ব্যস্ততম আগ্রাবাদে প্রকাশ্যে চলছে অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপন
৫ জুন ২০২৪ ২০:০৮
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম নগরীর ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকা আগ্রাবাদ। এ এলাকার বাদামতলীর মোড়ে আক্তারুজ্জামান সেন্টারের সামনে গেলেই চোখে পড়ে একটি একটি ডিজিটাল বিলবোর্ড। বিলবোর্ডে প্রচার হচ্ছে ক্রিকেক্স.নিউজ (crickex.news) ও মোস্ট প্লে নিউজ (Most play news) নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন, যেখানে ঢুকলেই অনলাইন জুয়া খেলার জন্য প্রলুব্ধ করা হয়। একই বিলবোর্ডে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর ছবিসম্বলিত বিজ্ঞাপনও দেখা গেছে, যাতে মেয়রের কাজের প্রচার চালানো হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন দু’টিতেই ক্রিকেট খেলার বিভিন্ন সংবাদ পাওয়ার কথা থাকলেও সেখানে ঢুকলে কৌশলে অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপন দেখানো হয়। এসব ওয়েবসাইটে কীভাবে জুয়া খেলতে হয় ও অর্থ লেনদেন করতে হয় সেসব নিয়েও ভিডিও আছে। অন্যদিকে, নগরীর জিইসি মোড়ের ফ্লাইওভারের নিচে থাকা একটি ডিজিটাল বিলবোর্ডেও মঙ্গলবার (৪ জুন) পর্যন্ত এসব জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচার হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বুধবার (৫ মে) দুপুরে আগ্রাবাদ মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, বিশাল ডিজিটাল পর্দায় আলোর ঝলকানিতে প্রচার হচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর তিন বছর বর্ষপূর্তিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পণ্যর বিজ্ঞাপন। এর সঙ্গে ক্রিকএক্স.নিউজ ও মোস্টপ্লে নিউজের বিজ্ঞাপনও চলছে। প্রথম দেখায় এসব বিজ্ঞাপনে খেলার সংবাদ প্রচারিত হয় মনে করলেও কৌশলে এগুলো দিয়ে অনলাইন জুয়ার ওয়েবসাইটের প্রচার হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আগ্রাবাদের বিলবোর্ডটির কোনো বৈধতা নেই। চসিক মেয়রের বিজ্ঞাপন চললেও খোদ সংস্থাতাটিই জানে না এ বিলবোর্ডের মালিক কে বা কারা। চসিকের রাজস্ব কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আগ্রাবাদের আমাদের কোনো বিলবোর্ড নেই। সেখানে কে বা কারা বিলবোর্ড তুলেছে, চসিক এ বিষয়ে অবগত নয়। তবে জিইসি মোড়ে আমাদের একটি বিলবোর্ড আছে। সেটা ট্র্যাডম্যাক্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দেওয়া হয়েছে।’
বিলবোর্ডে অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপনের বিষয়ে অবগত আছে কিনা? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা তো এসব নিয়ে খবর রাখি না। তবে অনলাইন জুয়ার সাইটের বিজ্ঞাপন চালানো হচ্ছে বলে গতকাল (মঙ্গলবার) শুনেছি। যদি এ বিষয়ে আইনে কোনো নিষেধাজ্ঞা থাকে আমরা ব্যবস্থা নেব।’
আগ্রাবাদের বিলবোর্ডটি প্রকৃতপক্ষে কে বা কারা চালাচ্ছে- এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য মেলেনি। যেহেতু সেটি চসিকের অনুমোদিত নয়, এ বিষয়ে দালিলিক কোনো তথ্যপ্রমাণও নেই। তবে একাধিক সূত্রের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক মহিউদ্দিন বাচ্চুর সম্মতিতে তার অনুসারীরা বিলবোর্ডটি পরিচালনা করছেন।
চট্টগ্রাম মহানগরীতে একসময় বিলবোর্ডের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ছিল মহিউদ্দিন বাচ্চুসহ কয়েকজন যুবলীগ নেতার হাতে। জানতে চাইলে চট্টগ্রাম-১০ আসনের সংসদ সদস্য মহিউদ্দিন বাচ্চু সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি কি বিলবোর্ডের ব্যবসা করি? যে আমার নাম বলেছে তাকে জিজ্ঞাসা করুন, সে আমাকে কীভাবে চেনে? বিলবোর্ডে কিসের বিজ্ঞাপন হচ্ছে বা দিচ্ছে আমি এ বিষয়ে কোনোভাবে অবগত নই।’
অন্যদিকে, জিইসি মোড়ের বিলবোর্ডটি চসিকের অনুমোদন নিয়ে পরিচালনা করছিল ট্রেড ম্যাক্স নামে একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা।ট্রেড ম্যাক্সের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন নামে একজন।
মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘গতকাল (মঙ্গলবার) আমি অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জিইসি মোড়ের বিলবোর্ডের সব বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিয়েছি। যারা বিজ্ঞাপনদাতা তারা আমাকে বলেছেন এসব নাকি ঢাকায় চলছে। আমি স্পষ্ট তাদের জানিয়ে দিয়েছি, যা চলে চলুক, আমার এখানে কোনো অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপন চলবে না। আমি খুলেও দেখিনি। অভিযোগ যেহেতু এসেছে আমি বন্ধ করে দিয়েছি।’
চট্টগ্রামের এসব বিলবোর্ড ভাড়ায় নিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করছে এডপ্রো নামে একটি প্রতিষ্ঠান। এডপ্রো’র পরিচালক মাহমুদুল হাসানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথমে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পরে বিলবোর্ডে প্রকাশ্যে অনলাইন জুয়ার সাইটের প্রচারণা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানে বেটিংয়ের কিছু নেই। ঢাকায় তো এসব চলছে।’
সংবিধানের ১৮ (২) অনুচ্ছেদে নৈতিকতা রক্ষায় রাষ্ট্রের দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ১৮৬৭ সাল থেকে চালু প্রকাশ্য জুয়া আইন অনুসারে, কেউ টাকার বিনিময়ে বাজি বা জুয়ার আসর বসালে এবং কেউ তাতে অংশ নিলে তা হবে দণ্ডনীয় অপরাধ। সুতরাং সংবিধানের ১৮ (২) অনুচ্ছেদ এবং প্রচলিত আইন অনুসারে সব ধরনের জুয়া বাংলাদেশে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।
কিছুদিন আগে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ বাংলাদেশে সব ধরনের জুয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছিল। এর বাইরেও হাইকোর্টের আরেকটি বেঞ্চ ২০১৪ সালের ১৮ জুন জুয়াবিরোধী একটি রায় দেয়। তাতে বলা হয়, অর্থ দিয়ে সব খেলাই অবৈধ। ১৮৬৮ সালের আইনটি যুগোপযোগী করতে সরকার ‘জুয়া প্রতিরোধ আইন’ করার উদ্যোগ নিয়েছে। ২০২৩ সালে আইনের খসড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রণয়ন করলেও তা এখনও পাস হয়নি।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম) আবদুল মান্নান মিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। জিইসিতে যে ডিজিটাল বিলবোর্ড আছে, সেটা সিটি করপোরেশনের। তাদের সঙ্গে আমরা কথা বলব। বিজ্ঞাপনে যদি আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। আগ্রাবাদের বিষয়টি শুনিনি। সেখানেও আইনের ব্যত্যয় হলে আমরা দেখব। সব খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
ছবি: শ্যামল নন্দী, স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট
সারাবাংলা/আইসি/পিটিএম