Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

১৭ হাজার কর্মীর সামনে ‘অন্ধকার পথ’

ঝর্ণা রায়, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৭ জুন ২০২৪ ২২:৫৩

ঢাকা: নিয়োগ পেয়েছেন, ভিসাও হয়েছে, এখন কেবল কর্মস্থলে পৌঁছানো বাকি। কিন্তু প্লেনের টিকিট না পাওয়ায় হলোনা স্বপ্নযাত্রা। স্বপ্নযাত্রার আশায় থাকা ১৬ হাজার ৯৭০ জন কর্মীর মালয়েশিয়ায় যাওয়া এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অপেক্ষায় থাকা এ সব কর্মীর কেউ কেউ টাকার ব্যবস্থা করেছেন নিজের শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে, আবার কেউ নিয়েছেন চড়া সুদে ঋণ। তাদের সামনে এখন কেবল অন্ধকার পথ।

তারা বলছেন, মালয়েশিয়া যেতে না পারলে আমরা নিঃস্ব হয়ে যাব। বেঁচে থাকার মতো কোনো পরিস্থিতি থাকবে না। ভিসাপ্রাপ্ত কর্মীরা যেন কাজে যোগ দিতে পারেন, সে জন্য প্রবাসী কল্যাণ ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় মালয়েশিয়া সরকারকে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিলেও দেশটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে ‘বিষয়টি সম্ভব নয়।’ ফলে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে ১৭ হাজার কর্মীর মালয়েশিয়া যাত্রা।

জনশক্তি রফতানির দিক থেকে বাংলাদেশের অন্যতম বড় শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে ১৯৭৬ সাল থেকে কর্মী পাঠায় বাংলাদেশ। সেই থেকে চলতি বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত মোট ১৫ লাখ ৩ হাজার ৭২৭ জন কর্মী পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। এরমধ্যে ২০২৩ সালে পাঠায় ৩ লাখ ৫১ হাজার ৬৮৩ জন, ২০২২ সালে পাঠায় ৫০ হাজার ৯০ জন, আর করোনাকালীন সবচেয়ে কম মাত্র ২৮ জন পাঠাতে পেরেছে।

এর আগে, ২০১৮ সালে ১ লাখ ৭৫ হাজার ৯২৭ জন, এর দশ বছর আগে ২০০৮ সালে ১ লাখ ৩১ হাজার ৭৬২ জন পাঠিয়েছিল বাংলাদেশ। ২০০৭ সালে পাঠানো হয় ২ লাখ ৭৩ হাজার ২০১ জন উল্লেখযোগ্য কর্মী পাঠানো হয়। কিন্তু অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয়, বারবার দুর্নীতি আর কর্মী পাঠাতে সিন্ডিকেটের কারণে দফায় দফায় বন্ধ হয়ে গেছে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ এই শ্রমবাজার। বেসরকারি জনশক্তি রফতানিবারকদের ছাড়াও অভিবাসন ব্যয় কমাতে কখনো জি টু জি, কখনো বি টু বি পদ্ধতি চালু করেও বাজারটি সচল রাখা যায়নি। এরপর টানা সাড়ে তিন বছর বন্ধ থাকার পর নানা বৈঠক আর দেন দরবার শেষে গত বছর থেকে বাংলাদেশ থেকে ফের কর্মী নেওয়া শুরু করে মালয়েশিয়া সরকার। কিন্তু এরমধ্যে বাংলাদেশসহ থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, নেপাল, মিয়ানমার, লাওস, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান, ভারত ও ইন্দোনেশিয়া এই ১৫ দেশ থেকে কর্মী নেওয়া হবে না বলে মার্চে একটি সিদ্ধান্ত জানায় মালয়েশিয়া সরকার। ৩১ মে পর্যন্ত এ সব দেশের কর্মীদের সময় দেওয়া হয়। পাশাপাশি বাংলাদেশসহ ১৫টি দেশের সঙ্গে এ সংক্রান্ত সমঝোতা চুক্তি পুনরায় করার সিদ্ধান্তও জানিয়ে দেওয়া হয়। কর্মী নেওয়ার বিষয়ে পূর্ব ঘোষণা থাকা সত্তেও বাংলাদেশের প্রায় ১৭ হাজার কর্মী সব প্রক্রিয়া শেষ করেও যেতে পারেনি।

ভিসা প্রক্রিয়া শেষ করেও মালয়েশিয়া যেতে না পারা পটুয়াখালীর কমলাপুর ইউনিয়নের কবীর আহমেদের সঙ্গে কথা হয়। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘নিঃস্ব হয়ে গেছি। কিছু নেই অবশিষ্ট। নিজের জমি বিক্রি করেছি, ঋণও নিয়েছি। ভিসা হয়েছে, নিয়োগপত্রও পেয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘এজেন্সির লোক আমাদের দুই দিন আগে জানিয়েছে, ৩১ মে এর পর যেতে পারব না। আমরা তড়িঘড়ি করে বিমানবন্দরে আসি। এজেন্সির লোক সব পালিয়েছে, কাউকে পাইনি।’

মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছুক কুমিল্লার আলমগীর বলেন, ‘এয়ারপোর্টে এসে দেখি হাজার হাজার মানুষ। সবাই অস্থির। শুনি, বিমানের টিকিট নেই। যে টিকিট আছে তার দাম তিন গুণ চার গুণ। আমি আর আমার ছোট ভাই দুইজনেরই যাওয়ার কথা। এখন কীভাবে চলব? কীভাবে ঋণ পরিশোধ করব?’

বেসরকারি জনশক্তি রফতানিকারদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘মালয়েশিয়া মার্চ মাসে তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে। সেটি নানাভাবে প্রচার করা হয়েছে। তারপরেও যদি কর্মীদের টনক না নড়ে তাহলে করার কী আছে?’

তিনি বলেন, ‘যারা যেতে পারেননি তাদের যাওয়ার সুযোগ নেই। মালয়েশিয়া সরকার নিষেধাজ্ঞা ‍তুলে না নিলে কিছু করার নেই।’

তিনি বলেন, ‘কোনো এজেন্সি যদি টাকা নিয়ে কর্মী না পাঠায় তাহলে তার কী লাভ? নিজে কেন ঝামেলা মাথায় নেবে? এখানে কর্মীদের ভুল তথ্য দিয়ে বিমানবন্দরে কোনো চক্র এই খাতকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছে।’

তিনি বলেন, ‘জানতে পেরেছি, সরকার বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে।

মালয়েশিয়ায় ধীরে ধীরে কর্মী যাওয়ার সংখ্যা বাড়ছিল। সেই সঙ্গে প্রবাসী আয়ও ধারাবাহিকভাবে বাড়তে দেখা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিগত ২০২০-২১ অর্থবছরে মালয়েশিয়া থেকে প্রবাসী আয় ছিল ১০২ কোটি ডলার, যা ১১২ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। আর চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে দেশটি থেকে রেমিট্যান্স আসে ১২২ কোটি ডলার। যে সময়ে বিদেশি মুদ্রার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, ঠিক সে সময়ে বড় এই শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা।

অভিবাসন ও শরণার্থী বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনির বলেন, ‘মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানি নিয়ে বেশ জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ১ জুন থেকে বিদেশি কর্মীদের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে একটি আন্তর্জাতিক পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল। ফলে দেশটিতে সর্বশেষ সুযোগ হিসেবে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো বিপুল সংখ্যক শ্রমিক পাঠানোর চেষ্টা চালিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিমানবন্দরে শ্রমিকদের বিশাল জটলা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘সংবাদমাধ্যমের খবর অনুসারে, বৈধ কাগজপত্র থাকার পরও বিমানের টিকিট না পাওয়ায় ১৭ হাজার কিংবা ততোধিক অভিবাসনপ্রত্যাশী মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি, যদিও প্রথমদিকে আমরা সংখ্যাটা ৩০ হাজারের মতো বলে শুনেছিলাম। বাংলাদেশি জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) পক্ষ থেকে এ সংখ্যা চার সহস্রাধিক বলে বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। সংখ্যা যা- ই হোক, এ পরিস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। শুধু তাই নয়, সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী সমাধান না হলে তা সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে খারাপ পরিস্থিতি তৈরি করবে।’

এদিকে এই পরিস্থিতি কেন হয়েছে তার কারণ খুঁজতে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নূর মো. মাহবুবুল হককে প্রধান করে ৬ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী ৭ কর্ম দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে জাতীয় সংসদ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন।

বুধবার (৫ জুন) জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ মুজিবুল হক চুন্নুর সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কর্মসংস্থানের জন্য যাওয়া স্বাভাবিক বিষয়। অনেকেই গিয়ে থাকেন।’

বৈদেশিক কর্মসংস্থানে সরকার সহযোগিতার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কিছু লোক দালালের মাধ্যমে করে, দালালের মাধ্যমে যেতে চায়। যেতে গিয়ে সমস্যায় পড়ে যান। এতে সমস্যা তৈরি হয়।’

বিষয়টি অনুসন্ধানের কথা জানিয়ে তিনি দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন।

এর আগে, বুধবার দুপুরে নিজ মন্ত্রণালয়ে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেছেন, মালয়েশিয়া যেতে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পরও ১৬ হাজার ৯৭০ জন কর্মী ৩১ মে’র মধ্যে দেশটিতে প্রবেশ করতে পারেননি। এ সব কর্মীকে প্রবেশের সুযোগ দিতে মালয়েশিয়া সরকারকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। তবে মালয়েশিয়া সরকার এই সময় আর বাড়াবে না বলে মঙ্গলবার (৪ জুন) জানিয়ে দিয়েছেন দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাইফুদ্দিন নাসুশন ইসমাইল।

প্রতিমন্ত্রী তখন আরও জানান, শ্রমিকরা কেন মালয়েশিয়া যেতে পারেননি তা তদন্ত কমিটি নির্ধারণ করবে। যাদের বিএমইটি কার্ড বা ই-ভিসা আছে, তারা যেন ক্ষতিপূরণ পান, তার ব্যবস্থা করা হবে।

অন্যদিকে ঢাকায় নিযুক্ত মালয়েশিয়ার হাইকমিশনার হাজনাহ মো. হাশিম বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী কল্যাণ প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে এক বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তার সরকার সময়সীমা মেনেই কাজ করছে। এই সময়সীমা শুধু বাংলাদেশ নয়, কর্মী গ্রহণ করা আরও ১৪টি দেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

সারাবাংলা/জেআর/একে

নিয়োগপত্র ভিসা মালয়েশিয়া মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

৯০০তম গোলে ইতিহাস গড়লেন রোনালদো
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৯:০৪

সম্পর্কিত খবর