।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আবার মার্কিন এক গবেষণার তথ্য, দেশে হৃদরোগজনিত মৃত্যুর রিস্ক ফ্যাক্টর হিসেবে তামাকের অবস্থান চতুর্থ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, হৃদরোগজনিত মৃত্যুর প্রায় ১২ শতাংশের জন্য দায়ী তামাকজাত পদার্থ। আর বাংলাদেশে হৃদরোগজনিত মৃত্যুর ৩০ শতাংশের জন্যই দায়ী ধূমপান। অথচ দেশে মোট প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ৪ কোটি ১৩ লাখ মানুষ ধূমপানসহ তামাক সেবন করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধূমপায়ীদের তুলনায় ধূমপায়ীদের হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি দ্বিগুণ। স্ট্রোকের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি তিন গুণ, বুকের ব্যাথা বা অ্যানজিনার ক্ষেত্রে ২০ গুণ এবং শরীরের কোনো পেশীতে রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভবনা ধূমপায়ীদের ৫ গুণ। শুধু তাই নয়, পরোক্ষ ধূমপানেও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়। এ অবস্থায় দেশে ধূমপানসহ তামাকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলে এর জন্য সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে।
আজ ৩১ মে, বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘তামাক ও হৃদরোগ’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যের বরাত দিয়ে তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞা জানায়, বর্তমান বিশ্বে মৃত্যুর একক কারণ হিসেবে কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ বা হৃদরোগ শীর্ষে। বিশ্বে মোট মৃত্যুর প্রায় এক-তৃতীয়াংশের জন্যই দায়ী হৃদরোগ। আবার প্রতিবছর তামাকের কারণে মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে ৭০ লাখ মানুষকে। এমনকি পরোক্ষ ধূমপানও কেড়ে নিচ্ছে ৯ লাখ মানুষের প্রাণ।
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে তামাকের এই প্রভাব আরো প্রকট। অসংক্রামক রোগের মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা দেশে প্রায় ১৭ শতাংশ। আর টোবাকো অ্যাটলাসের তথ্য অনুযায়ী, মানব উন্নয়ন সূচকে মধ্যম সারির দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারজনিত রোগে মৃত্যুর হার ২৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ বেশি।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, দেশে প্রতিবছর ১ লাখ ৬১ হাজার ২৫৩ জন মানুষ মারা যাচ্ছেন তামাকজনিতে রোগে আক্রান্ত হয়ে। এ তথ্য জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তবে আতঙ্কের বিষয় হলো— এর মধ্যে ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সী, অর্থাৎ পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিরা তামাকের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন। কেবল ব্যক্তি নয়, এর জন্য গোটা পরিবার ও সমাজকেও ভুগতে হচ্ছে। আবার ৪৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সীদের মধ্যে ৩৭ শতাংশ মানুষ তামাকজনিতে রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের ২০১৭ সালের হেলথ বুলেটিন থেকে জানা যায়, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের বর্হিবিভাগে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে ৪১ দশমিক ৩ শতাংশ। আবার, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দ্য ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশেনের ( আইএইচএমই) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ সাল থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশে অকাল মৃত্যুর কারণের তালিকায় হৃদরোগ সপ্তম স্থান থেকে প্রথম স্থানে চলে এসেছে এবং এর রিস্ক ফ্যাক্টর হিসেবে তামাকের অবস্থান চতুর্থ।
তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞা জানায়, তামাককে টেকসই উন্নয়ন অর্জনের পথে অন্যতম বাধা হিসেবে চিহ্নিত করে ২০৪০ সালের আগেই বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই ঘোষণার প্রতিফলন ঘটাতে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের ধারা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে বলে জানায় প্রজ্ঞা। একইসঙ্গে তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক খসড়া নীতি (জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি, তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ নীতি) দ্রুততম সময়ে চূড়ান্ত ও বাস্তবায়ন করতে হবে বলেও জানায় প্রজ্ঞা।
জাতীয় অধ্যাপক ও ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ব্রিগেডিয়ার (অব.) আবদুল মালিক সারাবাংলাকে বলেন, ‘ধূমপান বা তামাক ছেড়ে না দিয়ে কেবল পরিমাণ কমিয়ে আনলে হৃদরোগ এড়ানো সম্ভব— এ ধারণা ভুল। কারণ, দিনে একজন মানুষ একটি সিগারেট খেলেও হৃদরোগের ঝুঁকি ৫০ শতাংশ এবং স্ট্রেক বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়। তবে দীর্ঘদিন যারা তামাক সেবন করেন, তামাক ছেড়ে দেওয়ার এক বছরের মধ্যেই তাদের হৃদরোগের ঝুঁকি অর্ধেক কমে যায়। আর টানা ১৫ বছর তামাক সেবন থেকে বিরত থাকলে এই ঝুঁকি কমে একজন অধূমপায়ীর পর্যায়ে নেমে আসে।’
তরুণরা এখন হৃদরোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে এবং এর অন্যতম কারণ ধূমপান বলে মন্তব্য করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘তারুণ্যের শুরুতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন অসংখ্য রোগী আসেন। তাদের চিকিৎসায় পরিবারের সব সঞ্চয় শেষ হয়ে যাচ্ছে, বিক্রি করতে হচ্ছে জমি-জমা।’ এ অবস্থা এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আমাদের জন্য একটি অন্ধকার ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে বলে মন্তব্য করেন ডা. আব্দুল ওয়াদুদ।
সারাবাংলা/জেএ/টিআর