১৫০ ভরি সোনা ‘গায়েব’ রহস্যে কোটি টাকার প্রশ্ন— লকার খুলল কে
২ জুন ২০২৪ ২১:২৩
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামে ইসলামী ব্যাংকের লকার থেকে এক গ্রাহকের প্রায় ১৫০ ভরি সোনার অলংকার চুরির অভিযোগ নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য মিলছে না। গ্রাহক বলছেন, লকার রুমে প্রবেশের মুহূর্তে লকার ইনচার্জই তাকে প্রথম লকারটি খোলা অবস্থায় থাকার তথ্য দেন। লকার খোলার মূল চাবি থাকে একমাত্র গ্রাহকের কাছে। তাহলে গ্রাহক ছাড়া সুরক্ষিত ভল্টে লকারটি খোলার সঙ্গে কে বা কারা জড়িত— এ প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট কোনো জবাব মিলছে না।
অন্যদিকে ইসলামী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ লকার থেকে সোনার অলংকার খোয়া যাওয়ার ঘটনায় গ্রাহকের বিরুদ্ধে স্ববিরোধী ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দেওয়ার অভিযোগ তুলেছে।
অলংকার চুরির অভিযোগ ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ নিয়েও নানা ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। ঘটনা জানাজানির পাঁচ দিন পরও গ্রাহকের পক্ষ থেকে কোনো আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। একইভাবে ব্যাংকের পক্ষ থেকেও পুলিশকে অবহিত করা হয়নি। বরং অভ্যন্তরীণ তদন্তের কথা বলে গ্রাহককে আশ্বস্ত করে ঘটনাটি গোপন রাখার চেষ্টায় ছিলেন তারা। গ্রাহকের কাছ থেকে সাত দিন সময়ও নেওয়া হয়।
চট্টগ্রাম নগরীর ইসলামী ব্যাংক চকবাজার শাখার গ্রাহক রোকেয়া আক্তার বারী গত বুধবার (২৯ মে) দুপুরে ব্যাংকে গিয়ে জানতে পারেন, তার জন্য বরাদ্দ করা লকারটি খোলা অবস্থায় আছে। সেখানে রাখা প্রায় ১৫০ ভরি সোনার অলংকার নেই বলে তার অভিযোগ। তিন দিন পর শনিবার (১ জুন) রাতে বিষয়টি জানাজানি হয়।
নগরীর চট্টেশ্বরী রোডের বাসিন্দা রোকেয়া আক্তার বারী বলেন, “গত বুধবার (২৯ মে) দুপুরের দিকে আমি ব্যাংকে যাই। নিয়ম অনুযায়ী প্রথমে লকার ইনচার্জ লকার রুমে ঢোকেন। আমি ঢুকব— এমন সময় উনি বের হয়ে বললেন, ‘ম্যাডাম, আপনার লকারের নম্বর কত?’ আমি সেটা বললাম। উনি বললেন, ‘ম্যাডাম, আপনার লকার তো খোলা।’”
প্রায় ১৫০ ভরি সোনার অলংকার লকারে না থাকার অভিযোগ করে রোকেয়া বলেন, ‘আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে লকারে হাত ঢুকিয়ে দেখলাম, সামনের দিকে যেগুলো রাখা হয়েছিল, সেগুলোর কিছু নেই। পেছনের দিকে সাত-আটটা বক্স পেয়েছি। সেখানে দুইটা বক্সের মধ্যে অল্প কিছু গোল্ড পেয়েছি। পাঁচ-ছয়টা খালি। ১৪৯ থেকে ১৫০ ভরির মতো স্বর্ণালংকার নেই। আমার দুই ছেলের বউয়ের গোল্ড সেখানে ছিল।’
আরও পড়ুন- ইসলামী ব্যাংকের লকার থেকে ১৫০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ‘গায়েব’
এদিকে রোববার (২ জুন) সন্ধ্যায় গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে ইসলামী ব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট নজরুল ইসলাম জানান, গত ২৯ মে গ্রাহক তার লকার ব্যবহার করতে এসে তার গহনা খোয়া গেছে বলে জানান। অথচ এর আগে তিনি নিজে লকার বন্ধ করে চাবি নিয়ে গেছেন। তারপর লকার হোল্ডার (গ্রাহক) একবার বলেন তার ৩০০ ভরি স্বর্ণ নেই, কিছুক্ষণ পর আবার জানান ১৫০ ভরি স্বর্ণ নেই এবং কিছুক্ষণ পর আবার জানান ১৫০ ভরির মধ্যে অর্ধেক পেয়েছেন, বাকি অর্ধেক পাননি। তিনি এ ধরনের স্ববিরোধী ও বিভ্রান্তকর তথ্য দিয়েছেন।
রোববার দুপুরে ব্যাংকে গিয়ে লকার ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্বরত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও শাখা প্রধানের অনুমতি মেলেনি। এমনকি লকার ইনচার্জের নামও জানাতে রাজি হননি তিনি।
চকবাজার শাখা প্রধান ও ইসলামী ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম শফিকুল মওলা চৌধুরী সারাবাংলাকে জানান, ২০০২ সাল থেকে রোকেয়া আক্তার বারী এককভাবে লকারটি ভাড়া নিয়ে পরিচালনা করে আসছিলেন। উনি একাই সেটি পরিচালনা করতেন, মনোনীত কোনো প্রতিনিধি ছিল না।
তবে ইসলামী ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ২০০৬ সাল থেকে রোকেয়া আক্তার বারী ও তার মেয়ে নাসিয়া মারজুকা যৌথ নামে লকারটি ব্যবহার করে আসছিলেন।
অন্যদিকে গ্রাহক রোকেয়া আক্তার বারী ও তার ছেলে রিয়াদ মোহাম্মদ মারজুক জানান, ২০০৭ সাল থেকে রোকেয়া আক্তার একমাত্র গ্রাহক হিসেবে লকারটি ব্যবহার করে আসছিলেন। সেখানে তার নিজের, দুই পুত্রবধূর এবং মেয়ের প্রায় ১৬০ ভরি সোনার অলংকার রাখা হয়েছিল। এর মধ্যে ১০-১১ ভরি বাদে বাকি সব অলংকার ‘উধাও’ হয়ে গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সোনার অলংকার খোয়া যাওয়ার বিষয়ে গ্রাহক রোকেয়া আক্তার বারী ব্যাংকের কাছে কোনো লিখিত অভিযোগ করেননি। অভিযোগ নিয়ে ২৯ মে দুপুরে তিনি চকবাজার থানায় গিয়েছিলেন। সেখানে মৌখিক অভিযোগ করার পর ওসি ব্যাংকে যান এবং লকার খোলা থাকার বিষয়ে প্রাথমিক সত্যতা পেয়ে তাকে লিখিত অভিযোগ দিতে বলেন। রাতে রোকেয়া আক্তারের ছেলে লিখিত অভিযোগ নিয়ে থানায় যান। তিনি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে চাইলে ওসি এ ধরনের ঘটনায় মামলা করতে হবে বলে জানান। তিনি সময় চাইলে ওসি পরদিন দুপুর ১২টার দিকে লিখিত এজাহার নিয়ে থানায় যেতে বলেন। এরপর তারা আর থানায় যাননি।
জানতে চাইলে রোকেয়া আক্তার বারী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের একজন আইনজীবী আছেন। উনার সঙ্গে পরামর্শ করেছি। উনি বলেছেন আদালতে মামলা করতে। মামলার প্রক্রিয়া চলছে। অবশ্যই মামলা হবে। আমি আমার গোল্ড ফেরত চাই। না হলে সমপরিমাণ টাকা আমাকে ফেরত দিতে হবে।’
ছেলে রিয়াদ মোহাম্মদ মারজুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘ব্যাংক এবং থানা একেবারে লাগোয়া। আইনজীবী বলেছেন, থানার চেয়েও আদালতে মামলা করলে ভালো হবে। তখন পিবিআই বা সিআইডিকে দিয়ে তদন্ত হবে।’
ব্যাংকের পাশেই চকবাজার থানা। অথচ গত পাঁচ দিনেও গুরুতর এ অভিযোগের বিষয়ে পুলিশকে মৌখিক কিংবা লিখিতভাবে কিছুই জানানো হয়নি ব্যাংকের পক্ষ থেকে। চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ ওয়ালী উদ্দিন আকবর সারাবাংলাকে বলেন, ‘গ্রাহকের অভিযোগ পেয়ে আমরা ব্যাংকে গিয়েছিলাম। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এ পর্যন্ত আমাদের কিছুই জানায়নি। এ বিষয়ে তারা আমাদের সঙ্গে কোনো কথাও বলেনি।’
জানতে চাইলে চকবাজার শাখা প্রধান ও ইসলামী ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম শফিকুল মওলা চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। উনারা পরামর্শ দিয়েছেন, আগে তদন্ত কার্যক্রম শেষ হোক। তারপর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সত্যাসত্য যাচাই না করে পুলিশের কাছে কোন যুক্তিতে যাব? গ্রাহকের সঙ্গে আমাদের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। মৌখিকভাবে উনাদের কাছে আমরা সময় চেয়েছি। অ্যামি কেবল রিলেশনের মাধ্যমে সমঝোতা করতে চেয়েছি। উনারা আমাদের সাত দিন সময় দিয়েছেন।’
লকারের প্রযুক্তিগত বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে গ্রাহক ছাড়া কারও পক্ষে সেটি খোলা সম্ভব নয় উল্লেখ করে ব্যাংকের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘মৌখিক অভিযোগ পাওয়ার পর আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করে দেখেছি। লকার রুমে কোনো জানালা বা ভেন্টিলেটর নেই। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা রক্ষী সেখানে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করেন। লকার রুমে চুরির কোনো সুযোগ নেই।’
ইসলামী ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, প্রতিটি লকার খোলার জন্য দুটি চাবির প্রয়োজন হয়, যার একটি গ্রাহক ও অন্যটি ব্যাংকের কাছে থাকে। গ্রাহকের চাবি ছাড়া কেবল ব্যাংকে রক্ষিত চাবি দিয়ে কোনোভাবেই লকার খোলা সম্ভব নয়। ব্যাংকিং নিয়ম অনুযায়ী গ্রাহককে তার লকারের মূল চাবি বুঝিয়ে দেওয়া হয়। লকারে রক্ষিত মালামাল ও তার পরিমাণ সম্পর্কে একমাত্র গ্রাহক ছাড়া ব্যাংকার বা অন্য কোনো ব্যক্তির জানার সুযোগ নেই।
একমাত্র গ্রাহকের পক্ষে তার চাবি দিয়ে লকার বন্ধ করার সুযোগ আছে। লকার বন্ধ না করা পর্যন্ত গ্রাহকের চাবি বের করে আনা যায় না। লকার বন্ধ করার সময় নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংকের কারও সেখানে থাকার সুযোগ নেই।
ব্যাংক কর্মকর্তা এস এম শফিকুল মওলা চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘রোকেয়া আক্তার গত ৮ এপ্রিল লকার ব্যবহারের জন্য ব্যাংকে এসেছিলেন। ব্যাংক কর্মকর্তা গ্রাহকের উপস্থিতিতে মাস্টার কী (চাবি) দিয়ে লকার আনলক করেন। পরে গ্রাহক যথারীতি তার কাছে রক্ষিত চাবি ব্যবহার করে পরিপূর্ণভাবে লকার খুলে তার কাজ শেষে লকার বন্ধ করে লকার ইনচার্জকে অবহিত করে চলে যান।’
সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও ব্যাংক রেজিস্ট্রারের তথ্য অনুযায়ী, ৮ এপ্রিলের পর থেকে ২৯ মের আগ পর্যন্ত রোকেয়া আক্তার বারী আর লকার ব্যবহার করেননি বলে জানান শফিকুল মওলা চৌধুরী।
রোকেয়া আক্তারও অবশ্য জানিয়েছেন, ৮ এপ্রিল তিনি লকারে সব সোনার অলংকার পেয়েছিলেন এবং যথারীতি লকার বন্ধ করেই ফিরে যান তিনি। তাহলে লকার খোলা অবস্থায় পাওয়া গেল কেন, লকার খুলল কে— এ প্রশ্ন রোকেয়া আক্তার বারীরও।
সারাবাংলা/আরডি/টিআর
ইসলামী ব্যাংক ব্যাংকের লকার লকার সোনা গায়েব সোনার অলংকার স্বর্ণালংকার স্বর্ণালংকার গায়েব