সরকার গঠন নিয়ে মোদি-অমিতের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ
৫ জুন ২০২৪ ১২:৫১
ভারতের লোকসভা নির্বাচনে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ) জোট নিয়ে সরকার গঠনের উপযোগী সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও দল হিসেবে সেই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহের নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন বিজেপি। সরকার গঠনের জন্য ২৭২ আসনের যে ‘ম্যাজিক নাম্বার’, তা থেকে অনেকটাই দূরে দলটি। ফলে সরকার গঠন করতে হলে জোটবদ্ধ হওয়া ছাড়া মোদির সামনে আর কোনো রাস্তা নেই। কিন্তু সেই জোট গঠন নিয়েই নানা প্রশ্ন মাথাচাড়া দিচ্ছে। মোদির জোটের দলগুলোর সঙ্গে বিরোধী কংগ্রেসের যোগাযোগ সেসব প্রশ্নকেই আরও উসকে দিয়েছে। ভারতের সরকার কেমন হতে যাচ্ছে— সেদিকেই এখন সবার দৃষ্টি।
মঙ্গলবার (৪ জুন) ভারতের দীর্ঘ সাত ধাপের লোকসভা নির্বাচনের ভোট গণনা শুরু হয়। মাঝরাত পেরিয়ে পাওয়া যায় পূর্ণাঙ্গ ফলাফল। তাতে দেখা যায়, মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি পেয়েছে ২৪০ আসন, বিরোধী দল কংগ্রেস পেয়েছে ৯৯টি আসন। তবে মোদির এনডিএ জোটের দখলে রয়েছে ২৯৩ আসন, যা সরকার গঠনের জন্য যথেষ্ট। অন্যদিকে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ‘ইন্ডিয়া’ জোটের আসন ২৩৩টি।
এর আগে ২০১৪ ও ২০১৯ সালের নির্বাচনে টানা জয় পেয়ে সরকার গঠন করে বিজেপি। দুবারই মোদির নেতৃত্বে জোট সরকার গঠন করা হলেও বিজেপির নিজেরই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা (২০১৪ সালে ২৮২টি ও ২০১৯ সালে ৩০৩টি আসন) থাকায় জোটসঙ্গীদের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হতে হয়নি মোদি-অমিতকে।
আরও পড়ুন- জোটের যুগ ফিরেছে ভারতে, সঙ্গে ফিরবে জোট ধর্মও
ভারতের রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরেই এতদিন জোটে রাখলেও জোটসঙ্গীদের সে অর্থে কখনো গুরুত্বও দেয়নি বিজেপি। ফলে এনডিএ থেকে অনেক দল চলে গেছে। পাঞ্জাবের শিরোমনি আকালি দল, শিবসেনার উদ্ধব শিবির, দক্ষিণের এআইএডিএমকের মতো গুরুত্বপূর্ণ দল আর এই জোটে নেই। যারা জোট ছাড়তে পারেনি, তাদেরও বিস্তর অভিযোগ বিজেপির বিরুদ্ধে। পাশার দান এবার উলটে গেছে। এবারের লোকসভা নির্বাচন এসব দলের সামনে নতুন রাস্তা খুলে দিয়েছে।
বিজেপি সূত্র ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, বিহারের জনতা দলের (জেডিইউ) নীতিশ কুমার, অন্ধ্র প্রদেশের তেলেগু দেশম পার্টির চন্দ্রবাবু নাইড়ু এখন বিজেপির ওপর চাপ তৈরি করতে শুরু করেছেন। লোকসভায় এই দুই দলের আসন রয়েছে যথাক্রমে ১২টি ও ১৬টি। দুই দল মিলিয়ে ২৮ আসন নিয়ে দুই নেতা এনডিএ জোট ছেড়ে দিলেই সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় আসন হারিয়ে ফেলবেন মোদি।
এ ছাড়া বিজারের লোক জনশক্তি পার্টির নেতা চিরাগ পাসওয়ানও বিজেপিকে চাপ দিতে শুরু করেছেন। বিহারের এই দলটির পাঁচটি আসন রয়েছে। এসব দলের নেতারা এখন মন্ত্রিসভায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো নিয়ে দর কষাকষি শুরু করেছেন বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে। কোনো কোনো সূত্র থেকে এমন খবরও মিলছে, নীতিশ কুমার উপপ্রধানমন্ত্রী কিংবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো পোর্টফোলিও দাবি করে বসেছেন। একই ধরনের দাবি রয়েছে চন্দ্রবাবু নাইড়ুরও।
এবারে লোকসভা নির্বাচনের আগে ২৮টি দল নিয়ে লড়াইয়ে নেমেছিল বিজেপি। তাদের মোট আসন সংখ্যা ২৯৩। এর মধ্য়ে বিজেপির ২৪০টি, যা ‘ম্য়াজিক ফিগার’ থেকে ৩২টি কম। নাইড়ুর তেলুগু দেশম পার্টি ও নীতিশের জেডিইউয়ের ২৮টি আসন বাদ দিলেই এই সংখ্যা নেমে আসবে ২৬৫টিতে। এই দুই দলেরই বিভিন্ন সময় কংগ্রেসের নেতৃত্বে বিরোধী জোটে থাকার নজির রয়েছে। জেডিইউ এর মধ্যে ‘ইন্ডিয়া’ জোটেও ছিল। ফলে ‘ইন্ডিয়া’ জোট তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে বলে প্রকাশ্য়েই জোটের নেতারা বলতে শুরু করেছেন। তবে এই দুই ‘ইন্ডিয়া’ জোটে যোগ দিলেও তাদের আসন হবে ২৬২টি। তখন কোনো পক্ষেরই আর সরকার গঠনের মতো সংখ্য়াগরিষ্ঠতা থাকবে না। সে ক্ষেত্রে উভয় জোটকেই বিরোধী জোটের অন্য কোনো দলকে ভাগিয়ে নিয়ে আসতে হবে।
আরও পড়ুন-
- ধীরে ধীরে ব্যবধান কমাচ্ছে ইন্ডিয়া ব্লক
- ‘বাঁচা-মরার লড়াই’য়ে টিকে গেল কংগ্রেস?
- নরেন্দ্র মোদি: বিভক্ত ভারত ইতিহাসের দ্বারপ্রান্তে
- একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েও ইতিহাস মোদি-বিজেপির
- ভারতের লোকসভা নির্বাচন: সরকার গঠনে ‘দাবার ঘুঁটি’ তারা
- সরকার গঠনের ঘোষণা মোদির, বললেন বিকশিত ভারতের জয়
- ‘৪০০ পার’ বহু দূর, বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতাই হুমকির মুখে
- কাজে আসেনি রাম মন্দির, অযোধ্যাসহ ইউপিতে হেরে গেছে বিজেপি
এদিকে ভোটের কিছুদিন আগে মহারাষ্ট্রে শিবসেনা দলে ফাটল ধরেছিল। শিবসেনার নেতা শিন্ডে দল ভেঙে একটি অংশকে নিয়ে বিজেপি শিবিরে যোগ দিয়েছিলেন। শিন্ডের শিবসেনা এখন এনডিএর অংশ। তাদের হাতে আছে সাতটি আসন। তবে শিবসেনা সূত্র জানাচ্ছে, শিন্ডের শিবির থেকে কোনো কোনো নেতা ফের উদ্ধবের দিকে ফিরে আসতে পারেন।
এছাড়া আছে চিরাগ পাসওয়ানের এলজেপি। রাম বিলাস পাসওয়ানের তৈরি এই দল বরাবরই ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। বিহারের এই দল এনডিএর অংশ। তাদের হাতে আছে পাঁচটি আসন। মাত্র পাঁচটি আসন নিয়েই তারা বড় মন্ত্রণালয়ের জন্য় বিজেপির ওপর চাপ তৈরি করতে শুরু করেছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে বিজেপির জন্য় সবচেয়ে সুবিধাজনক কৌশল হলো ইন্ডিয়া জোটে ভাঙন ধরানো। ইন্ডিয়ার বেশ কিছু নেতার সঙ্গে বিজেপি কথা বলার চেষ্টা করছে বলে জানা যাচ্ছে বিভিন্ন সূত্র থেকে। এ কারণে ভোট গণনার রাতেই জরুরি বৈঠকে বসেছিলেন ‘ইন্ডিয়া’ জোটের কয়েকজন নেতা। আজ বুধবার ফের তাদের বৈঠকে বসার কথা রয়েছে।
ইন্ডিয়া জোটের নেতারাই বলছেন, বিজেপি চেষ্টা করবে ইন্ডিয়া জোট ভেঙে এনডিএর আসন আরও বাড়িয়ে নিতে। সে ক্ষেত্রে এনডিএ থেকে কোনো দল বেরিয়ে গেলেও বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতে পারবে।
ভারতীয় সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি আসন পাওয়া দলকেই রাষ্ট্রপতি প্রথমে সরকার গড়তে আহ্বান জানান। এবারের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলও বলছে, রাষ্ট্রপতি বিজেপিকেই ডাকবেন সরকার গঠন করতে। কিন্তু একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় এবার বিজেপিকে জোটসঙ্গী নিয়ে অন্তত ২৭২ আসনের নিশ্চয়তা প্রমাণ করতে হবে। সেটি দেখাতে না পালেই সুযোগ হারাবে বিজেপি। তখন কংগ্রেসের সামনেও হয়তো সুযোগ আসবে। তেলুগু দেশম, জনতা দলের মতো আরও দুয়েকটি দল নিয়ে তারাও যে ২৭২ অঙ্কের হিসাব মেলানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখবে, তা বলাই বাহুল্য।
[ডয়েচে ভেলে দিল্লি ব্যুরোর স্যমন্তক ঘোষের বিশ্লেষণ অবলম্বনে]
সারাবাংলা/টিআর
ইন্ডিয়া জোট এনডিএ চন্দ্রবাবু নাইড়ু জাতীয়-নির্বাচন জোট সরকার নরেন্দ্র মোদি নীতিশ কুমার বিজেপি ভারত লোকসভা নির্বাচন সরকার গঠন