ইতিহাসের কালপঞ্জিতে ৭৫ বছরের আওয়ামী লীগ
২৩ জুন ২০২৪ ১৯:৪৯
ঢাকা: গৌরবময় পথচলার ৭৫ বছর অতিবাহিত করছে আওয়ামী লীগ। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ইতিহাস ঐতিহ্য সংগ্রাম অর্জনের পথচলায় দলটি এবার ৭৫ বছর পূর্ণ করে আজ পা দিলো ৭৬ বছরে। গৌরব ঐতিহ্য ও সংগ্রামের ৭৫ বছরের পথচলায় নানামুখী চড়াই-উৎরাই পেরোনো আওয়ামী লীগ দীর্ঘ পথচলায় কখনো থেমে যায়নি। অবিরাম পথচলায় বারবার দিয়েছে অদম্যতার প্রমাণ। দীর্ঘ সংগ্রামের অবিরত অভিযাত্রায় নেতাকর্মী, সমর্থক, শুভাকাঙ্খীদের মধ্যে অনুভূতির আওয়ামী লীগে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এক ও অভিন্ন এবং বাঙালি জাতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ রাজনৈতিক দলটি দেশের সুদীর্ঘ রাজনীতি এবং বাঙালি জাতির আন্দোলন-সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী দলটির নেতৃত্বেই এদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। রোজগার্ডেনে জন্মগ্রহণের পর থেকে নানা লড়াই, সংগ্রাম, চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে দলটি এখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়।
আওয়ামী লীগের ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই দেশের অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল ও তরুণ মুসলিম লীগ নেতাদের উদ্যোগে ১৯৪৯ সালের ২৩-২৪ জুন পুরনো ঢাকার কেএম দাস লেনের বশির সাহেবের রোজ গার্ডেনের বাসভবনে একটি রাজনৈতিক কর্মী সম্মেলনের মাধ্যমে পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়।
মুসলিম লীগের প্রগতিশীল নেতাকর্মীরা সংগঠন থেকে বেরিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন আওয়ামী মুসলিম লীগ। প্রথম সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন প্রথম কমিটির যুগ্ম-সম্পাদক।
১৯৬৬ সালের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরে তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। ১৯৬৯-এর গণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসক-শোষক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাঙালির যে জাগরণ ও বিজয় সূচিত হয়, সেই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগ এবং এই আন্দোলনের পথ ধরেই বাঙালি জাতি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা, ৩ নভেম্বর জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর নেতৃত্ব শুন্যতায় পড়ে আওয়ামী লীগ। এর পর দলের মধ্যে ভাঙনও দেখা দেয়। ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। তার নেতৃত্বে দ্বিধা-বিভক্ত আওয়ামী লীগ আবার ঐক্যবদ্ধ হয়। চার দশক ধরে তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পরিচালিত হচ্ছে। এই সময়ে আন্দোলন-সংগ্রামের পাশাপাশি চারবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পেরেছে দলটি।
আবার ৭৫ বছরের মধ্যে প্রায় ৫০ বছরই আওয়ামী লীগকে থাকতে হয়েছে রাষ্ট্র ক্ষমতার বাইরে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের সাড়ে তিন বছর এবং ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৫ বছর, ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনা করছে।
২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর অনেকটা সুসংহত হতে সক্ষম হয়ে জোট সরকারবিরোধী আন্দোলনে সফলতার পরিচয়ও দিয়েছিল দলটি। কিন্তু এই আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশ জুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নিলে আবারো নতুন সংকটের মুখে পড়ে যায় দলটি। দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনাসহ প্রথম সারির অসংখ্য নেতারা গ্রেফতার এবং একাংশের সংস্কার তৎপরতায় কিছুটা সংকটে পড়ে দলীয় কার্যক্রম। তবে, সকল প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করেই ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও মহাজোট ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে।
২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি গঠিত হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। পরে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপি-জামায়াত জোটের শত প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে এবং তৃতীয় বারের মত প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে এবং শেখ হাসিনা চতুর্থবারের মত প্রধানমন্ত্রী হন। সর্বশেষ, ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে এবং শেখ হাসিনা পঞ্চম বারের মত প্রধানমন্ত্রী হন।
এবার ডিজিটাল বাংলাদেশ স্লোগানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এর স্বপ্ন। এবার সরকারের লক্ষ্য ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এ রূপান্তর। স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট সোসাইটি, স্মার্ট ইকোনমি ও স্মার্ট গভর্নমেন্ট এ চারটি মূল ভিত্তিকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ সরকার আগামী ২০৪১ সাল নাগাদ একটি সাশ্রয়ী, টেকসই, বুদ্ধিদীপ্ত, জ্ঞানভিত্তিক, উদ্ভাবনী স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করেছে।
মোটাদাগে ৭৫বছরের অভিযাত্রায় যা যা ঐতিহাসিক কালপঞ্জি
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন। আহ্বায়ক : নঈমউদ্দিন আহমদ। স্থান : ফজলুল হক হল।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রথম ধর্মঘট। শেখ মুজিবুর রহমানসহ তৎকালীন ছাত্র নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার।
১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পূর্ব বাংলা সফরে এসে জিন্নাহর ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ ঘোষণা। ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ ছাত্র নেতৃবৃন্দের এই ঘোষণার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ। এ বছর ১১ সেপ্টেম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানকে আবার আটক করা হয়। ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।
১৯৪৯ : টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী শামসুল হকের জয়লাভ। মুসলিম লীগ মনোনীত প্রার্থী পরাজিত। মুসলিম লীগে ভাঙনের সূত্রপাত।
১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে নেতৃত্বদানের অভিযোগে ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ কয়েকজনকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার। এপ্রিলে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান ধর্মঘট করার কারণে শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হন।
১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন ঢাকার কেএম দাশ লেনে অবস্থিত হুমায়ূন সাহেবের বাসভবন রোজ গার্ডেন প্রাঙ্গণে মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত। ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দলের আত্মপ্রকাশ। প্রথম সভাপতি মওলানা ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক। জেলে থাকা অবস্থায় এই দলের যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান। জুন মাসের শেষের দিকে মুক্তিলাভ করেন।
১৯৪৯ সালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর চাপিয়ে দেওয়া সংবিধানের ‘মূলনীতি’ বিরোধী আন্দোলন।
১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের পূর্ব পাকিস্তান আগমনকে উপলক্ষ করে আওয়ামী মুসলিম লীগ ঢাকায় দুর্ভিক্ষবিরোধী মিছিল বের করে। এই মিছিলের নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হন। এ সময় শেখ মুজিবুর রহমানের দুই বছর জেল হয়েছিল।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর উদ্যোগে ১৯৫১ সালে নিখিল পাকিস্তান জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা। সভাপতি মানকি শরীফের পীর এবং সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক ওসমানী।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন; কারাবন্দি শেখ মুজিবের নির্দেশনা। বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সিদ্ধান্তে ছাত্রদের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ। রফিক, শফিক, বরকত, সালাম, জব্বারসহ অগণিত আন্দোলনকারী পুলিশের গুলিতে শহিদ।
১৯৫২ সালের ডিসেম্বরে লাহোরে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ও পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিনিধিদের যৌথ সম্মেলন। সম্মেলনে শর্তসাপেক্ষে দুই দল একীভূত হয়ে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়।
১৯৫৩ সালের ৩, ৪ ও ৫ জুলাই ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি এবং শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত।
১৯৫৩ সালের ১৪ ও ১৫ নভেম্বর ময়মনসিংহে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিলে যুক্তফ্রন্টে অংশগ্রহণ ও ২১-দফা অনুমোদন নিয়ে আলোচনা হয়।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠন। আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ২১-দফা প্রণয়ন। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়। সংখ্যা গরিষ্ঠ আসনে আওয়ামী লীগ জয়ী। ৩ এপ্রিল আওয়ামী লীগকে বাদ রেখে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণ। ১৫ মে আওয়ামী লীগসহ যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা সম্প্রসারিত। আদমজীতে দাঙ্গার অজুহাতে ৩০ মে ৯২(ক) ধারা জারি এবং যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত। তীব্র দমননীতি।
১৯৫৫ সালের ২১, ২২ ও ২৩ অক্টোবর ঢাকার সদরঘাটের রূপমহল সিনেমা হলে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি এবং শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত। এই কাউন্সিলে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসেবে আওয়ামী লীগের আত্মপ্রকাশ।
১৯৫৬ সালের ১৯ ও ২০ মে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিলে যথাসময়ে সাধারণ নির্বাচনের দাবি জানানো হয়।
১৯৫৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পূর্ব বাংলায় আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভা গঠন। ১১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের কেন্দ্রে সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও রিপাবলিকান পার্টির কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠন।
১৯৫৭ সালের ৭-৮ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের কাগমারীতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসন ও পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে দলে প্রকাশ্য মতবিরোধ। কাগমারী সম্মেলনের পর ১৯৫৭ সালের মার্চ মাসে মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে পদত্যাগপত্র পাঠান। অন্যদিকে ১৯৫৭ সালের ১৩ ও ১৪ জুন ঢাকার শাবিস্তান হলে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল আহ্বান করা হয়। এই কাউন্সিলে ভাসানীর পদত্যাগপত্র নিয়ে আলোচনা হয়; কিন্তু গৃহীত হয় না। দল থেকে পদত্যাগ করলেও কাউন্সিল ভাসানীকেই সভাপতি করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়।
১৯৫৭ সালের ২৫-২৬ জুলাই অনুষ্ঠিত গণতান্ত্রিক কনভেনশনে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন।
১৯৫৭ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানে মার্শাল ল’ জারি। রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ। শেখ মুজিবসহ নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার। ২৭ অক্টোবর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জার অপসারণ, জেনারেল আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখল।
১৯৫৯ সালের ৭ ডিসেম্বর শেখ মুজিবের মুক্তিলাভ। গোপনে সহকর্মীদের কাছে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা প্রকাশ করেন শেখ মুজিব।
ষাটের দশকের শুরুতেই বাংলাদেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে ছাত্রলীগ নেতাদের গোপন নিউক্লিয়াস গঠন। শেখ মুজিবের অনুমোদন।
১৯৬১ রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনে সংস্কৃতিকর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগ। রবীন্দ্রসংগীত প্রচারে সরকারের নিষেধাজ্ঞা। প্রতিবাদ-প্রতিরোধ।
১৯৬২ সালে ছাত্রলীগ নেতৃত্বে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন। সোহরাওয়ার্দীর মুক্তি। সামরিক শাসন শিথিল। ১৯৬২ সালের ৪ অক্টোবর আওয়ামী লীগ নেতা সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক দলগুলো আলাদাভাবে পুনরুজ্জীবিত না করার সিদ্ধান্ত। ‘ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট’ (এনডিএফ) নামে একটি ঐক্যবদ্ধ জোট গড়ে ওঠে।
১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর লেবাননের রাজধানী বৈরুতে সোহরাওয়ার্দীর আকস্মিক মৃত্যুর পর এনডিএফ কার্যকারিতা হারায়। ১৯৬৪ সালের ২৫ ও ২৬ জানুয়ারি দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে অনুষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভা। এই সভায় দল পুনরুজ্জীবনের সিদ্ধান্ত। পুনরুজ্জীবিত দলে মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ ও শেখ মুজিবুর রহমান যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে বহাল থাকেন।
এনডিএফ-পন্থি নেতাদের আওয়ামী লীগ ত্যাগ।
৯৬৪ সালের ৬, ৭ ও ৮ মার্চ ঢাকার হোটেল ইডেন প্রাঙ্গণে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ ও শেখ মুজিবুর রহমান যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে বহাল থাকেন।
১৯৬৪ সালে শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট-বিরোধী আন্দোলন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। দাঙ্গার বিরুদ্ধে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ব্যাপক গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়।
১৯৬৪ সালে বুনিয়াদি গণতন্ত্রের নামে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টি বা সম্মিলিত বিরোধী দল ‘কপ’ গঠন। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে মহম্মদ আলী জিন্নাহর বোন ফাতেমা জিন্নাহকে ‘কপ’-এর প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন। প্রতিনিধি পদে নির্বাচনে কপ প্রার্থীদের জয়লাভ; কিন্তু প্রেসিডেন্ট পদে পরোক্ষ নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহর পরাজয়। সর্বজনীন ভোটাধিকারের দাবি জোরদার।
১৯৬৪ সালের ৫ জুন আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী সংসদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ‘দুই অর্থনীতি’ তত্ত্বের আলোকে ১১-দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১১-দফা দাবি কার্যত ভবিষ্যৎ ৬-দফা দাবিরই ভিত্তি রচনা করে।
১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ। পূর্ববাংলা অরক্ষিত ও পশ্চিমাঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন।
১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তি সনদ ৬-দফা কর্মসূচি উত্থাপন করেন। ৬-দফা বিরোধিতা করে মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশের আওয়ামী লীগ ত্যাগ।
১৯৬৬ সালের ১৮, ১৯ ও ২০ মার্চ হোটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ কাউন্সিলে ৬-দফা অনুমোদন। আওয়ামী লীগের নতুন নেতৃত্ব শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি ও তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত। সারাবাংলায় শেখ মুজিবুর রহমানের ঝটিকা সফর। একাধিকবার গ্রেফতার, মুক্তি আবার গ্রেফতার।
১৯৬৬ সালের ৮ মে আইয়ুব সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে জামিন অযোগ্য নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে। একই সাথে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদসহ সারাদেশে বিপুল সংখ্যক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী গ্রেফতার। ৭ মে থেকে ১০ মে-র মধ্যে সারাদেশের সাড়ে ৩ হাজার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। ইতোমধ্যে ওয়ার্কিং কমিটির পূর্ব নির্ধারিত সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ৬-দফা দাবিতে আওয়ামী লীগ দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করে। সর্বাত্মক হরতালে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশ অচল হয়ে পড়ে। হরতালে ঢাকার রাজপথ শ্রমিক-জনতার রক্তে রঞ্জিত হয়। শ্রমিক মনু মিয়াসহ কমপক্ষে ১০ জন নিহত হন।
১৯৬৬ সালের ৭ জুনের হরতালের পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে বহুমুখী আক্রমণ ও ষড়যন্ত্র চালাতে থাকে। ১৩ জুনের মধ্যে আওয়ামী লীগের তৃতীয় সারির নেতারাও গ্রেফতার হয়ে যান। ৬-দফার সমর্থক দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে ১৫ আগস্ট গ্রেফতার করা হয়। ১৬ আগস্ট ইত্তেফাক নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।
১৯৬৭ সালের ১৯ আগস্ট হোটেল ইডেন প্রাঙ্গণে আওয়ামী লীগের একটি কাউন্সিল অধিবেশন হয়। নেতৃত্ব পরিবর্তনের জন্য নয়; বরং দলকে চাঙ্গা রাখার জন্যই এই কাউন্সিল ডাকা হয়েছিল। কাউন্সিল সর্বসম্মতিক্রমে ৬-দফায় প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে।
১৯৬৭ সালের ২৭ আগস্ট ঢাকায় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত। শেখ মুজিবুর রহমানকে সভাপতি এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে একটি নতুন কমিটি গঠিত।
১৯৬৮ সালের ১৯ ও ২০ অক্টোবর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের দুদিনব্যাপী কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এই কাউন্সিল নেতা-কর্মীদের ভয়ভীতি কাটাতে এবং নতুন করে আন্দোলন গড়ে তুলতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।
১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি শেখ মুজিবকে প্রধান আসামি করে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব গং’ তথা আগরতলা মামলা দায়ের। শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে স্থানান্তর। বিচার শুরু।
আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলনের লক্ষ্যে ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে গঠিত হয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। সংগ্রাম পরিষদ ৬-দফাভিত্তিক ১১-দফা দাবিনামা প্রণয়ন করে।
১৯৬৯ সালের ১৭ জানুয়ারি ১১-দফা দাবিতে ছাত্র-গণ-আন্দোলনের শুরু। ২৪ জানুয়ারি গণ-অভ্যুত্থান। গণজাগরণের ব্যাপকতা। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ প্রভৃতি বিরোধী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে গঠন করে ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি বা ডাক। তবে আন্দোলনের নেতৃত্ব থাকে ছাত্র-সমাজের হাতে। ২২ ফেব্রুয়ারি নিঃশর্তভাবে কারাগার থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তিলাভ এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত ছাত্রজনতার বিশাল সমাবেশে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত।
১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ আইয়ুবের পতন। ইয়াহিয়ার ক্ষমতা গ্রহণ এবং পুনরায় মার্শাল ল’ জারি।
১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের ‘বাংলাদেশ’ নামকরণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সামরিক শাসনের মধ্যেই পাকিস্তানে নির্বাচনের ঘোষণা। এলএফও জারি। আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত। ১৯৭০ সালের ৭ জুন বঙ্গবন্ধু নির্বাচনকে ৬-দফার পক্ষে ‘গণভোট’ বলে ঘোষণা করেন।
১৯৭০ সালের ৪ ও ৫ জুন আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। হোটেল ইডেন প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত এই কাউন্সিলে ১ হাজার ১৩৮ কাউন্সিলর উপস্থিত ছিলেন। কাউন্সিলে সভাপতিত্ব করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কাউন্সিলে শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি ও তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৭০ সালের ৬ জুন হোটেল ইডেন প্রাঙ্গণে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় এবং এই কাউন্সিলে শেখ মুজিবুর রহমানকে সভাপতি এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত। পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদে নির্ধারিত ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আওয়ামী লীগের জয়লাভ। ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ৩১০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের ২৮৭টি আসনে জয়লাভ। সংরক্ষিত ১০টি মহিলা আসনও পায় আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু স্বীকৃতি অর্জন। তিনি পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা নির্বাচিত।
১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি বিশাল জনসভায় আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শপথবাক্য পাঠ করান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ ইয়াহিয়া কর্তৃক অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদসভা স্থগিত ঘোষণা। প্রতিবাদে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ এই ১-দফা দাবিতে উত্তাল বাংলাদেশ। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা উত্তোলন।
১৯৭১ সালের ৩ মার্চ, পল্টনের জনসভায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি জাতীয় সংগীত হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ৫ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সারা বাংলাদেশে পাঁচ দিনব্যাপী হরতাল পালন।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্সের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে : ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ঘোষণা। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির দিক-নির্দেশনা প্রদান। অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণা। ৭ মার্চের পর পূর্ব বাংলার প্রশাসনিক কাঠামোর নেতৃত্ব চলে যায় বঙ্গবন্ধুর হাতে। ১৪ মার্চ পাকিস্তানের সামরিক সরকার ১৫ নম্বর সামরিক আদেশ জারি করে সকল বেসামরিক লোককে চাকরিতে ফিরে আসতে নির্দেশ প্রদান করলে বঙ্গবন্ধু পাল্টা ৩৫-দফা নির্দেশনামা ঘোষণা করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রশাসন হাতে নিয়ে অসহযোগ আন্দোলন পরিচালনার জন্য ৩৫টি নির্দেশ জারি করেন। শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে নির্দেশাবলী প্রণয়ন এবং তা বঙ্গবন্ধু অনুমোদন করেন।
১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে পূর্ব বাংলার সর্বত্র স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হয়। এদিন সর্বত্র মুক্ত আকাশে পতপত করে উড়তে থাকে স্বাধীন সোনার বাংলার নতুন পতাকা।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ইয়াহিয়ার সাথে আলোচনা ভেঙে যায়। ওই দিন রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পাকহানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের শুরু। সারাদেশে বাঙালির প্রতিরোধ যুদ্ধ।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে গ্রেফতার হওয়ার পূর্বমুহূর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ইপিআরের ওয়্যারলেস মারফত গোপনে ওই ঘোষণা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু পাকহানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধের নির্দেশ দেন।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা এক সভায় মিলিত হন। বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘোষণা। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর প্রবাসী সরকারের শপথ গ্রহণ। তারা ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ প্রণয়ন করেন, ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাকে অনুমোদন দেন এবং বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন করেন। গঠিত হয় মুক্তিবাহিনী। বঙ্গবন্ধু সর্বাধিনায়ক।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননকে ‘মুজিবনগর’ (অস্থায়ী রাজধানী) ঘোষণা করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালিত। জাতীয় সংগীত হিসেবে প্রথম ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি গাওয়া হয়।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর কাছে ৯৩ হাজার পাকবাহিনীর সদস্যের আত্মসমর্পণ। ৩০ লাখ শহিদের আত্মদান এবং ৩ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় অর্জন। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় মুজিবনগর সরকার সদস্যদের ঢাকায় আগমন এবং দায়িত্ব গ্রহণ।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন।
১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে নতুন সরকার গঠন করেন। শুরু হয় যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন।
১৯৭২ সালের ৭ ও ৮ এপ্রিল স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিলে সর্বসম্মতিক্রমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন জিল্লুর রহমান।
১৯৭২-৭৫ : জাতীয় পুনর্গঠন, সাফল্য ও অর্জন
১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান অনুমোদন।
১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন। আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়।
স্বাধীনতার পর আওয়ামী সরকারের অর্জন :
–যুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত সেতু, রেলপথ, বন্দর, কল-কারখানা, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, হাট-বাজার পুনর্নির্মাণ।
–ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী ১ কোটি শরণার্থী এবং অভ্যন্তরীণ ৩ কোটি ঘরছাড়া মানুষের পুনর্বাসন।
১৯৭৪ সালের ১৮, ১৯ ও ২০ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এই কাউন্সিলে এএইচএম কামারুজ্জামানকে আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং জিল্লুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সদস্যগণ দলের কর্মকর্তা পদে থাকতে পারবেন না বিধায় বঙ্গবন্ধু সভাপতির পদত্যাগ করেন। সৃষ্টি হয় গণতন্ত্র চর্চায় নতুন ঐতিহ্য।
১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেন এবং জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠন করেন। গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে সেনাবাহিনীর একটি বিচ্ছিন্ন অংশকে নিয়ে খুনি মোশতাক-রশিদ-ফারুক চক্রের অভ্যুত্থান এবং বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা। পাকিস্তানি ধারায় দেশকে ফিরিয়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র।
মোশতাক আহমেদ স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি, সামরিক আইন জারি, জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনী প্রধান। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার। ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি।
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকে হত্যা।
১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই রাজনৈতিক দল বিধি জারি করা হয়। প্রচণ্ড ও হিংস্র দমননীতির শিকার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এই সীমিত গণতান্ত্রিক সুযোগ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। দল পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে ২৫ আগস্ট ঢাকায় দলের সাবেক কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদসহ নেতৃবৃন্দের বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। ২৫ আগস্টের বর্ধিত সভায় আরও সিদ্ধান্ত হয় দলের পূর্ণাঙ্গ কাউন্সিল সাপেক্ষে ১৯৭৫ সালের ৬ জুন পর্যন্ত যে কার্যনির্বাহী সংসদ ছিল সেটিই সংগঠনের কাজ চালিয়ে যাবে। ১৯৭৪ সালে গঠিত নির্বাহী সংসদের সভাপতি এএইচএম কামারুজ্জামান ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ নিহত হন। সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ তখন কারাবন্দি। এমতাবস্থায় সিনিয়র সহ-সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও মহিলাবিষয়ক সম্পাদক সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করা হয়।
১৯৭৭ সালের ৩ ও ৪ এপ্রিল ঢাকার হোটেল ইডেন প্রাঙ্গণে দলীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত। সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে আহ্বায়ক করে ১০ দিনের মধ্যে ৪৪ সদস্য বিশিষ্ট সাংগঠনিক কমিটির সদস্যদের নাম ঘোষণার দায়িত্ব দেওয়া হয়। জোহরা তাজউদ্দীন ১৫ এপ্রিল সাংগঠনিক কমিটির সদস্যগণের নাম ঘোষণা করেন।
১৯৭৭ সালের ৩০ মে জিয়া তার ক্ষমতাকে বৈধতার ছাপ মারার জন্য দেশব্যাপী গণভোটের আয়োজন করেন। আওয়ামী লীগ গণভোট বর্জন করে।
১৯৭৮ সালের ৩, ৪ ও ৫ এপ্রিল তিন দিনব্যাপী আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। আবদুল মালেক উকিলকে সভাপতি ও আবদুর রাজ্জাককে সাধারণ সম্পাদক করে নতুন কমিটি গঠন করা হয়।
১৯৭৮ সালের ২৩ নভেম্বর হোটেল ইডেন প্রাঙ্গণে আওয়ামী লীগের বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে পাল্টা আওয়ামী লীগ গঠনের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলে গণতান্ত্রিক আন্দোলন বেগবান করতে ভূমিকা রাখে ওই কাউন্সিল।
১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি হোটেল ইডেন প্রাঙ্গণে তিন দিনব্যাপী আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ এই কাউন্সিলে দলে নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণ এবং দলকে অধিকতর শক্তিশালী ও সংহত করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনাকে তার অনুপস্থিতিতে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। আবদুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক পুনর্নির্বাচিত হন। এই কাউন্সিলেই প্রথম গঠনতন্ত্র সংশোধন করে সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারক ‘সভাপতিমণ্ডলী’ গঠিত হয়।
১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল এরশাদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল।
১৯৮৩ সালের ১১ জানুয়ারি কুখ্যাত রাজাকার আবদুল মান্নান আহূত ‘জমিয়াতুল মোদাররেসিন’ নামক মাদ্রাসা শিক্ষকদের এক সমাবেশে জেনারেল এরশাদ ২১ ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবস ও শহিদ মিনার সম্পর্কে ধৃষ্টতাপূর্ণ কটূক্তি করেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ৩০ জানুয়ারি ১৫টি রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধভাবে মহান ২১শে ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ১৫-দলীয় ঐক্য জোট।
১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে মৌন মিছিল করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি প্রদানের কর্মসূচিতে –ড. কামাল হোসেনের বাসভবনে বৈঠকরত অবস্থায় সেনাবাহিনী আওয়ামী লীগের শেখ হাসিনা, আবদুস সামাদ আজাদ, আবদুল মান্নান, ড. কামাল হোসেন, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, আবদুল জলিল, বেগম মতিয়া চৌধুরী, মহিউদ্দিন আহমেদ, মো. রহমত আলী, ডা. এসএ মালেক, গোলাম আকবর চৌধুরী, সাহারা খাতুন, অধ্যাপক মানিক গোমেজ, সিপিবি-র মোহাম্মদ ফরহাদ, মঞ্জুরুল আহসান খান, একতা পার্টির সৈয়দ আলতাফ হোসেন, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, সাম্যবাদী দলের দীলিপ বড়ুয়া ও বাসদের খালেকুজ্জামান প্রমুখ ১৫-দলের নেতাদের গ্রেফতার করে। সেনা সদস্যরা নেতৃবৃন্দকে চোখ বেঁধে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করে। ওই দিন সন্ধ্যা থেকে সান্ধ্য আইন বলবৎ করা হয়। সারাদেশে সৃষ্ট উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশেই ঐক্যবদ্ধভাবে ২১শে ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবস পালিত হয়। ১৫-দলের উদ্যোগে রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিটি সর্বজনীন দাবিতে পরিণত হয়। জনমতের চাপে অবশেষে ১ মার্চ ১৯৮৩ শেখ হাসিনাসহ গ্রেফতারকৃত ২৭ নেতা মুক্তিলাভ করেন।
পুলিশের গুলিতে জয়নাল, জাফর, কাঞ্চন, মোজাম্মেল ও দীপালি সাহা প্রমুখ পাঁচ ছাত্র নিহত হন। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ ১৫-দলের নেতৃবৃন্দ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটে যান। ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র-হত্যার প্রতিবাদে বন্দর নগরী চট্টগ্রামে হরতাল পালিত হয়।
১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল থেকে ঘরোয়া রাজনীতির অনুমতি দেওয়া হয় এবং ১৪ নভেম্বর দেশে প্রকাশ্য রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহৃত হয়। ১৯৮৩ সাল থেকেই সামরিক শাসন ও স্বৈরতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনকে অভিন্ন লক্ষ্যে এবং অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে যুগপৎ আন্দোলনের ধারায় সংগঠিত করার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ উদ্যোগী ভূমিকা পালন করে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৫-দল ও বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গঠিত সাত-দলীয় জোট দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর একটি অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচি প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়। ১৯৮৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর উভয় জোটের সর্বসম্মত ৫-দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
১৯৮৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্র মিছিলের ওপর ট্রাক চালিয়ে হত্যা করা হয় সেলিম-দেলোয়ার নামে দুই ছাত্রলীগ কর্মীকে। ১ মার্চ আদমজীতে শ্রমিক নেতা তাজুলকে এবং ২৭ সেপ্টেম্বর হরতালের দিন কালীগঞ্জে সাবেক এমপি ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিনকে সরকারি জনদলের গুণ্ডাবাহিনী লেলিয়ে দিয়ে হত্যা করা হয়। ১৪ অক্টোবর মানিক মিয়া এভিনিউতে ১৫-দলের উদ্যোগে স্মরণকালের বৃহত্তম মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। মহসমাবেশ থেকে ১৫-দল ২১-দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে।
বিরোধী দলের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মুখে একবার উপজেলা নির্বাচন তারিখ ও সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেও পিছিয়ে আসতে বাধ্য হন এরশাদ। পরে সামরিক আইনের কড়াকড়ি পুনর্বহাল, রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ বন্ধ ঘোষণা এবং রাজনৈতিক নেতাদের আটক রেখে ১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ এরশাদ তার ১৮দফা কর্মসূচির পক্ষে গণভোট অনুষ্ঠান করেন।
১৯৮৫ সালের ১ অক্টোবর থেকে ঘরোয়া রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। পর্যায়ক্রমে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে প্রকাশ্য সভা-সমাবেশের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়।
১৯৮৬ সালের ৭ মে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে ১৫-দল ও সাত-দলের মধ্যে ঐকমত্য হয়। সিদ্ধান্ত হয় সামরিক শাসন অবসানের মূল লক্ষ্য হাসিলের উদ্দেশ্য সামনে রেখে দুই জোট ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশ নেবে। ১৫-দল ১৮০টি আসনে এবং সাত-দল ১২০টি আসনে প্রার্থী দিয়ে জাতীয় পার্টিকে মোকাবিলা করবে বলে ঐকমত্য হয়। কিন্তু হঠাৎই রহস্যজনক কারণে সাত-দল নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেয়। ১৫-দলের অন্তর্ভুক্ত ওয়ার্কার্স পার্টি, বাসদ, শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল, সাম্যবাদী দলও নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকার কথা ঘোষণা করে। স্বভাবতই এরশাদ ও জাতীয় পার্টি এতে উৎসাহিত হয়। ১৫-দল নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। সন্ত্রাস, ভোটকেন্দ্র দখল, টাকার ছড়াছড়ি এবং প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক ভূমিকার মধ্যেও ১৯৮৬ সালের ৭ মে তৃতীয় জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এত কিছু করেও ১৫-দলের বিজয় ঠেকাতে না পেরে ৭ তারিখ রাতে আকস্মিকভাবে নির্বাচনের ফল ঘোষণা বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ ৩২ ঘণ্টা গণমাধ্যমে ফল ঘোষণা বন্ধ রাখার পর মিডিয়া ক্যুর মাধ্যমে ফল উল্টে দিয়ে বিজয়ী ঘোষণা করা হয় জাতীয় পার্টিকে।
১৯৮৬ সালের ১০ জুলাই সংসদ অধিবেশন বসলেও সামরিক আইন বহাল থাকে। সামরিক আইন বহাল রেখেই ১৯৮৬-এর ১৫ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের দিন ধার্য করা হয়। সামরিক শাসকরা বিরোধী দলগুলোর হরতাল, সমাবেশ এবং জনগণের অংশগ্রহণের তোয়াক্কা না করেই গায়ের জোরে ১৫ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠান করে। ১ নভেম্বর সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী উত্থাপন করা হয় জাতীয় সংসদে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫-দল সপ্তম সংশোধনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সংসদে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে। বিরোধিতার মুখেও ১০ নভেম্বর সপ্তম সংশোধনী পাস করা হয়। সপ্তম সংশোধনীর দ্বারা ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে জারিকৃত সকল সামরিক ফরমান, আদেশ, অধ্যাদেশ এবং শাসকদের সকল কৃতকর্ম ‘বৈধতা’ অর্জন করে।
* ১৯৮৬-এর ১০ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে সামরিক আইন প্রত্যাহারের পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
১৯৮৭ সালের ১, ২ ও ৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের চতুর্দশ জাতীয় কাউন্সিল। কাউন্সিলে সর্বসম্মতিক্রমে শেখ হাসিনাকে সভাপতি ও সাজেদা চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক করে নতুন কার্যনির্বাহী সংসদ গঠিত হয়।
১৯৮৭ সালের ২৮ অক্টোবর দুই বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মধ্যে বৈঠক হয়। ১৫-দল, সাত-দল এবং ইতোমধ্যে গড়ে ওঠা পাঁচ-দলীয় বাম জোট যুগপৎ আন্দোলনের ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছায়। ১০ নভেম্বর বিরোধী দলগুলোর উদ্যোগে ঢাকা অভিযানের কর্মসূচি নেওয়া হয়। সরকার কর্মসূচি ঠেকাতে ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু ১০ নভেম্বর ঢাকার সকল প্রবেশ পথ সরকার বন্ধ করে দিলেও হাজার হাজার মানুষ ঢাকায় সমবেত হয়। সেদিন পুলিশের গুলিবর্ষণে ঢাকার জিরো পয়েন্টের কাছে শরীরে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরতন্ত্র নিপাত যাক’ লিখে বিক্ষোভরত যুবলীগ কর্মী নূর হোসেন ও কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর থেকে আসা সিপিবি-র কর্মী আমিনুল হুদা টিটু নিহত হয়। সরকার শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে ১১ নভেম্বর গৃহে অন্তরীণ করে এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে ব্যাপক ধরপাকড় করে। বিরোধী দলের আহ্বানে ১১ থেকে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত অর্ধদিবস এবং ২১ নভেম্বর থেকে একটানা ৪৮ ঘণ্টার হরতাল বাংলাদেশকে অচল করে দেয়। ২৭ নভেম্বর জেনারেল এরশাদ সারাদেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন।
১৯৮৮-এর ২৪ জানুয়ারি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে চট্টগ্রামে ১৫-দলের মিছিলে পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলিতে ৯ জন নিহত হয়। ১৯৮৮ সালের ২৩ মার্চ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত ছোট-বড় প্রায় সকল দল এই নির্বাচন বর্জন করে।
১৯৮৯ সালের ১০ আগস্ট শেখ হাসিনার প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে তার বাসভবনে ফ্রিডম পার্টির দুষ্কৃতিকারীরা হামলা চালায়। সারাদেশে এ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
১৯৯০ সালের ৫ জুন শেখ হাসিনা অবিলম্বে এরশাদের পদত্যাগ দাবি করেন এবং নতুন করে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের আহ্বান জানান। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫-দল (৮ দল) আন্দোলনের কর্মসূচি দেয়। ১৯৯০-এর ১০ অক্টোবর বিরোধী জোট ও দলগুলোর সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে পুলিশের গুলিবর্ষণে ৫ জন নিহত হয়।
১৯৯০ সালের ১৯ নভেম্বর ১৫, ৭ ও ৫-দল, অর্থাৎ তিন জোট এরশাদের পদত্যাগ এবং সাংবিধানিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখে ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি ফর্মুলা, যা ‘তিন জোটের রূপরেখা’ হিসেবে পরিচিত ঘোষণা করে।
১৯৯০-এর ২৪ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর অব্যাহত ছাত্র ধর্মঘট, পেশাজীবীদের আন্দোলন, হরতাল-সমাবেশ-প্রতিবাদের মুখে শাসকগোষ্ঠী মরিয়া আঘাত হানে। ২৭ নভেম্বর বিএমএ নেতা ডা. শামসুল আলম মিলনকে এরশাদের সন্ত্রাসী গুণ্ডারা গুলি করে হত্যা করে। এই দিন বিকালে শেখ হাসিনাকে আটক করে গৃহবন্দি রাখা হয়। ৪ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকায় অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থান সৃষ্টি হয়। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ লাখ লাখ মানুষ রাজপথে নেমে আসে। শেখ হাসিনা ১৫-দলের সমাবেশ থেকে ‘এই মুহূর্তে এরশাদের পদত্যাগ’ দাবি করেন। জেনারেল এরশাদ পদত্যাগের ঘোষণা দেন। ৫ ডিসেম্বর তিন জোট প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব করেন। অবশেষে তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী ৬ ডিসেম্বর এরশাদ বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের কাছে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। অবসান ঘটে দীর্ঘ ৯ বছরের স্বৈরশাসনের।
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে পঞ্চম জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী জোটভুক্ত দলগুলো ৯৯টি আসন লাভ করে। বিএনপি পায় ১৪২টি আসন। তারপরও সরকার গঠনে বিএনপিকে জামাতের ১৮ সদস্যের সমর্থন নিতে হয়।
১৯৯১ সালের ৩১ জুলাই আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বাধীন বাকশাল আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, ১৪ আগস্ট থেকে তা কার্যকর হয়। অন্যদিকে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে দলের অভ্যন্তরে আবার উপদলীয় কর্মকাণ্ড শুরু হয়। ১৯৯২ সালের ২১ জুন ড. কামাল হোসেন ৪৮ সদস্য বিশিষ্ট ‘গণতান্ত্রিক ফোরাম’ গঠন করেন। এই গণতান্ত্রিক ফোরামই ১৯৯৩ সালের ২৩ আগস্ট ‘গণফোরাম’ নামে রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হয়।
১৯৯২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি গোলাম আযম ও তার সহযোগীদের বিচারের লক্ষ্যে জাহানারা ইমামকে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় জাতীয় সমন্বয় কমিটি। সরকার জাহানারা ইমামসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে।
১৯৯২ সালের ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেখ হাসিনাকে সর্বসম্মতভাবে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। আর জিল্লুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে কাউন্সিল।
মিরপুর ও মাগুরা উপনির্বাচনে বিএনপির ভোট ডাকাতি ও কারচুপির পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ ‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার’-এর অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি উত্থাপন করে। বিরোধী দলগুলো এই দাবি সমর্থন জানায়। গড়ে ওঠে আন্দোলন।
১৯৯৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনা উত্তরবঙ্গে গণসংযোগের জন্য ট্রেন অভিযাত্রা শুরু করেন। ২৩ সেপ্টেম্বর ঈশ্বরদী ও নাটোরে শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ, বোমাবাজি, হামলা ও সন্ত্রাসী তাণ্ডব চালায় বিএনপি ক্যাডাররা। ৬ ডিসেম্বর সংসদের বিরোধী দলগুলো পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়। ২৮ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ থেকে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামাত ও এনডিপি দলীয় সংসদ সদস্যগণ একযোগে পদত্যাগ করেন।
১৯৯৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে আওয়ামী লীগের বিশেষ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি কর্তৃক একদলীয় ভোটারবিহীন নির্বাচন। তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে খালেদা সরকার পদত্যাগ করে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর।
১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
১৯৯৭ সালের ৬ ও ৭ মে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিল শেখ হাসিনাকে সভাপতি ও জিল্লুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক পুনর্নির্বাচিত করে।
২০০০ সালের ২৩ জুন পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগের বিশেষ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়।
২০০১-০৬, ১ অক্টোবর কারচুপির নির্বাচন। বিএনপি-জামাত জোটের ক্ষমতা দখল। হত্যা, নির্যাতন, দুর্নীতি ও দুঃশাসনের কালো অধ্যায়।
২০০২ সালের ২৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল। কাউন্সিলে শেখ হাসিনা গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। কাউন্সিলের ভেতর দিয়ে আওয়ামী লীগের নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়। শেখ হাসিনা সভাপতি হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হন। সাধারণ সম্পাদক হন মো. আবদুল জলিল এমপি।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা। আইভি রহমানসহ ২৪ নেতাকর্মী নিহত। শেখ হাসিনার কানের পর্দা ফেটে গিয়ে আহত।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে বিএনপি-জামাতের নীলনকশার নির্বাচন বাতিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্বঘোষিত প্রধানের পদ থেকে ইয়াজউদ্দিনের পদত্যাগ। জরুরি অবস্থা ঘোষণা।
ড. ফখরুদ্দিনের নেতৃত্বে নতুন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণ করে। এ সময় ড. মুহম্মদ ইউনূসের রাজনৈতিক দল গঠনের ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে অপসারণের উদ্দেশ্যে ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ শুরু হয়। এ সময় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সফর শেষে দেশে ফিরে আসার সময় নিষেধাজ্ঞা জারি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সরকার ঘোষণা করে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। কোনো বিমান তাকে বহন করতে পারবে না। কিন্তু সাহসিকা জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেন; ছুড়ে দেন পাল্টা চ্যালেঞ্জ। প্রতিবাদের ঝড় ওঠে বিশ^ব্যাপী। অবশেষে হরকার পিছু হটতে বাধ্য হয়। ২০০৭ সালের ৭ মে প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন জননেত্রী শেখ হাসিনা।
২০০৭ সালের ১৬ জুলাই জননেত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু গণ-আন্দোলনের মুখে মাইনাস টু ফর্মুলা ব্যর্থ হয় শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সরকার। ২০০৮ সালের ১১ জুন প্যারোলে মুক্তি পাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি কারান্তরীণ থাকেন। তখন চিকিৎসার জন্য বিদেশ গমন করেন তিনি। চিকিৎসা শেষে ৪ ডিসেম্বর স্বদেশে ফিরে আসেন তিনি। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের মুখে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
নির্বাচনের প্রাক্কালে ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের নির্বাচনে ইশতেহার ‘দিনবদলের সনদ : রূপকল্প-২০২১’ উপস্থাপন করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি জননেত্রী শেখ হাসিনা।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একই সংসদের এক-তৃতীয়াংশ আসনে জয়লাভ করে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট পায় মোট আসনের তিন-চতুর্থাংশ। ৩০০টির মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২৬৪টি আসন লাভ করে।
২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করে মহাজোট সরকার।
২০০৯ সালের ২৪ জুলাই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অষ্টাদশ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারে। কাউন্সিলে পরিবর্তিত বাস্তবতার আলোকে নতুন ঘোষণাপত্র গ্রহণ করা হয়। কাউন্সিলে শেখ হাসিনা সভাপতি এবং সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
২০১২ সালের ২৯ ডিসেম্বর দলের আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিলে শেখ হাসিনা সভাপতি এবং সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে ‘শান্তি গণতন্ত্র উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’ শিরোনামে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। যেখানে সংযুক্ত হয় নতুন প্রেক্ষিত পরিকল্পনা রূপকল্প-২০৪১। ২০৪১ সালের বাংলাদেশকে উন্নত সমৃদ্ধ শান্তিপূর্ণ, সুখী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা করা হয়।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন জননেত্রী শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বের কল্যাণে দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। জাতি পায় বিচারহীনতার কলঙ্ক থেকে মুক্তি।
বিডিআর বিদ্রোহের শান্তিপূর্ণ সমাধান। ষড়যন্ত্র ব্যর্থ।
সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক ১৯৭৫-পরবর্তী সামরিক আইন জারি, সামরিক ফরমান বলে সংবিধান সংশোধন ও জিয়া-এরশাদের সামরিক শাসনকে অবৈধ ঘোষণা। ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী গৃহীত। ১৯৭২-এর সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদসহ মৌলিক রাষ্ট্রীয় নীতিমালা পুনর্বহাল। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ সংযোজিত।
২০১৬ সালের ২২ ও ২৩ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে জননেত্রী শেখ হাসিনা সভাপতি এবং ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন। এই কাউন্সিলের মাধ্যমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য সংখ্যা ৭১ থেকে ৮১-তে উন্নীত করা হয়। একইভাবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অন্যান্য শাখার কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য সংখ্যাও বৃদ্ধি করা হয় এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচন মনোনয়ন বোর্ড গঠনসহ বেশকিছু সংশোধনী ও নতুন ধারা সংযোজিত হয়।
২০২০ সালের ১০ জানুয়ারি জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে ছোট বোন শেখ রেহানাকে সাথে নিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রাণপুরুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ‘মুজিববর্ষ’র ‘ক্ষণগণনা’ উদ্বোধন করেন।
২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘির ময়দানে আওয়ামী লীগের জনসভায় হামলা চালিয়ে ২৪ নেতাকর্মীকে হত্যার ঘটনায় ৫ জনের ফাঁসির আদেশ প্রদান করেন আদালত।
২০২০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অমর একুশে গ্রন্থমেলা উদ্বোধন অনুষ্ঠানের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা ভ্রমণবিষয়ক গ্রন্থ ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
২০২০ সালের ২০ মার্চ ছোট বোন শেখ রেহানাকে সাথে নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রাণপুরুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ‘মুজিববর্ষ’র আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই দিন পৃথিবীর দেশে দেশে বাঙালি জাতির মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালিত হয়।
২০২০ সালের ৭ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চকে ঐতিহাসিক দিবস ঘোষণার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়।
২০২১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ কর্তৃক স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি অর্জন করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অগ্রসরমান বাংলাদেশ।
২০২১ সালের ১৭ ও ২৬ মার্চ মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর ঐতিহাসিক ক্ষণকে স্মরণীয় করে রাখতে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় ১০ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা আয়োজন করা হয়।
২০২২ সালের ২৫ জুন স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা।
২০২২ সালের ২৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এই কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা টানা দশমবার সভাপতি এবং ওবায়দুল কাদের এমপি টানা তৃতীয় মেয়াদে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
২০২২ সালের ২৯ ডিসেম্বর ঢাকায় মেট্রোরেল উদ্বোধন করেন সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর কর্ণফুলি নদীর তলদেশে ট্যানেল উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা।
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ২২টি আসনে জয়লাভ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। টানা চতুর্থবার ও পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এমপি।
সারাবাংলা/এনআর/একে