Friday 06 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘শুধু আন্তরিক হোন, রোগী বিদেশ যাবে না’

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৮ জুন ২০২৪ ১৪:৩২

চট্টগ্রাম ব্যুরো : চিকিৎসা ব্যবস্থায় নৈতিকতার চর্চা ও চিকিৎসক-রোগীর সম্পর্ক বিষয়ে এক সেমিনারে বক্তারা বলেছেন, সমাজের সর্বক্ষেত্রে বিরাজমান অস্থিরতা ও দুর্নীতির প্রভাব পড়েছে চিকিৎসা ব্যবস্থায়ও। চিকিৎসা খাতও দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে গেছে। মেধা-যোগ্যতায় কোনোক্ষেত্রে বিদেশের চিকিৎসকদের চেয়ে বাংলাদেশের চিকিৎসকেরা পিছিয়ে নেই। শুধুমাত্র আন্তরিকতা, নৈতিকতার চর্চা ও সহনশীল আচরণের অভাবে রোগীর বিদেশযাত্রা ঠেকানো যাচ্ছে না।

শুক্রবার (৭ জুন) রাতে নগরীর ও আর নিজাম রোডে হোটেল ওয়েল পার্কে এ সেমিনারের আয়োজন করে চিকিৎসকদের সংগঠন ‘ডক্টরস ফর হেলথ এন্ড এনভায়রনমেন্ট, চট্টগ্রাম’।

বিজ্ঞাপন

সংগঠনের জেলা সভাপতিত্বে ডা. চন্দন দাশের সভাপতিত্বে সেমিনারের শুরুতে ‘মেডিকেল ইথিকস এন্ড ডক্টর-পেশেন্ট রিলেশনশিপ’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন ডা. নন্দন কুমার মজুমদার। এতে প্যানেল আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন, এনেস্থেশিয়া (অবেদন) বিশেষজ্ঞ ডা. দুলাল দাস ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এস সি ধর।

ডা. দুলাল দাস বলেন, ‘পৃথিবী অস্থির, দেশ অস্থির, সমাজ অস্থির। অস্থিরতার প্রভাব থেকে চিকিৎসা ব্যবস্থা মুক্ত থাকবে, এটা আশা করা বোকামি। স্বাভাবিকভাবেই অস্থিরতার প্রভাব চিকিৎসকদের মধ্যেও পড়েছে। ৫৪ বছরের প্র্যাকটিসিং লাইফে কোনোদিন এমন দুর্নীতিপরায়ণ চিকিৎসা ব্যবস্থা আমি দেখিনি।’

‘রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। ডাক্তাররা এখন ব্রোকার (দালাল) পোষেন, ব্রোকারদের কাছ থেকে রোগী নেন, তারপর ১০ হাজার টাকার পরীক্ষা দেন আর কমিশন খান, তাহলে সুচিকিৎসা হবে কিভাবে? বড় বড় ডাক্তার, উনার নম্বর নেয়ার জন্য তার স্টাফকে ১০০ টাকা দিতে হয়। কোনো হাসপাতাল-ক্লিনিকে কোনো সিস্টেম নেই। ব্রোকারনির্ভর ডাক্তার, এমনও দেখা যায়, সার্জনের চেয়ে ব্রোকারের ফি বেশি।’

রোগীর বিদেশযাত্রা ঠেকানোর তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, ‘অনেকে বলেন, আমরাও বলি, চিকিৎসা না পেয়ে রোগীরা বিদেশে চলে যাচ্ছেন। এটা সত্য নয়। আমাদের মেধা-যোগ্যতা কোনো অংশে বিদেশের ডাক্তারদের চেয়ে কম নয়। ওরা যা পড়েছে, আমরাও তা পড়েছি। হয়তো আমাদের লজিস্টিকস কম থাকতে পারে। কিন্তু রোগী চিকিৎসা পাচ্ছে না, এমন নয়। আমি রোগীদের অনেককে জিজ্ঞেস করেছি। তারা বলছে- ডাক্তার কথা বলে না, জিজ্ঞেস করলেও বলে না, শুধু স্লিপের পর স্লিপ লিখে দেয়।’

৮২ বছর বয়সী এ প্রবীণ চিকিৎসক বলেন, ‘তাহলে এ অবস্থা কী চলতেই থাকবে ? না, শুদ্ধতার চর্চা আমাদেরকেই শুরু করতে হবে, আমাদের নিজেদের শুদ্ধ হতে হবে। নৈতিকতার চর্চা আমাদের করতে হবে। রোগীর সঙ্গে কথা না বলে শুধু স্লিপ লিখে দেয়ার সংস্কৃতি থেকে বের হতে হবে। আরেকটু সহনশীল হয়ে চিকিৎসা দেন, তাহলে রোগী আপনাকে ছেড়ে বিদেশে যাবে না। রোগীকে বোঝাতে হবে, ভালো আচরণ করতে হবে। সিনসিয়ার হোন, তাহলে রোগী আপনাকে মারতে আসবে না, ক্লিনিক ভাঙতে আসবে না।’

হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এস সি ধর বলেন, ‘জলবায়ূ পরিবর্তনের সঙ্গে আমাদের মানুসের নৈতিকতা-অনৈতিকতায়ও পরিবর্তন হয়েছে। মাথায় পচন ধরেছে, সেটার চিকিৎসা না করে শুধুমাত্র পেশা ধরে ধরে ব্যক্তি মানুষকে ইথিকস মানানোর চেষ্টা করা হলে এটা হাস্যকর হবে। চিকিৎসকদের সম্পর্কে বদনামগুলো যদি দূর করতে হয়, তাহলে আগে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। এ সমস্যা শুধুমাত্র চিকিৎসকের সমস্যা, এটা ভাবলে ভুল হবে।’

চিকিৎসকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘একজন ডাক্তারের কাছে রোগীর অনেক জিজ্ঞাসা থাকে, তাকে সেগুলোর জবাব দেয়া আপনার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আপনি যদি মনে করেন, আপনার পক্ষে তার চিকিৎসা সম্ভব নয়, তাহলে ছেড়ে দেন, অন্য কোনো ডাক্তারের কাছে পাঠান, কিন্তু তাকে ধরে রেখে বদনামের ভাগীদার হবেন না। একজন রোগী যখন আপনার কাছে আসবে, তাকে আগে অবজার্ভ করেন। শুধুমাত্র তার রোগ অবজার্ভ নয়, ফিজিক্যালি, মেন্টালি, তার ইকোনমিক্ কন্ডিশন অবজার্ভ করতে হবে। আপনি প্রয়োজন ছাড়া তাকে ৮টা-১০টা পরীক্ষা লিখে দিলেন, সক্ষমতা আছে কি না তো দেখতে হবে। সক্ষমতা থাকলেও সে অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা করবে কেন ?’

এস সি ধর আরও বলেন, ‘একজন চিকিৎসকের আচরণ হতে হবে ইক্যুয়েল। রোগী মন্ত্রীর ছেলে না কি রিকশাওয়ালার ছেলে, সে হিন্দু না কি মুসলিম, ধনী না কি গরীব- এটা দেখা আপনার দায়িত্ব নয়। সে আপনার রোগী, শুধু এটা মাথায় রেখে চিকিৎসা দিতে হবে। বিত্তশালী কাউকে আপনি খুব মনযোগ দিয়ে চিকিৎসা দিলেন, গরীব পেশেন্টকে আপনি অবহেলা করলেন, এটা নয়, ইক্যুয়েল হতে হবে।’

সভাপতির বক্তব্যে ডা. চন্দন দাশ বলেন, ‘আসলে সংকটটা রাষ্ট্রে, আমাদের সমাজে। এর প্রভাবে আমাদের মূল্যবোধে, মননে সংকট তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় নানা অজুহাতে চিকিৎসকদের হয়রানি করা হচ্ছে। সেটা মোকাবেলায় সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। সেই আইন প্রণয়নের জন্য আমরা আন্দোলন করে যাচ্ছি। আজকের পৃথিবীতে সবকিছুকেই পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। স্বাস্থ্যকেও পণ্যের জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছে। আমরা মানুষের মৌলিক চাহিদা, মৌলিক অধিকারগুলোকে পণ্যের ধারণা থেকে বের করে আনতে কাজ করছি।’

সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ডা. আরিফ উদ্দিন আহমেদের সঞ্চালনায় সেমিনারে মুক্ত আলোচনা পর্বে অংশ নেন, কথাসাহিত্যিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী, কবি ও সাংবাদিক কামরুল হাসান বাদল, ডা. বিপ্লব ভট্টাচার্য, বাংলাদেশ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির মহাসচিব মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, নারীনেত্রী লতিফা কবির, ডা. দিলীপ দে, ডা. পূর্ণেন্দু বিকাশ সাহা, আইনজীবী জহীর উদ্দীন মাহমুদ ও নাসির উদ্দিন।

কামরুল হাসান বাদল বলেন, ‘আমরা সবাই অস্থিরতায় আক্রান্ত। কেউ কারও কথা শুনতে চাচ্ছি না, শোনার আগ্রহ নেই, শোনাতে আগ্রহী সবাই। ডাক্তাররা এমন, আইনজীবীরা এমন, সাংবাদিকরা এমন- এভাবে টার্গেট করে বলার সুযোগ নেই। অনেকে ডাক্তারদের কসাই বলেন, মানসিক অস্থিরতা কোন পর্যায়ে গেলে এমন কথা মানুষ বলতে পারেন, এটা তার একটা বাস্তব উদাহরণ। এর থেকে বের হতে হলে সমাজে মানবিকতা, উদারতা ও সংস্কৃতির চর্চা বাড়াতে হবে।’

বিশ্বজিৎ চৌধুরী বলেন, ‘সামাজিক অস্থিরতার প্রভাব শুধু চিকিৎসকদের মধ্যে পড়েছে এমন নয়, রোগীদের মধ্যেও পড়েছে। চিকিৎসক এবং রোগীর মধ্যে আস্থার একটা সংকট তৈরি হয়েছে। আগে যে বলা হতো- ডাক্তার মানে ঈশ্বরের পরে, সেই ধারণা আর নেই। ডাক্তারের কাছে গিয়েও রোগী কিংবা তাদের স্বজনরা জিততে চান। এর ফলে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে রোগী কিংবা স্বজনদের চড়াও হওয়া, বিভিন্ন অভিযোগ তোলা এসব ঘটনা ঘটে। এসবের অবসান হওয়া দরকার। একজন চিকিৎসকের ভূমিকা হচ্ছে রোগীর স্বজনদের প্রাসঙ্গিক বিষয় জানানো। আর রোগী কিংবা রোগীর স্বজনদের উচিৎ অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে প্রশ্ন না করা।’

ডা. বিপ্লব ভট্টাচার্য বলেন, ‘মেডিকেলে একজন রোগীকে আমি মনপ্রাণ দিয়ে চিকিৎসা করলাম, যাবার সময় তিনি বললেন, ডাক্তার আমাকে একটা বেড পর্যন্ত দিল না, আমাকে ফ্লোরে শুয়ে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। রোগী মনে করেন তাকে বেড দেয়ার মালিক ডাক্তার। সমাজের মানুষের এমন ধারণার মধ্যে ইথিকসের চর্চা কঠিন। ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু- এ চারটা শব্দ জেনেই অনেকে চিকিৎসা সাংবাদিকতা শুরু করে দিচ্ছেন। ডাক্তার সম্পর্কে নেতিবাচক তথ্য ছড়ানোই যেন সংবাদপত্রের একমাত্র কাজ। আমি পড়ালেখা শেষ করে বিসিএস পাস করলাম, সার্ভিস ট্রেনিং ছাড়াই আমাকে পাঠিয়ে দিচ্ছে গ্রামগঞ্জে।’

মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, ‘আমরা খারাপ কাজের নিন্দা করতে ভুলে গেছি। খারাপ লোকের প্রশংসায় মশগুল থাকি। এর ফলে সমাজে নৈতিকতা-অনৈতিকতার চর্চাটা, শৃঙ্খলাটা ভেঙ্গে গেছে। আমরা মারাত্মক অবক্ষয়ের জায়গায় চলে এসেছি। সকল ইনস্টিটিউশন আজ ধ্বংসের মুখোমুখি। সেগুলো আমরা রক্ষা করতে পারছি না। নীতিবিদ্যাই তো আমরা শিখাচ্ছি না। ধর্মের সঙ্গে নীতিবিদ্যা যোগ করে দেয়া হয়েছে। ধর্ম দিয়ে নীতিবোধের শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। অথচ ধর্ম এক বিষয়, নীতিবিদ্যা আরেক বিষয়।’

সারাবাংলা/আরডি/এনইউ

চট্টগ্রাম টপ নিউজ ডক্টরস ফর হেলথ এন্ড এনভায়রনমেন্ট