এখনও অন্ধকারে বরিশালের ৮০% গ্রাহক, বিদ্যুৎ আসতে সময় লাগবে ২০ দিন
৩০ মে ২০২৪ ১৬:৫১
বরিশাল: ঘূর্ণিঝড় রেমালে বরিশাল বিভাগের ৫ লাখ ২৮ হাজার পরিবারের প্রায় ২২ লাখ ৩৫ হাজার মানুষ সরাসরি ক্ষতির মুখে পড়েছেন। আর বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষি ও মৎস্য খাত। ঘূর্ণিঝড়ের পর ৪দিন পেরিয়ে গেলেও বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় এখনও বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল হয়নি। বিভাগের চারটি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আওতায় ১৭ লাখ ৬৭ হাজার এবং পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার (ওজোপাডিকো) ৩ লাখ ৪০ হাজার গ্রাহক রয়েছেন। এর মধ্যে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির প্রায় ৮০ ভাগ গ্রাহক এখনও বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না। টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেট পরিষেবাও ব্যাহত হচ্ছে।
বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার চর বোয়ালিয়া গ্রামের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ফ্রিজ বন্ধ, ফ্যান ঘোরে না, অসহনীয় গরম। এমন অবস্থায় চার দিন ধরে বিদ্যুৎ নেই। রাতে ঘুমাতে পারি না। এত বড় ঝড় গেল, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করব যে মোবাইলেও কল যায় না। টিভি নেই, ইন্টারনেটও নেই। আমরা একেবারে অন্ধকারে আছি।’
বাকেরগঞ্জ পল্লী বিদ্যুতের একাধিক লাইনম্যান জানান, উপজেলার পুরো এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল করা যায়নি। যে অবস্থা, তাতে সচল করতে অন্তত ২০ দিন লেগে যাবে।
ওজোপাডিকো ও পল্লী বিদ্যুৎ সূত্র জানায়, গত রোববার রাতে রেমালের তাণ্ডব শুরুর পর বিভাগের সর্বত্র বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বুধবার পর্যন্ত ওজোপাডিকোর অন্তত তিন লাখ গ্রাহকের বিদ্যুৎ-সংযোগ আবার চালু করা গেছে। বাকি ৪০ হাজার গ্রাহকের বিদ্যুৎ-সুবিধা নিশ্চিত করা যায়নি। বিভাগে চারটি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আওতায় ১৭ লাখ ৬৭ হাজার গ্রাহক রয়েছেন। এর বেশির ভাগই এখন অন্ধকারে।
ওজোপাডিকো বরিশাল অঞ্চলের পরিচালন ও সংরক্ষণ সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আবদুল মজিদ বলেন,‘ বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনে অসংখ্য গাছ ভেঙে পড়ে আছে। খুঁটি ও সঞ্চালন লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব মেরামত ও গাছ অপসারণে সময় লাগছে। বরিশাল নগরে ও পিরোজপুর শহরের অধিকাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ চালু হয়ে গেছে। কিন্তু ঝালকাঠি শহরে এখনো চালু হয়নি। আর নলছিটিতে হাজার পাঁচেক গ্রাহক পেয়েছেন৷ এখনো ৯ হাজার গ্রাহক পাননি। সেখানে আটটি পুল ভেঙেছে। এ জন্য সময় লাগছে।’
বরিশাল পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর আওতায় ৩ লাখ ২০ হাজার ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২-এর আওতায় ২ লাখ ৫৯ হাজার ৮৬ গ্রাহক রয়েছেন। আর পটুয়াখালী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আওতায় ৬ লাখ ৭০ হাজার ও পিরোজপুরে আছেন ৫ লাখ ৭ হাজার ৪৪১ জন গ্রাহক। এসব গ্রাহকের অধিকাংশই এখন অন্ধকারে রয়েছেন।
বরগুনা সদর উপজেলার হাজারবিঘা গ্রামের আব্দুল হক বলেন, ‘বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ আসেনি। জীবন অসহনীয় হয়ে উঠেছে।’ এ এলাকা পটুয়াখালী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আওতায় রয়েছে। জেলার পাথরঘাটা, বামনা, বেতাগী উপজেলায়ও বিদ্যুৎ নেই। এই তিন উপজেলা পিরোজপুর বিদ্যুৎ সমিতির আওতায়।
পটুয়াখালী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক তুষার কান্তি মণ্ডল বলেন, ‘পটুয়াখালী সমিতির আওতায় ৬ লাখ ৭০ হাজার গ্রাহক রয়েছেন। এর মধ্যে বুধবার পর্যন্ত ৩ লাখ ৮৫ হাজার গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল করা গেছে। বাকিদের যায়নি।’
বরিশাল পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ১ এর মহাব্যবস্থাপক মো. হুমায়ুন কবির বলেন, ‘সমিতির আওতায় ৩ লাখ ২০ হাজার গ্রাহক আছেন। এর মধ্যে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাহক বিদ্যুৎ পেয়েছেন। বাকিরা পাননি। বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনে অসংখ্য গাছ উপড়ে পড়ে আছে। সরবরাহ ঠিক করতে দু-তিন দিন লেগে যেতে পারে।’
টেলিকম প্রতিষ্ঠানগুলোর সূত্রে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে বিদ্যুৎ বিভ্রাটে ১০ হাজারের বেশি মোবাইল টাওয়ার বা বেজ ট্রান্সমিটার স্টেশন (বিটিএস) সেবা দিতে পারছে না। বিটিএস রেডিও সংকেতের মাধ্যমে মোবাইল ডিভাইসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কল ও ইন্টারনেট সংযোগ দিয়ে থাকে। দক্ষিণের জেলাগুলোর লাখ লাখ মানুষের মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব পড়েছে। বরগুনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, ভোলা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ আরও কয়েকটি জেলার অধিকাংশ মানুষ টেলিযোগাযোগসেবা বিঘ্ন ঘটছে।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাত হানার পর বিভাগের ছয় জেলার ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক তালিকা তৈরি করেছে বিভাগীয় প্রশাসন। ওই তালিকা অনুযায়ী এই বিভাগের ৫ লাখ ২৮ হাজার পরিবারের প্রায় ২২ লাখ ৩৫ হাজার মানুষ সরাসরি ক্ষতির মুখে পড়েছেন। আর বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষি ও মৎস্য খাত।
বিভাগীয় প্রশাসন সূত্র জানায়, ঝড়ে বরিশাল বিভাগে ১৩ জন মারা গেছেন। গাছচাপা ও দেয়াল ধসে তারা প্রাণ হারিয়েছেন। আর ঝড়ে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে ১৫ হাজার ৫৩১টি বসতঘর। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৭২ হাজার ১৬৩টি ঘর। এর মধ্যে বরিশাল জেলায় সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে ২২৫টি ঘর, আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে ২ হাজার ৪৬৭টি ঘর। পটুয়াখালীতে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে ৬ হাজার ৮২টি ঘর, আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে ৫ হাজার ১৫৮টি; পিরোজপুরে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে ৩ হাজার ২০৫টি ঘর, আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে ১৮ হাজার ১১টি; বরগুনায় সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে ৩ হাজার ৩৭৪টি ঘর, আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে ১৩ হাজার ৪৩টি এবং ঝালকাঠিতে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে ১৫০টি ঘর, আংশিক বিধ্বস্ত ১ হাজার ৭৯০টি। ঝড়ে ১৩ জন মারা যাওয়ার তথ্য দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বরিশাল, পটুয়াখালী ও ভোলায় তিনজন করে এবং পিরোজপুরে চারজনের মৃত্যু হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়ে বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে ক্ষতির শিকার হয়েছে কৃষি ও মৎস্য খাত। কৃষি খাতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৫০৮ কোটি টাকা। এই ঝড়ে বিভাগের ৬ জেলায় ১ লাখ ৮০ হাজার ৪৮১ কৃষক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বরিশাল অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালকের কার্যালয়ের সূত্র জানায়, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক পরিবারের মধ্যে প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষক রয়েছেন ১ লাখ ৭০ হাজারের মতো।
বিভাগীয় মৎস্য অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, বিভাগের পুকুর, ঘের, স্লুইসগেটের মতো অবকাঠামোর ক্ষতির পরিমাণ ৩১ কোটি ৪২ লাখ টাকা; আর মৎস্য খাতে সম্পদের ক্ষতির পরিমাণ ২১৭ কোটি টাকার বেশি। খামার, পুকুর, দিঘি ও ঘেরের ক্ষতির কারণে বিভাগজুড়ে ১৫০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া ১৫৯ মেট্রিক টন চিংড়ি, প্রায় ৭ কোটি পোনা ও ৬৯ মেট্রিক টন কাঁকড়া ও কুঁচিয়ার ক্ষতি হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে কোনো জেলে নিহত হননি। তবে ৩৫০ কোটি টাকা মূল্যের ১ হাজার ১৯টি নৌযান (নৌকা/ট্রলার/জলযান) ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা মূল্যের ৮৯৪টি জাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
মৎস্য অধিদফতরের বরিশাল বিভাগীয় সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলেন, ‘এটি ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক হিসাব। পূর্ণাঙ্গ হিসাব পেতে আমাদের আরও বেশ কিছুদিন সময় লাগবে।’
সারাবাংলা/একে