খুলনা সিটির দাবি ডেঙ্গু প্রতিরোধে তৎপর, নগরবাসীর দ্বিমত
২০ জুন ২০২৪ ২৩:০০
খুলনা: মশার যন্ত্রণায় প্রায় সারা বছরই ভুগতে হয় বলে অভিযোগ খুলনা সিটি করপোরেশনের বাসিন্দাদের। এর মধ্যে শুরু হওয়া বর্ষাকালে সেই মশার প্রাদুর্ভাব আরও বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে ডেঙ্গু নিয়ে শঙ্কা। কারণ জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চার মাস ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব থাকে সবচেয়ে বেশি। গত বছর খুলনা ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আগের বছরগুলোর তুলনায় বেশি হওয়ায় সেই শঙ্কা আরও জেঁকে বসেছে। প্রশ্ন উঠেছে, খুলনা সিটি করপোরেশন কি ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার প্রকোপ মোকাবিলায় প্রস্তুত?
গত মৌসুমে তথা ২০২৩ সালে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে তিন হাজার ৪৪৪ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ৬৯ জনের মৃত্যু হয়। এর আগে কখনো খুলনায় এক মৌসুমে এত ডেঙ্গু রোগী ও ডেঙ্গুতে এত বেশি প্রাণহানি ঘটেনি। তবে নগরবাসীর অভিযোগ, এরপরও টনক নড়েনি খুলনা সিটি করপোরেশনের।
সিটি করপোরেশন অবশ্য মশা নিধনে তৎপর বলে দাবি করেছে। কেসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা আনিছুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধে কাজ করার জন্য ১৫-১৬ জনের একটি কমিটি রয়েছে। কেসিসি মেয়র কমিটির সভাপতি ও প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা কমিটির সদস্য সচিব। তিন মাসে একবার করে আমরা সেই কমিটির সভা করে থাকি। কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নগরীর চারটি পয়েন্টে ডেঙ্গু প্রতিরোধ বিষয়ে মাইকিং হচ্ছে। মশা নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। নগরীতে মশা নিধনে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে।’
আনিছুর রহমান আরও বলেন, ‘মৌসুম পরিবর্তন হওয়ার এ রকম সময়ে মশার প্রজনন বেড়ে যায়। তাই মশা নিধনের জন্য শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডে ফগার মেশিন চালানো হচ্ছে। ড্রেনগুলোতে উচ্চ মানের স্প্রে ব্যবহার করা হচ্ছে। ছোট-বড় সব ড্রেনের মাটি উত্তোলনের কাজ চলছে গত ডিসেম্বর থেকে। বড় ড্রেনের তলি মাটি আমরা এসক্যাভেটর দিয়ে কাটছি। বর্তমানে নগরীর পাঁচটি পয়েন্টে কাজ চলছে। এ ছাড়া নগরীর ঝোঁপঝাড়মুক্ত করা হচ্ছে। সিটি করপোরেশনের পাঁচটি বড় বড় হুইল মাউন্টেন মেশিন আছে। এগুলো দিয়ে স্লাবের ভেতরে ও ড্রেনে মশা নিধক ওষুধ দেওয়া হচ্ছে।’
আরও পড়ুন- বর্ষা শুরু, মশার উৎপাতে ডেঙ্গুর শঙ্কা— তবু হাত গুটিয়ে চসিক
নগরীতে এডিস মশার প্রাদুর্ভাব কোথায় কোথায় বেশি, সে বিষয়ে কোনো জরিপ বা গবেষণা রয়েছে কি না— জানতে চাইলে সিটি করপোরেশনের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘সে রকম কোনো গবেষণা নেই। তবে জমে থাকা পরিষ্কার পানি এডিস মশার প্রজননস্থল। গ্যারেজ, টায়ারের দোকান কিংবা ছাদবাগানের টবে জমে থাকা পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়তে পারে। তাই ভাঙারির দোকানগুলোকে আমরা সতর্ক করছি। অভিযান চালিয়ে জরিমানা করা হচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে।’ মশা নিধনে কেসিসি বছরে তিন থেকে সাড়ে তিন কোটি টাকা ব্যয় করে থাকে বলে জানান তিনি।
নগরবাসী সিটি করপোরেশনের এমন বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন। তারা বলছেন, সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) অধিকাংশ নালা-নর্দমা ও খাল নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না। ফলে সেগুলো মশার প্রজননস্থলে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে নগরীর রায়েরমহল, সোনাডাঙ্গা, করিমনগর, গোবরচাকা, রূপসা, নিরালা, গল্লামারী এলাকায় মশার উপদ্রব সারা বছরের। মশা নিধন কার্যক্রমও তাদের খুব একটা চোখে পড়ে না।
খুলনা শহরের ময়লাপোতা এলাকার বাসিন্দা আমজাদ শেখ সারাবাংলাকে বলেন, ‘দিনে-রাতে মশা কামড়ায়। কখন কোন মশায় কামড়ায়, বলতে পারি না। মশার উপদ্রবে মানুষ অতীষ্ঠ। শুনেছি এ বছর বর্ষাকালে ডেঙ্গু বাড়তে পারে। তাই আতঙ্কে আছি।’
নগরীর নিরালা এলাকার শ্যামল দাস বলেন, ‘খুলনায় বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন কাজ চলছে। সেগুলোতে খুব একটা গতি নেই। বর্ষা মৌসুমে এসব কনস্ট্রাকশন এলাকায় পানি জমে থাকতে পারে। সেগুলো তো ডেঙ্গুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। জানি না এ মৌসুমে কী হবে।’
খুলনা উন্নয়ন আন্দোলনের চেয়ারম্যান শেখ মো. নাসির উদ্দিন বলেন, ‘নগরীতে মশার উপদ্রব অনেক বেশি। বিকেল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মশার যন্ত্রণায় বসতে পারি না। এখন তো বর্ষাও চলে এসেছে। কোথাও যেন পানি জমে না থাকে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। সবাইকে সচেতন হতে হবে। তার চেয়েও বড় কথা, সিটি করপোরেশনকে তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত মশার উপদ্রব থেকে নগরবাসীকে রক্ষা করার জন্য সিটি করপোরেশনের তেমন কোনো ভূমিকা দেখছি না।’
খুলনার উন্নয়ন নিয়ে সোচ্চার আরেক সংগঠন বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ-উজ-জামানের অভিজ্ঞতাও একই রকম। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘প্রচণ্ড গরমের কারণে মশার উপদ্রব একটু কম ছিল। কিন্তু আবার বর্ষা আসছে। জায়গায় জায়গায় পানি জমলে আবার মশার প্রজনন বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। কিন্তু খুলনা সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কার্যক্রম আমার চোখে পড়েনি। শহরে ড্রেনগুলোর অবস্থা খুব খারাপ। ওয়াসা-ড্রেনেজ সব মিলিয়ে বর্ষার আগে তো কাজ শেষ হবেই না। এখনো বহু কাজ বাকি। ফলে জলবদ্ধতার দুর্ভোগের পাশাপাশি ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব এবার তীব্র আকার ধারণ করতে পারি। আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র— এই তিন মাস অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।’
সিটি করপোরেশনকে তাগিদ দিয়ে শেখ আশরাফ-উজ-জামান আরও বলেন, ‘বর্ষা যেহেতু শুরু হয়ে গেছে, যতটা দ্রুতসম্ভব কাজ শেষ করতে হবে। তা না হলে দুর্ভোগ থেকে শহরবাসী রক্ষা পাবে না। তাই আমরা মনে করি, বন্ধের দিন কাজে লাগিয়ে হলেও কাজগুলো দ্রুত শেষ করা উচিত। এটাই নিয়ম। এ ব্যাপারে দায়িত্বশীলদের কর্মতৎপরতা বাড়ানো উচিত।’
এদিকে এ বছর ডেঙ্গুর সংক্রমণ কেমন দেখছেন— জানতে চাইলে খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) ডা. সুহাস রঞ্জন হালদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ বছর তো কেবল ডেঙ্গুর মৌসুম শুরু হচ্ছে। এখনো তেমন একটা প্রকোপ নেই। তবে ঈদুল আজহা শেষ হয়েছ, বর্ষাকালও শুরু হয়েছে। এখন হয়তো ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে পারে।’
নগরবাসীকে সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, ‘প্লাস্টিকের পাত্র, নারকেলের খোল বা চিপসের প্যাকেটের মতো জিনিসপত্র বাড়ির আশপাশে যেন না থাকে। এগুলোতে পানি জমলে সেটি ডেঙ্গু মশার প্রজননস্থল হয়ে উঠতে পারে। ফলে এগুলো যথাযথভাবে ডাস্টবিনে ফেলতে হবে। এ ছাড়া পানির টব বা ফ্রিজের পেছনে যেসব জায়গায় পানি জমা হয়, সেগুলোও তিন দিনে একদিন পরিষ্কার করতে হবে। ঘরে মশার প্রবেশ ঠেকাতে সন্ধ্যার আগে দরজা-জানালা সব বন্ধ করে দিতে হবে। ঘুমাতে গেলে মশার কয়েল অথবা মশারি ব্যবহার করতে হবে। বাড়ির আশপাশে ঝোঁপ-জঙ্গল, ডোবা-নালা থাকলে সেগুলো পরিষ্কার রাখতে হবে। সবাই মিলে এগুলো করতে পারলেই কেবল ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা সম্ভব।’
জনসাধারণকে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষ হিসেবে খুলনা সিটি করপোরেশনকেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। খুলনা বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. মো. মনজুরুল মুরশিদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য-শিক্ষাসহ স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ানোর জন্য খুলনা সিটি করপোরেশনসহ সবাইকে বলা হয়েছে। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার সব ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।’
জানতে চাইলে খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক সারাবাংলাকে বলেন, ‘বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যায়। তাই ডেঙ্গু থেকে নগরবাসীকে রক্ষা করার জন্য মশা নিধন অভিযান চলমান রয়েছে।’
সারাবাংলা/টিআর
এডিস মশা কেসিসি খুলনা খুলনা সিটি করপোরেশন ডেঙ্গু ডেঙ্গুর প্রকোপ ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব