Monday 18 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভাঙন আতঙ্কে রাতে ঘুম আসে না পদ্মাপাড়ের বাসিন্দাদের

রিপন আনসারী, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
৩ জুন ২০২৪ ১৬:৫২

মানিকগঞ্জ: বর্ষা শুরু হওয়ার আগেই মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার পদ্মা পাড়ের মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে ভাঙন আতঙ্ক। উপজেলার কাঞ্চনপুর, রামকৃষ্ণপুর, ধুলশুড়া, আজিমনগর, লেছড়াগঞ্জ সুতালড়ি ও গোপিনাথপুর ইউনিয়নের নদী তীরবর্তী বিভিন্ন এলাকায় প্রতি বছরই বর্ষার আগে ও পরে ভাঙন দেখা দেয়। নদীতে পানি বাড়ায় ইতিমধ্যে উপজেলার কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের পদ্মানদী তীরবর্তী ৫টি গ্রামে শুরু হয়েছে ভাঙন। ফলে পদ্মাপাড়ের মানুষজন পরিবার-পরিজন নিয়ে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। বর্ষা শুরু হওয়ার আগেই ভাঙন রক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া না হলে পদ্মা গ্রাস করে নিবে তীরবর্তী এলাকার মানুষের ফসলের জমি এবং শেষ আশ্রয়টুকু!

বিজ্ঞাপন

হরিরামপুর উপজেলার কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের পদ্মাপাড়ের কোটকান্দি গ্রামে সরেজমিন দেখা যায়, ভাঙন আতঙ্কে সেখানকার মানুষজনের মধ্যে বিরাজ করছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। অনেকের বসতভিটার হাত কয়েক সামনেই চলে এসেছে পদ্মা নদী। এরইমধ্যে অসংখ্য মানুষের ফসলি জমি চলে গেছে পদ্মার পেটে। বৈরি আবহাওয়া দেখা দিলেই প্রচণ্ড ঢেউ আর বাতাসের গর্জনে অনেক পরিবারই নির্ঘুম রাত কাটায়।

গ্রামবাসী বলছেন, বাড়ির সামনে পদ্মা তেড়ে আসায় শেষ আশ্রয়টুকু হারানোর ভয়ে ভীত অনেকেই। ভাঙন প্রতিরোধে দ্রুত সমাধান দরকার। গতবছর ভাঙনকবলিত এলাকায় জিও ব্যাগ ফেলা হলেও সম্প্রতি বৈরি আবহাওয়া এবং পানি বৃদ্ধির ফলে তা ধসে গেছে। ভাঙন প্রতিরোধের স্থায়ী বন্দোবস্ত না করায় অসহায় হয়ে পড়েছেন এখানকার ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিরাও। তারা বারবার কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও ভাঙনরোধে শুধুমাত্র জিও ব্যাগ ফেলে দায় এড়িয়ে যাচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের কোটকান্দি গ্রামের সালেহা বেগম বলেন, ‘স্বামীডা মইরা গেছে, পোলাপান নিয়ে কত কষ্ট করতাছি তা কাউরে বুঝাইবার পারুম না। একবার ভাঙছে আবার ভাঙলে কই যামু, কি খামু এই চিন্তায় সারা রাইত ঘুম অয় না। ঘরে একলা থাকি, ডরাইয়া বাঁচি না। ঘুম আসে না তাই বারবার উইঠ্যা গাঙের পাড়ে যাই। সরকারের কাছে যদি যাইবার পারতাম, তারে হাতে পায়ে ধরে কই আসতাম আমাগো বাঁচান। কিন্তু সরকার ক্যারা চিনি না তো, যামু কই।‘

পদ্মাপাড়ের আরেক বাসিন্দা জবেদা বেগম। তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ৪ বার বাড়িঘর জমি-জমা সবকিছুই ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে পদ্মা। এখন যেখানে আছি সেখান থেকেও পদ্মা মাত্র কয়েক হাত দূরে। সরকার যদি ভাঙনরোধে আমাদের পাশে না দাঁড়ায় তাহলে আমরা আবারও ঠিকানা হারাবো। আমাদের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।’

বিজ্ঞাপন

কোটকান্দি গ্রামের বৃদ্ধা তারা বেগম আক্ষেপ করে বলেন, ‘পদ্মা আমার পিছু ছাড়ছে না। ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে যেখানেই গেছি সেখানেই পদ্মা হাজির। এভাবে ৭ বার ভাঙনের শিকার হয়ে এখন কোটকান্দি গ্রামে ৮ শতাংশ জায়গার ওপর কোনরকম খেয়ে না খেয়ে মাটি কামড় দিয়ে পড়ে আছি। তিন মেয়ে এক ছেলের সংসারের শেষ আশ্রয়টুকু যেকোনো সময় পদ্মা গিলে খেতে পারে। যদি ভেঙে নিয়ে যায় তাহলে মরণ ছাড়া কোন উপায় থাকবে না।’

অন্যের জায়গায় আশ্রয় নেয়া রওশন আরা বেগম বলেন, ‘কবিরপুরে থাকাকালীন প্রথমবার পদ্মা বাড়ি-ঘর ভেঙে নিয়ে যায়। এরপর আরো তিন ভাঙ্গা দিয়েছে। এখন অন্যের জায়গায় আশ্রয় নিয়ে বেঁচে আছি। পদ্মা নদী যেভাবে ধেয়ে আসছে যদি বালুর বস্তা না ফেলা হয় তাহলে আশ্রয় নেওয়ার জায়গাটুকু আর থাকবে না।’

কোটকান্দি গ্রামের ৭০ বছরের বৃদ্ধ আব্দুল আজিজ বলেন, ‘রাক্ষসী পদ্মা আমাগো শেষ করে দিল। এখন পর্যন্ত দুইবার ভাঙছে। পরিবারের ৮ সদস্য নিয়ে বর্তমানে যেটুকু জায়গায় আছি সেটুকু ভাঙলে যামু কোথায়?’

কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য কাঞ্চন মেম্বার বলেন, ‘কষ্টের কথা কি কমু। ভাঙন আতঙ্কে রাতে ঘুমাতে পারি না। আমাদের কোটকান্দিসহ চার-পাঁচটি গ্রামে ভাঙন দেখা দিয়েছে। বহু জায়গা জমি পদ্মার পেটে চলে গেছেন। মাথা গোজার এই আশ্রয়টুকুও যদি এবার চলে যায় তাহলে বাড়িঘর করার আর সামর্থ্য নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘সরকার যদি একটি স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করে দেয় তাহলে পদ্মা পাড়ে কিছুটা হলেও স্বস্তিতে থাকা যাবে। ভাঙনরোধে আপৎকালীন ব্যবস্থা করা না হলে মাথা গোজার শেষ আশ্রয়টুকু পদ্মার পেটে চলে যাবে।’

এদিকে পদ্মার ভাঙনে ক্রমান্বয়ে ছোট হয়ে আসছে কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের মানচিত্র। কাঞ্চনপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গাজী বনী ইসলাম রুপক বলেন, ‘আমার কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের মোট ১৩টি মৌজা ছিল। ইতিমধ্যে ১২টি মৌজা পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। বাকি একটি মৌজার তিন ভাগের দুই ভাগই বিলীন হয়ে গেছে। বাকি যেটুকু আছে সেটুকু হুমকির মুখে রয়েছে। সামনে বর্ষা মৌসুম, যদি দ্রুত সময়ের মধ্যে জিও ব্যাগ ফেলে আপদকালীন ভাঙন রোধ করা না যায় তাহলে অবশিষ্ট অংশটুকু হুমকির মুখে পড়ে যাবে।’

চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘বিগত সময়ে ভাঙনরোধে যেসব জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছিল সেগুলো আপৎকালীন। তাছাড়া কাজের মান ততটা গুণগত হয়নি। পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে জিও ব্যাগগুলো ধসে অন্যত্র চলে যায়। পরের বছর সেগুলো আর ভাঙনরোধে কোন কাজে আসে না। ভাঙন রোধ করতে হলে ব্লকের মাধ্যমে স্থায়ী বেরিবাঁধ দরকার।’

মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাঈন উদ্দিন বলেন, ‘পলিমাটিতে ভরা নদী তীরবর্তী এলাকা অনেক দুর্বল। তাই যেকোনো সময় যেকোন জায়গায় ভাঙন দেখা দিতে পারে। কাঞ্চনপুরের ওই পাঁচ গ্রামের ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করা হয়েছে। পাউবোর পক্ষ থেকে পরিস্থিতি নিয়ে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। আপতকালীন জিও ব্যাগ ফেলার কাজ শিগগিরই শুরু করা হবে। আর বরাদ্দ পেলে দ্রুত প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণকাজ শুরু হবে।’

সারাবাংলা/এমও

পদ্মাপাড় পানি উন্নয়ন বোর্ড ভাঙন মানিকগঞ্জ হরিরামপুর

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর