বর্ষা শুরু, মশার উৎপাতে ডেঙ্গুর শঙ্কা— তবু হাত গুটিয়ে চসিক
১৯ জুন ২০২৪ ২২:৪৭
চট্টগ্রাম ব্যুরো: শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা— বছরজুড়েই মশার উৎপাত। অতীষ্ঠ বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বাসিন্দারা। সিটি করপোরেশন মাঝে মাঝে মশা মারার নানা তোড়জোড় দেখালেও দিনশেষে সেগুলো অকার্যকর হয়েই থাকছে। এর মধ্যেই শুরু হয়েছে বর্ষা, এসেছে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর প্রার্দুভাবের মৌসুম।
২০২৩ সালে চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। এবারও মশার তীব্র উপদ্রবের মধ্যে ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ে শঙ্কিত নগরবাসী। সিভিল সার্জনের কার্যালয় ডেঙ্গুর প্রভাব মোকাবিলায় এখনই মশা নিধনসহ কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সিটি করপোরেশন এখনো হাত গুটিয়ে আছে। মশা মারার কার্যক্রমে দৃশ্যমান কোনো গতি নেই, রুটিন কাজেই তারা সীমাবদ্ধ।
সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্ষা শুরু হলেও তাদের মূল অগ্রাধিকার ছিল কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণ। কোরবানির ছুটির পর তারা মশা নিধনের বিশেষ কর্মসূচিতে নামবেন। তবে কবে নাগাদ সেই কার্যক্রম শুরু হবে, এর কোনো সদুত্তর নেই চসিকের কমকর্তাদের কাছে।
চসিকের কর্মকর্তাদের মতে, জুন থেকে ডেঙ্গুর প্রার্দুভাবের মৌসুম শুরু হলেও সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে গিয়ে সেটা মারাত্মক আকার ধারণ করে। এই প্রবণতা বিবেচনায় রেখেই তারা মশা নিধনের জোরালো পদক্ষেপ নেবেন। তবে মশা নিধনের ওষুধ, লোকবলসহ আনুষাঙ্গিক সরঞ্জামের এবার কোনো ঘাটতি নেই বলে তারা দাবি করেছেন।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি কাউন্সিলর মোবারক আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের কাছে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় ইভেন্ট ছিল কোরবানি। আমরা কোরবানির বর্জ্য অপসারণে সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছি। কোরবানির আগেই আমরা আগের জমে থাকা বর্জ্য অপসারণ করেছি। মশা নিধনের কাজের জন্য আমাদের যে লোকবল আছে, সেটাও আমরা বর্জ্য অপসারণের কাজে ব্যবহার করেছি। এবার আমরা বড় আঙ্গিকে মশা নিধনের ক্র্যাশ প্রোগ্রাম শুরু করব।’
২০২৩ সালে রেকর্ড ডেঙ্গু আক্রান্ত-মৃত্যু
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালে চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ১০৭ জন। আক্রান্ত হয়েছিলেন ১৪ হাজার ৮২ জন। আক্রান্ত হয়ে যারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন, তাদের তালিকাভুক্ত করে এ হিসাব দিয়েছিল সিভিল সার্জনের কার্যালয়। তবে যারা আক্রান্ত হয়ে বাসায় চিকিৎসা নিয়েছিলেন, তারা তালিকাভুক্ত হলে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ১৫ হাজার ছাড়িয়ে যেত বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।
এদিকে চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জানুয়ারি থেকে মে) আক্রান্ত হয়েছেন ১৬৯ জন। জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা মুঈন মাশুক জানিয়েছেন, আক্রান্তদের মধ্যে তিনজন মারা গেছেন।
২০২৩ সালে চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্তদের নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন এসপেরিয়া হেলথ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে ছয়টি প্রতিষ্ঠানের গবেষকেরা। এতে বলা হয়, চট্টগ্রামে ডেঙ্গু রোগীদের ৬৫ শতাংশ পুরুষ, প্রতি পাঁচজনে একজন শিশু। আক্রান্ত শিশুদের বেশির ভাগই শহরে বাস করে।
কেমন হবে ২০২৪— শঙ্কা সবার মধ্যে
২০২১ সালে চট্টগ্রামে ২৭১ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছিল। মারা গিয়েছিলেন পাঁচজন। ২০২২ সাল থেকে চট্টগ্রামে ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি হতে শুরু করে। ওই বছর চট্টগ্রাম জেলা ও মহানগরী মিলিয়ে পাঁচ হাজার ৪৪৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন। মৃত্যু হয়েছিল ৪১ জনের। ২০২৩ সালে ডেঙ্গুর চিত্র ভয়ংকর আকার ধারণ করে। আক্রান্তের সংখ্যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেড়ে যায়।
এ বছরও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব নিয়ে শঙ্কিত নগরবাসী, যার প্রতিফলন দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর ফেসবুক পেজের যেকোনো পোস্টেই মশা মারার আকুতি জানান নেটিজেনরা।
নগরীর পাথরঘাটার বাসিন্দা ব্যবসায়ী সুমন রায় চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘দিনে-রাতে মশার জ্বালায় তো আমরা শহরে পারছি না। গত বছর আমার ছেলে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল। এবার কী হবে জানি না। সিটি করপোরেশনেরও কোনো কর্মকাণ্ড তো চোখে পড়ে না। তাদের উচিত ছিল বর্ষা আসার আগেই মশা মারার কার্যক্রম শুরু করা।’
নগরীর আসকারদিঘীর পাড়ের বাসিন্দা তানভীর ইলাহি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের বিল্ডিংয়ের সঙ্গে লাগোয়া নালায় জলাবদ্ধতা প্রকল্পের কাজ চলছে। দুই বছর ধরে সিডিএ বাঁধ দিয়ে রেখেছে। ময়লা-আর্বজনা জমে আছে। বারবার বলার পরও বাঁধ সরানো হচ্ছে না। বৃষ্টি হলেই বাসাবাড়িতে পানি ঢুকে যায়। সেই পানি বিভিন্ন গর্তে, বিল্ডিংয়ের কোণায় জমে থাকে। আবার সিটি করপোরেশন বলছে, জমে থাকা পানিতে মশা হবে। তাহলে আমরা কোথায় যাব? আমরা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে এ দায় কার?’
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াস চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত তিন বছরের মধ্যে গত বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি একেবারে আমাদের সব ধারণাকে ছাড়িয়ে যায়। আমরা যদি সচেতন না হই, তাহলে এ বছর কী পরিস্থিতি হবে, সেটা ভবিষ্যতই বলতে পারবে। তবে ভালো কিছু যে হবে না, সেটা সহজেই অনুমেয়।’
শঙ্কা আছে চসিকের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর কর্মকর্তাদের মধ্যেও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা এবার ডেথ রেট নিয়ে বেশি শঙ্কিত। গতবার যারা আক্রান্ত হয়েছে, তারা যদি আবার আক্রান্ত হন, তাহলে মৃত্যুহার বাড়তে পারে।’
মশা মারতে চসিকের প্রস্তুতি কী?
নগরবাসীর অভিযোগ, কেবল ডেঙ্গুর প্রকোপ চরম আকার ধারণ করলেই সিটি করপোরেশন মশা নিধনের তোড়জোড় শুরু করে। কিন্তু ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কমলে তারা আবার নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার মৌসুম চলে গেলে তখন মশার উপদ্রব বাড়লেও সিটি করপোরেশন লোক দেখানো কিছু কর্মসূচি ছাড়া আর কিছুই করে না। অথচ বছরজুড়ে মশা নিধনের কর্মসূচি চালু রাখলে নগরবাসী স্বস্তি পেত।
সর্বশেষ গত ৩০ মার্চ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী নগরীর ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে মশা নিধনের কর্মসূচি উদ্বোধন করেন। কয়েকজন ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেই কর্মসূচি বর্ষার আগ পর্যন্ত প্রতি ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে নিয়মিত করার কথা ছিল। কিন্তু ওষুধস্বল্পতা ও পরে এ খাতের কর্মীরা কোরবানির বর্জ্য অপসারণের প্রস্তুতির কাজে যুক্ত হয়ে যাওয়ায় মশা নিধনের কার্যক্রম থমকে যায়।
এ অবস্থায় গত দুই মাসে চসিকের মশা নিধনের কার্যক্রম কার্যত বন্ধ আছে। চসিকের কর্মকর্তারাই জানিয়েছেন, ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে নালা-নর্দমা আর ভবনের আশপাশে ওষুধ ছিটানো হলেও তা একেবারেই অপ্রতুল। রুটিন কাজের অংশ হিসেবে এটা করা হচ্ছে। এতে মশার উপদ্রব সেভাবে কমছে না।
তবে এবার ডেঙ্গু মোকাবিলার প্রস্তুতি গত বছরের চেয়ে ভালো বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, উড়ন্ত বা পূর্ণবয়স্ক মশা এবং লার্ভা নিধনের জন্য তিন ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে। এর মধ্যে দুই ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয় লার্ভা মারার জন্য।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, চসিকের কাছে এ মুহুর্তে ২০ হাজার লিটার অ্যাডাল্টিসাইড ও তিন হাজার লিটার ফরমুলেশনবিহীন লার্ভিসাইড (লার্ভা মারার ওষুধ) মজুত আছে। ১৬ হাজার লিটার এলডিইউ (কালো তেল) মজুত আছে। এ ছাড়া ভেষজ ওষুধ ‘মসকুবার’ মজুত আছে ৮০০ লিটার। মশকনিধন কার্যক্রমে গতি আনতে ৬০টি ফগার মেশিন ও ১০০টি স্প্রে মেশিন কেনা হয়েছে।
জানতে চাইলে সিটি করপোরেশনের মশক ও ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা শরফুল ইসলাম মাহী সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত বছরের চেয়ে আমাদের প্রস্তুতি ভালো। ২০ হাজার লিটার অ্যাডাল্টিসাইড আমরা কিনে রেখেছি। তিন হাজার লিটার র-লার্ভিসাইড আছে। এক লিটার লার্ভিসাইড তিন হাজার লিটার ওষুধে মিশিয়ে ব্যবহার সম্ভব। সুতরাং ওষুধের কোনো ঘাটতি এবার হবে না।’
চসিক এখন অ্যাডাল্টিসাইডের সঙ্গে ভেষজ মসকুবার মিশিয়ে মশা নিধনে প্রয়োগ করছে, যাতে সুফল মিলছে বলে জানান সংস্থাটির কর্মকর্তারা।
জানা গেছে, চসিক ছাড়া দেশের অন্য কোনো সিটি করপোরেশন মসকুবার ব্যবহার করছে না। গত বছর চসিক এটি পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করেছিল। চট্টগ্রামে ব্যক্তিমালিকানাধীন একটি কারখানা থেকে এ ওষুধ সংগ্রহ করা হয়। তবে পাবলিক হেলথ প্রকিউরমেন্ট (পিএইচপি) এ ওষুধ বাজারজাতের অনুমোদন এখনো দেয়নি, কেবল সায়েন্স ল্যাব অনুমোদন দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে মসকুবার ব্যবহারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আপত্তি দেবে কি না, এ প্রশ্নও উঠছে।
অনুমোদনহীন ওষুধ ব্যবহারের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শরফুল ইসলাম মাহী বলেন, ‘আমরা ব্যবহারের আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে পরীক্ষা করেছি। এর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই, মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যাডাল্টিসাইডের সঙ্গে নির্দিষ্ট মাত্রার মসকুবার মিশিয়ে বদ্ধ পরিবেশে প্রয়োগ করলে শতভাগ মশা মারা যায়। উন্মুক্ত পরিবেশে ফগিং করলে প্রায় ৮০ শতাংশ মশা ইনস্ট্যান্ট মারা যায়। কারণ শুধু অ্যাডাল্টিসাইড কাজ করে মশার শ্বাসতন্ত্রে। কিন্তু মসকুবার ব্যবহার করলে ত্বকেও কাজ করে এবং মশা দ্রুত মারা যায়।’
মশা মারার অভিযান শুরু হবে কবে?
চট্টগ্রামের ডেঙ্গু রোগীদের নিয়ে এসপেরিয়া হেলথ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, চট্টগ্রামের ৬০ শতাংশ ডেঙ্গু রোগীর আবাসস্থল পাঁচটি এলাকায়— বাকলিয়া, চকবাজার, কোতোয়ালি, ডবলমুরিং ও বায়েজিদ বোস্তামি। এসব এলাকাকে গবেষকেরা হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করেন।
২০২৩ সালের জুলাইয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন মাঠপর্যায়ে জরিপ করে নগরীর ৪১ ওয়ার্ডে মশার প্রজননক্ষেত্র হিসেবে ৪৯১টি হটস্পট চিহ্নিত করেছিল। এরপর চিহ্নিত হটস্পট এবং যে বাসায় ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গিয়েছিল, তার আশপাশে এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এখন ওষুধ ছিটানো হয়। কিন্তু এবার বর্ষা শুরু হলেও মশার প্রজননক্ষেত্র চিহ্নিত করার কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেয়নি চসিক।
জানতে চাইলে চসিকের মশক ও ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা শরফুল ইসলাম মাহী সারাবাংলাকে বলেন, ‘মশার নির্দিষ্ট কিছু প্রজননক্ষেত্র আছে। যেমন— চাক্তাই খালের ব্লক, ডাইভারশন খাল, মহেশখাল এবং এসব খালের সঙ্গে লাগোয়া নালাগুলো। একটি লার্ভার ডিম আড়াই থেকে তিন বছর পর্যন্ত জীবিত থাকে। সে হিসাবে আমরা স্পটগুলোকে চিহ্নিত করেছি। আমরা সেগুলোতে নিয়মিত ওষুধ প্রয়োগ করি।’
‘তবে নগরীতে ন্যাচারাল ব্রিডিং স্পট বেশি। প্রজনন ক্ষেত্রও ডে বাই ডে চেঞ্জ হয়। দেখা গেছে, গতবার যেখানে মশা জন্মায়নি, সেখানে এবার পানি জমে থাকার কারণে উলটো চিত্র। বর্ষা শুরু হলেও সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকে মশার উপদ্রব বেশি হবে। আমরা অবশ্যই এর আগেই ব্রিডিং স্পট চিহ্নিত করে ওষুধ ছিটাব,’— বলেন শরফুল ইসলাম মাহী।
চসিক কাউন্সিলর মোবারক আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘ব্রিডিং পয়েন্ট চিহ্নিত করা বড় বিষয় না। মানুষের প্রতিটি বাসা-বাড়ি, ভবন একেকটা ব্রিডিং পয়েন্ট হতে পারে। সে বিবেচনায় আমাদের কাজ করতে হবে। কোনো স্পট যেন ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রমের আওতার বাইরে না থাকে, সেটা আমরা দেখব।’
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াস চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত তিন বছরের পরিস্থিতি বিবেচনায় জুন মাসের শুরুকেই আমরা ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের সিজন শুরু হিসেবে নিয়েছি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে আমাদের এ বিষয়ে সতর্কতামূলক বার্তা দেওয়া হয়েছে। আমরা উপজেলা পর্যায়ে সব সরকারি হাসপাতালগুলোকে এ বিষয়ে অ্যালার্ট করেছি। ডেঙ্গু রোগী গেলে চিকিৎসা যেন দেওয়া যায়, সে ব্যবস্থা করা হচ্ছে। পোস্টার, ব্যানার লাগানো হচ্ছে হাসপাতাল প্রাঙ্গণে। মাইকিং করারও প্রস্তুতি আমাদের আছে।’
গত বছরের জুলাইয়ে চট্টগ্রামে ডেঙ্গু প্রকোপের আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি তুলে ধরে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়রকে চিঠি দিয়েছিলেন সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী। চিঠিতে ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও এডিস মশা নিধনে প্রয়োজনীয় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়েছিল।
এবার চসিককে কোনো বার্তা দেওয়া হয়েছে কি না— জানতে চাইলে সিভিল সার্জন বলেন, ‘সিটি করপোরেশনকে সরাসরি কোনো নির্দেশনা দেওয়ার এখতিয়ার আমার নেই। তবে এ সংক্রান্ত সাম্প্রতিক কয়েকটি সভায় আমি সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে গতবারের পরিস্থিতি বিবেচনায় সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছি। একইসঙ্গে জনসচেতনতা ও মশা নিধনের কর্মসূচি দ্রুত শুরুর তাগিদ দিয়েছি।’
জানতে চাইলে চসিকের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ইমাম হোসেন রানা সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে আমাদের প্রস্তুতি আমরা নিয়েছি। কোরবানির ঈদের পর জনসচেতনতা কার্যক্রম শুরু করব। প্রত্যেক কাউন্সিলরের নেতৃত্বে এলাকায় এলাকায় আমরা লিফলেট বিলি, মাইকিং শুরু করব। সিটি করপোরেশনের জেনারেল হাসপাতালে আমরা বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষার বুথ স্থাপন করেছি। এর বাইরে মশা নিধনের কার্যক্রম পরিচ্ছন্ন বিভাগের কাজ। এটা তারাই করবে।’
চসিকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জুন মাসের শুরু থেকে জমে থাকা পুরনো বর্জ্য অপসারণে নগরজুড়ে বিশেষ কর্মসূচি পালন করে চসিক। এরপর ছিল কোরবানির বর্জ্য অপসারণের কর্মসূচি। মূলত কোরবানির আগে-পরে বর্জ্য অপসারণকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে তাদের নিয়মিত চার হাজার শ্রমিক এবং মশা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় থাকা ১৮৬ কর্মীকে এ পর্যন্ত ব্যস্ত রাখে চসিক।
ঈদুল আজহার ছুটি শেষে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী আন্তঃবিভাগীয় সভা করে মশা নিধনে বিশেষ কর্মসূচির সময় নির্ধারণ করবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তবে কবে নাগাদ মশা মারার ক্র্যাশ প্রোগ্রাম শুরু হবে, সেটা এখনও জানেন না চসিকের কর্মকর্তারা।
চসিকের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি মোবারক আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘কোরবানির আগে জমে থাকা বর্জ্য যে অপসারণ করছি, এটাও কিন্তু ডেঙ্গু মোকাবিলার কাজের অংশ। কোরবানির বর্জ্য অপসারণও একই কাজের অংশ। সুতরাং আমরা ডেঙ্গু মোকাবিলায় একেবারে কোনো কাজ করছি না, এমন নয়। কোরবানির ঈদের পর এখন মশা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ১৮৬ জন লোকবলকে বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভাগ করে দেওয়া হবে।’
মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা শরফুল ইসলাম মাহী সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঈদুল আজহার পর এখন কাজ শুরু হবে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে পিক সিজন শুরুর আগেই আমরা পুরো শহরে মশা নিধনের বিশেষ কর্মসূচি শেষ করব।’
মশা মারার লোকবল দিয়ে অন্য কাজ করানোর কারণে মশার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার কথা এসেছে চসিকের পরিচ্ছন্নতা বিভাগের এক চিঠিতে। গত ১১ মার্চ প্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা কমান্ডার লতিফুল হক কাজমীর সই করা এক অফিস আদেশে বলা হয়েছে, মশার লার্ভা মারার ওষুধ ছিটানো ও মশা মারার ধোঁয়ার ওষুধ ছিটানোর কাজে নিয়োজিত সেবকদের মূল কাজ থেকে বিরত রাখা হচ্ছে। মূল কাজের পরিবর্তে তাদের দিয়ে আবর্জনাবাহী গাড়ি, নালা পরিষ্কার ও ঝাড়ু দেওয়ার কাজ করানো হচ্ছে। এতে সিটি করপোরেশনের মশকনিধনের কাজ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে।
সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কার্যালয়ে নিয়োজিত স্প্রে-ম্যানদের শুধু মশার ওষুধ ছিটানোর কাজে এবং ফগার মেশিনের চালকদের দিয়ে ফগিং করানোর কাজ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয় ওই অফিস আদেশে। এ নির্দেশ অমান্যকারীদের আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
কমান্ডার লতিফুল হক কাজমী বলেন, ‘যাদের কাজ মশা নিধন, তাদের অন্য কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে মশক নিধন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এজন্য প্রচুর মশা বেড়েছে।’
মশা মারার ওষুধ নিয়ে চসিকের গবেষণা কতদূর ?
ওষুধ প্রয়োগের পরও মশা কেন মরছে না, সেটা খতিয়ে দেখতে গত ৩০ মার্চ গবেষণাগার চালুর ঘোষণা দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। কিন্তু আড়াই মাস পেরিয়ে গেলেও ঘোষণাই সার, গবেষণাগার চালুর উদ্যোগ বিন্দুমাত্র আগায়নি।
জানা গেছে, নগরীর টাইগারপাসে অস্থায়ী নগর ভবনের অষ্টম তলায় গবেষণাগারটি চালুর জন্য একটি কক্ষ বরাদ্দ হয়েছে। তবে সেখানে যন্ত্রপাতিসহ আনুষাঙ্গিক সরঞ্জাম স্থাপন করা হয়নি। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিই এখনো সংগ্রহ করা হয়নি। এ ছাড়া একটি গবেষণাগার চালুর জন্য যে ধরনের লোকবল দরকার তা-ও চসিকের নেই। কেবল শরফুল আলম মাহী, একজনই মশা ও ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সামলাচ্ছেন।
এ অবস্থায় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ, ল্যাব সহকারী পদ সৃজন, নিয়োগ— সব মিলিয়ে অন্তত দুই বছরের মধ্যে গবেষণাগার চালুর কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না খোদ চসিকের কর্মকর্তারাই।
জানতে চাইলে শরফুল আলম মাহী সারাবাংলাকে বলেন, ‘গবেষণাগার চালু করাই যায়। যন্ত্রপাতি নিয়ে আসা বড় বিষয় নয়। কিন্তু টেকনিক্যাল পারসন লাগবে। প্রক্রিয়া চলছে। খুব শিগগির আশা করি আমরা সেটা চালু করতে পারব।’
নিজেরা গবেষণার কথা বলে চসিক দূরে সরিয়ে দিয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই গবেষক দলকেও, একসময় সংস্থাটি যাদের ওপর নির্ভর করেছিল। চসিক মেয়রের অনুরোধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক ২০২১ সালে নগরে মশার প্রজনন এবং মশা মারার কীটনাশকের কার্যকারিতা নিয়ে একটি গবেষণা সম্পন্ন করেছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রবিউল হাসান ভুঁইয়াকে আহ্বায়ক এবং উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. ওমর ফারুক রাসেলের নেতৃত্বে একটি টিম এই গবেষণা সম্পন্ন করেন।
চসিকের সরবরাহ করা পাঁচ ধরনের রাসায়নিক তারা পরীক্ষা করেন। এর মধ্যে চার ধরনের ওষুধে মশার শতভাগ মৃত্যুর প্রমাণ তারা পাননি। এমনকি ফগার মেশিনের মাধ্যমে এসব ওষুধ প্রয়োগে মশার মৃত্যুহার পাওয়া যায় ২৫ শতাংশেরও নিচে। তবে স্প্রে মেশিনের মাধ্যমে হারবাল জাতীয় লার্ভিসাইড ও হারবাল জাতীয় অ্যাডাল্টিসাইড কেরোসিনের সঙ্গে মিশিয়ে (প্রতি লিটারে ১৬ দশমিক ৯ মিলিলিটার) ছিটানো পর শতভাগ মশার মৃত্যুর প্রমাণ পায় গবেষক দল।
২০২১ সালের ৩ আগস্ট মেয়রের কাছে জমা দেয়া হয় গবেষণা প্রতিবেদন। কিন্তু এরপরও ৪ আগস্ট থেকে সেই অকার্যকর ওষুধ দিয়ে মশা নিধনের ক্র্যাশ প্রোগ্রাম শুরু করে চসিক। গত চার বছর ধরে আগের পদ্ধতি ও একই কীটনাশক প্রয়োগ করেছে সিটি করপোরেশন। গবেষক দলটিকেও আর পাশে রাখেনি চসিক।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক রাসেল সারাবাংলাকে বলেন, ‘চসিক যে প্রক্রিয়ায় আগাচ্ছে, এভাবে শো-ডাউন হবে, মশা মরবে না। এখন থেকে যদি পরিকল্পিত ও বৈজ্ঞানিকভাবে মশা মারার কার্যক্রম হাতে না নেয়, তাহলে গত বছরের তুলনায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। শুধুমাত্র ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব যখন বাড়বে, তখন তো ওষুধ ছিটিয়ে লাভ নেই। বছরজুড়ে ওষুধ ছিটাতে হবে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সিটি করপোরেশন কোনো পরামর্শ শোনে না, প্রকোপ কমে গেলে তাদের তৎপরতাও থাকে না।’
সারাবাংলা/আরডি/টিআর
এডিস মশা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন চসিক ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ডেঙ্গুর মৌসুম মশা নিধন