলাকায় প্রায় ৬০০ মিটার বাঁধ ধসে সরু হয়ে গেছে। মহারাজপুর ইউনিয়নের কাশিয়াবাদ, মঠেরকোনা, মঠবাড়ি, দশহালিয়া এলাকায় প্রায় দুই কিলোমিটার ঝুঁকিতে রয়েছে। উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের কাটকাটা থেকে গণেশ মেম্বারের বাড়ি পর্যন্ত এক কিলোমিটার, কাশিরহাটখোলা থেকে কাটমারচর পর্যন্ত ৭০০ মিটার, পাথরখালী এলাকায় ৬০০ মিটার এবং মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের শেখেরকোনা, নয়ানি, শাপলা স্কুল এলাকা, তেঁতুলতলারচর ও চৌকুনি এলাকায় প্রায় তিন কিলোমিটারের মতো বাঁধ অধিক ঝুঁকিপূর্ণ।

উপজেলা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি মো. খায়রুল বলেন, ‘এ পর্যন্ত যতগুলো দুর্যোগ এসেছে, তার বেশিরভাগই মে মাসে। এ জন্য মে মাস এলে আতঙ্কিত থাকে উপকূলের মানুষ।’

তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘কয়রায় পানি উন্নয়ন বোর্ড এক অদৃশ্য শক্তির অধিকারী। যে জন্য বেঁড়িবাঁধ না ভাঙা পর্যন্ত তারা উপকূলে বেড়িবাঁধের দিকে তাকায়ও না।’

তিনি আরও বলেন, ‘বছরের মে মাস এলেই পাউবো কর্তৃপক্ষ বাঁধ মেরামতের তোড়জোড় শুরু করে। অথচ শীত মৌসুমে কাজ করার অনেক সুবিধা। বরাদ্দের টাকা আত্মসাতের সুযোগ সৃষ্টির জন্য পাউবোর লোকজন অসময়ে এসে কাজ ধরেন।’

তবে পাউবো খুলনা-২ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম বলেন, ‘সময়ের কাজ অসময়ে এসে করা হয়, এটা ঠিক না। আমরা ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের তালিকা করে বরাদ্দের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠাই। সেটি অনুমোদনে সময় লাগে।’

কয়রা উপজেলা নির্বাহী অফিসার(ভারপ্রাপ্ত) বিএম তারিক- উজ-জামান বলেন, ‘আইলার বিধ্বস্ত হয়ে যে খাল হয়েছে সেখানে যাতায়াতের জন্য দ্রুত একটি ড্রাম ব্রিজ করা পরিকল্পনা আছে। আসছে ঘূর্ণিঝড় রেমেলের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। আগে থেকে সাইক্লোন শেল্টারগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে।’

সারাবাংলা/আইই

ঘূর্ণিঝড়. আইলা

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

শরৎ বাংলাদেশের কোমল স্নিগ্ধ এক ঋতু
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৭:৫৪

সম্পর্কিত খবর