সন্তু লারমার ‘গদি’ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে ইউপিডিএফ
৩০ মে ২০২৪ ২০:১৫
রাঙ্গামাটি: গত ২৫ বছর ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা। তিনি পাহাড়ে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা না করে তার লালিত সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে প্রতিপক্ষ গোষ্ঠীকে হত্যা করছেন; পাহাড়কে অশান্ত করে তুলেছেন—এমন অভিযোগ তুলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে ইউনাইটেড পিললস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-ইউপিডিএফ।
এরইমধ্যে সংগঠনটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি দিয়েছে। সেখানে সন্তু লারমার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে। প্রশ্ন তোলা হয়েছে চেয়ারের বৈধতা নিয়েও।
সাবেক ‘গেরিলা নেতা’ সন্তু লারমার নেতৃত্বে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ সম্পাদন হয়। এই চুক্তির লক্ষ্য ছিল পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা।
নব্বই দশকের শেষ দিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ‘স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার’ লক্ষ্যে সম্পাদিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সইয়ের ২৬ বছর পেরিয়েছে। চুক্তির আওতায় পাহাড়ে ‘স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা এবং উন্নয়নকে জরুরি শর্ত মনে করে ইউপিডিএফ। তবে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছেন চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান সন্তু লারমা— এমন অভিযোগ তুলেছে প্রসিত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদনের আগ থেকেই জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি দায়িত্ব পালন করে আসছেন সন্তু লারমা। এক সময় এই জনসংহতি সমিতির ছাত্র সংগঠন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন প্রসিত খীসা। ’৯৭ সালে চুক্তি সইয়ের পর পাহাড়ের এক দলটি ভেঙে দুই আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠেছে প্রসিত খীসার নেতৃত্বেই। পাহাড়ে দীর্ঘ প্রায় তিন দশকের রাজনৈতিক ‘অস্থিরতা’ ও ‘বিরোধ’কে গুরু-শিষ্যের লড়াই মনে করেন কেউ কেউ।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সইয়ের পর পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গঠন ও অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠান হস্তান্তর হয়েছে পার্বত্য জেলা পরিষদে। পার্বত্য চুক্তির ফলে গড়ে ওঠা একটি প্রভাবশালী সংগঠন হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ। যেটি মূলত তিন পার্বত্য জেলা পরিষদকে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় করে। পরিষদসমূহের মধ্যে কোনো বিরোধ দেখা দিলে আইনের বিধান সাপেক্ষে আঞ্চলিক পরিষদের সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত। তবে বিভিন্ন সমাবেশে জেএসএস নেতারা পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহে আঞ্চলিক পরিষদ হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না বলে অভিযোগ করে আসছেন।
এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একই সুরেই অভিযোগ জানিয়েছে ইউপিডিএফ। বৃহস্পতিবার (৩০ মে) গণমাধ্যমে পাঠানো একটি বিবৃতিতে ইউপিডিএফের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি নুতন কুমার চাকমা সন্তু লারমার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য দাবি জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি সন্তু লারমার বিরুদ্ধে একটি ‘ব্যক্তিগত সশস্ত্র গ্রুপ’ প্রতিপালন, ইউপিডিএফ, আওয়ামী লীগ ও জেএসএস সংস্কারবাদী (জেএসএস-এমএন লারমা) গ্রুপের শত শত নেতাকর্মীকে হত্যা এবং আঞ্চলিক পরিষদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার অভিযোগ এনেছেন।
যদিও ইউপিডিএফের বিরুদ্ধেও সশস্ত্র গ্রুপ প্রতিপালনের অভিযোগ রয়েছে সন্তু লারমার জেএসএসের।
গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে ইউপিডিএফ সহ-সভাপতি নুতন কুমার চাকমা বলেন, ‘সরকার ১৯৯৮ সালে প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন (১২ নং আইন) বলে ১৯৯৯ সালের ২৭ মে অন্তর্বর্তীকালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করে। জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমাকে এই পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। সেই পর থেকে আজ অবধি অর্থাৎ গত ২৫ বছর ধরে নির্বাচন ছাড়া তিনি এক নাগাড়ে পরিষদে গদিতে রয়েছেন।’
তিনি আরও অভিযোগ করেছেন, এই দীর্ঘ সময়ে সন্তু লারমা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের প্রতি তার দায়িত্ব পালনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন। সন্তু লারমা আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা সত্বেও ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য একটি সশস্ত্র গ্রুপ (প্রাইভেট আর্মি) প্রতিপালন ও রক্ষণাবেক্ষণ করে চলেছেন, যা তিনি একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অকপটে স্বীকার করেছেন।
নুতন কুমার উদ্বেগ প্রকাশ করেই বলেন, বাংলাদেশে একজন প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদার কাউকে তার ব্যক্তিগত সশস্ত্র বাহিনী রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছে বলে কোনো পূর্ব নজির নেই। সন্তু লারমা এই সশস্ত্র গ্রুপকে দিয়ে তার প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের খুন, জখম ও অপহরণ করে চলেছেন। গত ২৫ বছরে তার নেতৃত্বে পরিচালিত এই সশস্ত্র গ্রুপের হাতে ইউপিডিএফ, আওয়ামী লীগ ও সংস্কারবাদী জেএসএসের শত শত নেতাকর্মী খুন হয়েছেন। কেবলমাত্র ইউপিডিএফের খুন হন ২৭৭ জন; বিলাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুরেশ কান্তি তঞ্চঙ্গ্যাসহ আওয়ামী লীগের খুন হন ১০ জন।
নুতন কুমার চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইনের ৪১ নং ধারা মোতাবেক সন্তু লারমার বিরুদ্ধে আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে চিঠিতে বলেন, ‘ইউপিডিএফ তথা সমগ্র পার্বত্যবাসীর দাবি হলো গত ২৫ বছর ধরে আঞ্চলিক পরিষদের দায়িত্বপালনে চরম ব্যর্থতা, পরিষদ আইনে প্রদত্ত ক্ষমতার সীমা লঙ্ঘন করে ব্যক্তিগত সশস্ত্র গ্রুপ প্রতিপালন ও প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের হত্যা করা এবং চরম জনস্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার দায়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইনের ৪১ নং ধারা মোতাবেক সন্তু লারমা ও তার নেতৃত্বাধীন পরিষদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক। উক্ত পদক্ষেপ হবে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা এবং উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক শর্ত।’
তবে সন্তু লারমার বিরুদ্ধে ইউপিডিএফের ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি প্রসঙ্গে কোনো বক্তব্য দেয়নি তার প্রতিষ্ঠান পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ। আঞ্চলিক পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নির্মল কান্তি চাকমা বলেন, ‘কার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ আনা হয়েছে; আমি তো এখনও সেটি জানি না।’
সন্তু লারমার রাজনৈতিক দল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার বলেন, ‘চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক পরিষদ ও জনসংহতি সমিতির কোনো ত্রুটি নেই। অস্ত্র সমর্পণসহ সব বিষয়ে সহযোগিতা করে আসছে। ব্যর্থতার অভিযোগ করলেই তো হবে না। ইউপিডিএফের এই বক্তব্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং তারা (ইউপিডিএফ) জাতির জন্য কী করেছে তা আত্ম-জিজ্ঞাসা করা উচিত। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতিতে অভিযোগ না করে সকলের দলমত নির্বিশেষে কাজ করা প্রয়োজন।’
ইউপিডিএফের প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগের প্রধান নিরন চাকমার সই করা গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, বৃহস্পতিবার (৩০ মে) সকালে ইউপিডিএফের সহ-সভাপতি নুতন কুমার চাকমার পক্ষে একটি প্রতিনিধি দল পানছড়ি ইউএনও’র কাছে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠিটি হস্তান্তর করেন। যদিও এ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে একাধিবার কল দিয়েও খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মৌমিতা দাশের অফিসিয়াল মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হলে তাকে পাওয়া যায়নি।
সারাবাংলা/একে
ইউপিডিএফ জেএসএস পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিষদ পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ সন্তু লারমা