‘আমার ঠাঁই-ঠিকানা হবে, কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবিনি’
১১ জুন ২০২৪ ১৭:৫৫
লালমনিরহাট থেকে: ফজলে করিমের বয়স ৮৪ বছর। জন্মের পর জন্মের পর বাবার ভিটা বাড়ি দেখলেও পরে জেনেছেন এগুলো সব সরকারের খাস জমি। সেগুলো আর কখনো নিজের করতে পারেননি। ১৯৮০ সালের পর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পে অনেকে ঘর পেলেও ঘর পাননি ফজলে করিম। নিজের জমি ও বাড়ি না থাকায় অনেক কষ্ট করেছেন। তবে এসব এখন অতীত। এখন নিজের নামে তার দুই শতক জমিতে বাড়ি আছে। জীবনের সায়াহ্নে এসে নিজের জমি আর ঘর হয়েছে তাতেই বেজায় খুশি তিনি।
ফজলে করিম সারাবাংলাকে বলেন, আমার ঠাঁই-ঠিকানা হবে। এটা কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য আমার অনেক অনেক দোয়া।
তিনি বলেন, নিজের নামে একটা ঘর আছে, জায়গা আছে এর চেয়ে শান্তি এখন কিছু নেই। এখন তিনি রাজমিস্ত্রির জোগালের কাজ করেন বলে জানান।
মর্জিনা বেগম নামের এক উপকারভোগী বলেন, আমার নিজের কোনো ঘর ছিল না। ১৫ বছর আগে স্বামী মারা যায়। খুব কষ্টে দিন পার করেছি। দুই ছেলের এক ছেলেও আমার কাছে থাকে না। শেষ বয়সে এসে নিজের নামে একটা বাড়ি পেয়ে এখন বুকে সাহস পাচ্ছি, এখন আমার আর কোনো চিন্তা নাই।
আরেক উপকারভোগী সুলতান মিয়া। তিনি এখন ঘর পেয়ে তিনটা ছাগল আর একটা গরু পালন করেছেন। সুলতান বলেন, আমার এখন নিজের নামে জায়গা হয়েছে। এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে।
অনেকেই আবার ভিন্ন ভিন্ন এলাকা থেকে আশ্রয় নিয়েছেন এই প্রকল্পে। তিস্তায় বিলীন হয়ে গেছে মজিদা বেগমের আগের ভিটা বাড়ি। এবার রোজার ঈদের সময় এখানে দুই শতক জায়গার ওপর বাড়ি পেয়েছেন।
এর আগে একটা সময় অন্যের জমিতে দয়া-দাক্ষিণায় থাকা মজিদা বেগম বলেন, আগে যেখানে ছিলেন সেই চর নদীতে বিলীন হয়েছে। এখন নিজের জমি ও বাড়ি হয়েছে। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, এটা এখনো আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।
আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের অধীনে ৫ম পর্যায়ের ২য় ধাপে মঙ্গলবার (১১ জুন) সারাদেশে ১৮ হাজার ৫৬৬টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে জমি ও গৃহ হস্তান্তর করেন প্রধানমন্ত্রী। এদিন সকাল ১১টায় গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কার্যক্রমের ভার্চুয়াল উদ্বোধন করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী তিনটি উপজেলার (লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ, কক্সবাজার জেলার ঈদগাঁও এবং ভোলা জেলার চরফ্যাশন) সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত হন। গণভবন প্রান্তে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া।
পুনর্বাসিত পরিবারগুলোর জন্য বিনামূল্যে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে এবং প্রকল্পের জায়গায় নিরাপদ পানির জন্য নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। প্রার্থনা ঘর এবং কবরস্থান, পুকুর এবং অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের জন্য রাস্তা দিয়ে আবাসন প্রকল্পগুলোকে সহজতর করা হয়েছে।
লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার মহিষামুড়ি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, গৃহহীন ফজলে করিমের মত আরও অনেকেই ঘর পেয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন। তাদের স্বপ্ন এখন শুধু ঘরেই সীমাবদ্ধ নেই। রঙিন টিন আর পাকা দেয়ালের আধাপাকা বাড়িতে কেউবা করছে হাঁস-মুরগি, ছাগল ও গরু পালন। সন্তানদের পাঠাচ্ছে স্কুলে। বাড়িকে কেন্দ্র করে তার চারপাশে গড়ে তুলেছেন সবজি বাগান, কেউ কেউ দিয়েছেন ছোট দোকান, অনেকেই করছেন কৃষি কাজ।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন নোয়াখালী বর্তমান লক্ষীপুর জেলার রামগতি উপজেলার চরপোড়াগাছা গ্রামে ভূমিহীন-গৃহহীন, অসহায় ছিন্নমূল মানুষের পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু হয়। তার ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ১১ জুন, আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের অধীনে পপঞ্চম পর্যায়ের দ্বিতীয় ধাপে ১৮ হাজার ৫৬৬টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে জমি ও গৃহ হস্তান্তর অনুষ্ঠান গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভার্চুয়াল উদ্বোধন করেন।
জানা যায়, আশ্রয়ণ প্রকল্প এবং অন্যান্য কার্যক্রম দ্বারা গৃহ প্রদানের মাধ্যমে এ পর্যন্ত ৪৩ লাখ ৪০ হাজার ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষ পুনর্বাসিত হয়েছেন। শুধু আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে পুনর্বাসিত হয়েছেন ২৯ লাখ ১০ হাজার ২৬৫ জন মানুষ।
এ পর্যায়ে ভূমিহীন-গৃহহীনমুক্ত হতে যাচ্ছে ঢাকা, গোপালগঞ্জ, শরিয়তপুর, ফরিদপুর, নেত্রকোণা, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ফেনী, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, নীলফামারী, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, সাতক্ষীরা, যশোর, খুলনা, নড়াইল, বাগেরহাট, বরগুনা, বরিশাল, হবিগঞ্জও সুনামগঞ্জ-জেলার সকল উপজেলাসহ মোট ৭০টি উপজেলা। এ হিসাবে পূর্বে ঘোষিত জেলা-উপজেলাসহ মোট ৫৮টি জেলা ও ৪৬৪টি উপজেলা ভূমিহীন-গৃহহীনমুক্ত হচ্ছে।
উল্লেখ্য, শুধু মুজিববর্ষের বিশেষ কর্মসূচির দ্বারা পুনর্বাসিত: ১৩ লাখ ৩০ হাজার ৬০ জন ছিন্নমূল মানুষ, গৃহের সংখ্যা: ২ লাখ ৬৬ হাজার ১২টি। সারাদেশে উদ্ধারকৃত খাস জমির হালনাগাদ পরিমাণঃ ছয় হাজার ৯৪৫ একর। উদ্ধারকৃত খাস জমির আনুমানিক স্থানীয় বাজার মূল্য তিন হাজার ৮৮৩ কোটি টাকা। সারাদেশে ক্রয়কৃত জমির হালনাগাদ পরিমাণ ৩৭১ দশমিক ১০ একর। জমি ক্রয় বাবদ হালনাগাদ বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ ২৫৫ কোটি ৯৯ লাখ টাকা।
স্থানীয় কালীগঞ্জ থানার উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) জহির ইমাম বলেন, কালীগঞ্জ উপজেলাকে ভূমিহীন এবং গৃহহীন মুক্ত উপজেলা হিসেবে ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, শুধুমাত্র ঘর উপহার দিয়েই সীমাবদ্ধ থাকা হয়নি বরং তাদের জীবন-জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রশিক্ষণমূলক বিভিন্ন কর্মসূচিও হাতে নেওয়া হয়েছে। তাদের দুই শতাংশ জমি দলিলের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়ে তারমধ্যে সবজি চাষের মাধ্যমে স্বনির্ভরতা অর্জনের বিষয়ে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
সারাবাংলা/ইউজে/এনইউ
১৮ হাজার ৫৬৬ ২য় ধাপ ৫ম পর্যায় আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প জমি-গৃহ পরিবার ভূমিহীন-গৃহহীন হস্তান্তর প্রধানমন্ত্রী