চন্দ্রবোড়া সাপের আতঙ্কে মানিকগঞ্জের চরাঞ্চলবাসী
১৪ জুন ২০২৪ ১৫:২২
মানিকগঞ্জ: মানিকগঞ্জের হরিরামপুরে পদ্মার তীরবর্তী চরাঞ্চলে চন্দ্রবোড়া সাপের উপদ্রব বেড়েছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, গত তিন মাসে কম করে হলেও ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। এতে চরম আতঙ্কিত তারা।
এদিকে, বর্ষার পানি আসতে শুরু করায় আতঙ্কের মাত্রা আরও বেড়ে গেছে দুর্গম চরের আজিমনগর, লেছরাগঞ্জ ও সুতালড়ি ইউনিয়নের ভগবানচর, এনায়েতপুর, বসন্তপুর, হাতিঘাটা, সালিপুর, কবিরপুর, ছিলামপুর,পাগলের বাজার, ফাকেরহাট মজিদ খার হাট, কাজীকান্দা, পাটগ্রামমহ বেশ কয়েকটি এলাকার প্রায় অর্ধ লক্ষ মানুষের।
একের পর এক বিষাক্ত এ সাপের দেখা মিলছে উপজেলার চরাঞ্চলের পদ্মা নদী তীরবর্তী বিভিন্ন এলাকায়।
এই চরাঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষই কৃষির উপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে ভুট্টা ও বিভিন্ন প্রজাতির ধানের আবাদ বেশি হয়। কিন্তু চন্দ্রবোড়া সাপের উপদ্রব বেড়ে যাওয়ায় ভয়ে ফসল কাটতে মাঠে যাচ্ছেন না অনেক কৃষক। চরাঞ্চলের এই মানুষজন পদ্মায় মাছ শিকার ও গবাদি পশু পালন করে জীবিকা নির্বাহ করেন কিন্তু সাপের কামড়ে একের পর এক মৃত্যুর খবরে ভয়ে অনেকেই মাছ শিকার করতে যাচ্ছেন না। গবাদি পশুর খাবারও সংগ্রহ করতে পারছেন না।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, বিষধর এই সাপটা চরাঞ্চলে এখন মূর্তিমান আতঙ্ক। ভয়ে মানুষ ঘর থেকে বের হতে চায় না। ক্ষেত খামারে যাওয়াতো দূরে থাক। চরের শিশুরা মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতো। কিন্ত এখন চারিদিকে চন্দ্রবোড়া সাপের আতঙ্ক।
পাট গ্রামের মামুন মিয়া বলেন, চন্দ্রবোড়া সাপের আতঙ্কে ছেলে মেয়েদের স্কুলে পাঠাতেও ভয় লাগে। কারণ চরের রাস্তার দুই পাশে জঙ্গল পেরিয়েই তাদের স্কুলে যেতে হয়। ওরা যতক্ষণ পর্যন্ত বাড়িতে না ফেরে ততক্ষণ আতঙ্কে সময় কাটে।
পদ্মার পাড়ের হরিনা ঘাট চরের চায়ের দোকানদার আক্তার হোসেন বলেন, সাত বছর ধরে এখানে দোকান করি। অনেক সাপে কাটা রোগী আমার দোকানের সামনে দিয়ে মেডিকেলে নিয়ে যেতে দেখেছি। কিন্তু বেশির ভাগই বেঁচে ফিরে আসেনি। চন্দ্রবোড়া নামের সাপটি কয়েক মাস ধরে আমাদের এলাকায় দেখা দিয়েছে। খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হয়। সাপের ভয়ে সন্ধ্যার আগেই দোকান বন্ধ করে বাড়ি চলে যাই।
চন্দ্রবোড়া সাপের কামড়ে মারা যাওয়া লাল মিয়ার পরিবারের সদস্যরা জানান, ভুট্টা খেতে পানি দেওয়ার সময় লাল মিয়াকে চন্দ্রবোড়া সাপে কামড় দেয়। এরপর ক্ষতস্থান বেঁধে দ্রুত ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পাঁচ দিন পর লাল মিয়া মারা যান।
কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, চরের মাঝ দিয়ে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে তাদের স্কুলে যেতে হয়। চন্দ্রবোড়া সাপের উপদ্রব বেড়ে যাওয়ায় তারা খুবই চিন্তিত ও ভয়ে আছে।
হরিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মেহেরুবা পান্না বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে চন্দ্রবোড়া সাপের উপদ্রব বেড়ে গেছে। সাপটি দংশনের সময় সর্বোচ্চ পরিমাণে বিষ ঢেলে দেয়। তাই দ্রুততম সময়ে চিকিৎসা নিতে না পারলে প্রাণহানির ঝুঁকি বাড়ে।
তিনি বলেন, গ্রাম অঞ্চলে বেশিরভাগ মানুষ সাপে কাটা রোগীদেরকে ওঝার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। আসলে সেখানে যে সময়টা নষ্ট হচ্ছে সেটা কিন্তু রোগীর লোকজন বুঝে উঠতে পারছে না। পরে সেই সময়টা নষ্ট করে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনা হচ্ছে। ততক্ষণে রোগীর অবস্থা বেশি খারাপ হয়ে যায়।
ডা. মেহেরুবা পান্না বলেন, চন্দ্রবোড়া সাপ খুবই বিষধর। এর বিষ রোগীকে খুব বেশি সময় দেয় না। যদি ১০০ মিনিটের মধ্যে রোগীর চিকিৎসা সেবা শুরু করা যায় তাহলে রোগীকে বাঁচানোর চেষ্টা করা যায়। তবে রোগীর যদি হেপাটাইটিস কিংবা ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। সেক্ষেত্রে ওই রোগীটার মারা যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। চিকিৎসা পেলেও শতভাগ বলা যাবে না সে বেঁচে থাকবে। কারণ চন্দ্রবোড়া সাপ এতটাই বিষধর জীবনরক্ষাকারী এন্টিভেনম দিলেও ২০ থেকে ৩০ ভাগ বাঁচার সম্ভাবনা থাকে।
রোগীর মৃত্যুর আরও একটি কারণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, সাপে কাটার ঘটনা বাড়লেও এই ধরনের রোগীর চিকিৎসা আমাদের এখানে নেই। সাপে কাটা রোগীদের জীবনরক্ষাকারী এন্টিভেনম ব্যবহার করা হলেও সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর কোনো ফল আসবে তা না। এটার ক্ষেত্রে কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকে। রোগী হেপাটাইটিস কিংবা ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকলে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা হতে পারে। সেক্ষেত্রে রোগীর ভেন্টিলেশন প্রয়োজন হয়। আর ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা আমাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেই। তখন রোগীকে বড় হাসপাতালে পাঠানো হয়। এতে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা।
হরিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহরিয়ার রহমান বলেন, হরিরামপুর পদ্মা নদীর পাড় ঘেষা একটি উপজেলা। কিছুদিন ধরে এই অঞ্চলে চন্দ্রবোড়া সাপের উপদ্রব অনেকটাই বেশি লক্ষ্য করা গেছে। আমরা দেখেছি গত তিন মাসে রাসেল ভাইপারের কামড়ে পাঁচ জন মানুষ মারা গেছেন। এসব কারণে জনমনে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। সাপটি খুবই বিষধর, এটি কামড় দিলে মোটামুটি মৃত্যু অনিবার্য। তাই এটি এখন চিন্তা-ভাবনা করার মত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি বলেন, সাপে কাটলে জীবনরক্ষাকারী এন্টিভেনমের প্রয়োজন হয়। এন্টিভেনমের বিষয়ে বিভিন্ন সংস্থা এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা যে বিষয়টি আমাদের বলেছে এন্টিভেনম প্রয়োগ করতে গেলে তার কিছু বিশেষায়িত ব্যবস্থা থাকতে হয়। যেমন অনেক ক্ষেত্রে লাইফ সাপোর্টের প্রয়োজন হয় সেটি আমাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেই। এখন এই বিষধর সাপ থেকে মানুষজনকে রক্ষার জন্য জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। সবাইকে সাবধানে চলাচল করতে হবে, বিশেষ করে যারা পদ্মা নদীর তীরে বসবাস করেন। কাউকে সাপে কাটলে ওঝার কাছে না গিয়ে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
সারাবাংলা/এনইউ