‘জিএমও ফসল নিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অপপ্রচার চলছে’
২৮ মে ২০২৪ ১৯:৩০
ঢাকা: দেশে জেনেটিক্যালি মডিফায়েড অর্গানিজম (জিএমও) প্রযুক্তিতে উদ্ভাবিত ফসল নিয়ে অপপ্রচার চলছে। গোল্ডেন রাইস ও বিটি বেগুন নিয়ে একটি শ্রেণি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই প্রচার চালিয়ে আসছে। এখন পর্যন্ত গোল্ডেন রাইস নিয়ে বিজ্ঞানীরা আপত্তি তুলতে পারেননি। দেশে বহুলাংশেই বিটি বেগুনের সফল চাষ হচ্ছে, উৎপাদনও বেড়েছে বেগুনের।
মঙ্গলবার (২৮ মে) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘জিএমও নিয়ে প্রচলিত ভুল ধারণা ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। এগ্রিকালচার বায়োটেকনোলোজি কোয়ালিশন (এবিসি), গ্লোবাল সাউথ হাব, ফার্মিং ফিউচার বাংলাদেশ ও এলায়েন্স ফর সাইন্স যৌথভাবে ওই আলোচনা সভার আয়োজন করে।
এগ্রিকালচার বায়োটেকনোলজি কোয়ালিশন এর আহব্বায়ক ও সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন ‘জিএমও সম্পর্কিত বিতর্ক নতুন কিছু নয়, তবে যে কোনো ভুল তথ্য বর্তমান ডিজিটাল প্রচার মাধ্যমের যুগে তা দ্বিগুণ হতে পারে। বিভিন্ন সংগঠন এখানে অপপ্রচারকারীর ভূমিকা পালন করছে, আমার বিশ্বাস জিএমও নিয়ে তাদের কোনো সুস্পষ্ট বৈজ্ঞানিক ধারণা নেই। তাই এই আলোচনা সভায় আমরা জিএমও প্রযুক্তির নৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত প্রভাবগুলো নিয়ে আলোচনায় করছি যেন এ সংক্রান্ত ভুল ধারণা জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি না করে।’
ফার্মিং ফিউচার বাংলাদেশ এর সিইও আরিফ হোসাইন বলেন, ‘জিএমও প্রযুক্তিতে সৃষ্ট ফসলগুলো প্রায়শই বিভিন্ন সমালোচনা ও অপব্যখ্যার শিকার হয়ে থাকে। জেনেটিক প্রযুক্তিতে গবেষণালব্ধ ফসল পুষ্টি উপাদান বৃদ্ধি থেকে শুরু করে অনেক কম কীটনাশক ব্যাবহার না করে ফসলের ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ দমনসহ বিবিধ উপকার সাধন করে এবং সর্বোপরি অল্প জমিতে উচ্চ ফলনের নিশ্চয়তা প্রদান করে। সেজন্য টেকসই উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে সমস্ত অসত্য ধারণার অবসান ঘটিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধানের ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা তুলে ধরতে হবে।’
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. অপর্ণা ইসলাম বলেন, ‘জিএমও প্রযুক্তি একটি শক্তিশালী মাধ্যম যা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টিসমৃদ্ধ ফসল উৎপাদন করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এ প্রযুক্তির সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন হওয়া ও সেগুলো মোকাবিলা করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। জিএমও-এর পরিবেশগত প্রভাবগুলো নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে আমরা এই প্রযুক্তিটি দায়িত্বশীলভাবে ব্যবহার করতে পারি যেন তা সবার জন্য উপকারী হয়।’
ফিলিপাইনে বিচারবিভাগ কর্তৃক গোল্ডেন রাইস এবং বিটি বেগুনের বাণিজ্যিক চাষের বিরুদ্ধে গৃহীত নিষেধাজ্ঞা এবং বাংলাদেশের জিএমও বিরোধী প্রতিষ্ঠানসমূহের অপপ্রচারমুলক তৎপরতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আব্দুল কাদের বলেন, ‘এটি ভীষণ অনাকাঙ্ক্ষিত একটি ঘটনা যে কিছুসংখ্যক মানুষ জিএমও বিষয়ে ভ্রান্তধারনার বশবর্তী হয়ে মন্তব্য করছেন ও বিজ্ঞানের অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করে যাচ্ছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে প্রতি পাঁচজন প্রাক-স্কুলগামী শিশুর মধ্যে একজন শিশু ভিটামিন এ’র ঘাটতিতে ভুগছে। যাদের সিংভাগই অস্বচ্ছল পরিবারে জন্মেছে এবং এই ঊর্ধ্বমূল্যের বাজারে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ভিটামিন এ সম্পন্ন বিভিন্ন প্রকার শাক-সবজি কেনার ক্রয়ক্ষমতা তাদের পরিবারে নেই। সেক্ষেত্রে রোজকার খাদ্যতালিকায় গোল্ডেন রাইসে উপস্থিত ‘ভিটামিন- এ’ এই ঘাটতি পূরণে সক্ষম হবে। কাজেই আমি সকলকে প্রকৃত সত্য জানতে উৎসাহিত করছি।’
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো: শাহজাহান কবীর বলেন, ‘ব্রি বা এর বিজ্ঞানীরা গবেষণা সিদ্ধ তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে কথা বলে, অনুমান বা আবেগের ভিত্তিতে নয়। ব্রি-এর বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে এই চাল নিয়ে নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে নিশ্চিত হয়েছেন যে এটি মানব শরীর, পশুপাখি ও পরিবেশের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ। ব্রি ধান২৯ যতটুকু নিরাপদ, গোল্ডেন রাইসও ততটুকুই নিরাপদ। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) এই চাল পরীক্ষা করে বলেছে এটি সম্পূর্ণ নিরাপদ। একই কথা বলেছে হেলথ ক্যানাডা এবং অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের ফুড স্ট্যান্ডার্ডস এর মতো প্রতিষ্ঠানও। বিশ্বের কোন গবেষণা বা কোনো জার্নালে জিএম ফসলের পরিবেশ, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য ঝুঁকির বিষয়টি প্রমাণিত হয়নি।’
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের গবেষণা পরিচালক ড. মো. আব্দুল্লাহ ইউসুফ আখন্দ বাংলাদেশের কৃষিখাতে বিটি বেগুনের প্রয়োজনীয়তা যে প্রমাণসাপেক্ষ তার ওপর বিশেষভাবে আলোকপাত করেন। তিনি বলেন, ‘কীটনাশকের খরচ কমানোর মাধ্যমে বিটি বেগুন দেশের অসংখ্য কৃষকের জীবন বদলে দিয়েছে। এটি প্রায় একান্ন শতাংশ কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়েছে এবং তাদের জীবনমান উন্নত করেছে। এই কারণেই, বর্তমানে প্রায় ষাট হাজার কৃষক এই বেগুন চাষ করছে ।’ তিনি আরও বলেন, ‘যখন বিটি বেগুনের চারটি জাত বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য অবমুক্ত করা হয় তখন এটিকে বিভিন্ন ধাপে কঠোর পরীক্ষা নিরীক্ষা করে এবং জাতীয় বায়োসেফটি কাঠামোর বিভিন্ন নীতিমালা অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে এর নিরাপত্তা যাচাই করা হয়। কাজেই বিটি বেগুনের নিরাপত্তা নিয়ে যেকোনো প্রশ্নই এক্ষেত্রে অবাঞ্চিত বলে বিবেচ্য হবে।’
সারাবাংলা/ইএইচটি/একে