পানি কমছে তিস্তায়, ভাঙন আতঙ্কে নির্ঘুম রাত পাড়ের মানুষের
২৪ জুন ২০২৪ ১৩:১৮
রংপুর: রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরছাড়া উপজেলায় কমতে শুরু করেছে তিস্তার পানি। এতে গত কয়েকদিন থেকে ডুবে থাকা রাস্তা-ঘাট ভেসে উঠেছে। তবে পানি কমলেও নতুন করে দেখা দিয়েছে ভাঙন। পানির ঢেউ ধাক্কা লাগায় ভাঙছে নদীর তীর ও বসতভিটা। আপাতত পানির সঙ্গে যুদ্ধের অবসান হলেও এখন নতুন যুদ্ধ ভাঙন ঠেকানো। তাই আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটছে পাড়ের মানুষের। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ভাঙনকবলিত এলাকায় নদী ভাঙনরোধে চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে তিস্তা নদীতে অব্যাহতভাবে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছিল গত কয়েকদিন থেকে। বিশেষ করে রংপুরের কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি গত শুক্রবার (২১ জুন) সকাল ৬টায় বিপদসীমার ৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে নদীর তীরবর্তী ও চরাঞ্চলের কমপক্ষে ১০টি গ্রামে প্রবল বেগে পানি প্রবেশ করে। এতে চরাঞ্চলের ১১টি গ্রাম তলিয়ে যাওয়ায় প্রায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে।
বন্যার পানিতে শত শত হেক্টর জমিতে থাকা বাদাম ও মরিচের ক্ষেত তলিয়ে যায়। তবে গতকাল রোববার থেকে তিস্তা নদীর কাউনিয়া পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, তবে পানি কমলেও ভাঙনের আশঙ্কা আছে।
জানা গেছে, কাউনিয়ার ভাঙন কবলিত এলাকা বালাপাড়া ও টেপামধুপুর ইউনিয়নের হরিচরণ শর্মা, আজমখাঁ, হযরত খাঁ, বিশ্বনাথের চর, চরগনাই, ঢুষমারা, চর রাজিব, গোপিঙ্গা, গদাই, পাঞ্জরভাঙ্গা, তালুক শাহবাজপুরে গেল কয়েকদিন থেকে প্রবল বেগে পানি প্রবেশ করায় হাজার হাজার মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিভিন্ন বাঁধে আশ্রয় নেন। তবে পানি কমে আসায় তারা আবারও নিজ গ্রামে ফিরেছেন। তবে অনেকেরই ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে, বিলীন হয়েছে জমি।
টেপামধুপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম জানান, তিস্তা নদীর পানি এবার কাউনিয়া উপজেলায় রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় তিস্তা নদীর তীরবর্তী অঞ্চল ও চরাঞ্চলের গ্রামগুলোতে প্রবল বেগে পানি ঢুকে বাড়ি-ঘর প্লাবিত হয়। অর্ধশতাধিক ছাগল, ভেড়া প্রবল স্রোতে ভেসে যাওয়ায় বাসিন্দারা যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেটা অপূরণীয়। তবে পানি কমে আসায় নিজ উদ্যোগে আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন বাসিন্দারা।
সোমবার (২৪ জুন) উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়নের গদাই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, শতাধিক পরিবার বসতভিটা মেরামতে ব্যস্ত সময় পার করছেন, তাদের মধ্যে একজন আব্দুল গনি। তিনি জানান, বসতভিটার বাড়িঘর কোথায় সরিয়ে নেবেন, তা নিয়ে বিপাকে আছেন। এক বছরে প্রায় ৭০ শতাংশ আবাদি জমি নদীতে বিলীন হয়েছে। এখন মাত্র পাঁচ শতক জমির ওপর বসতভিটা আছে। এখানে-ওখানে কাজ করে সংসার চলে।
জানা গেছে, নদী ভাঙনকবলিত উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়নের গদাই এলাকায় এক মাস আগে ১৮০ মিটার স্থানে নদীর ভাঙনরোধে দুই হাজার বালুর বস্তা ফেলা হয়। স্রোতের তোড়ে বেশিরভাগ বস্তা ভেসে গেছে। গদাই গ্রামে ৪০০ পরিবারের মধ্যে শতাধিক পরিবারের বাড়ি-ঘর ভাঙনের মুখে পড়েছে।
বালাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আনসার আলী বলেন, ‘পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে নদীর ভাঙন তীব্র হচ্ছে। মানুষজন নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন। ভাঙন প্রতিরোধে বালুর বস্তা ফেলে রক্ষা করার চেষ্টা করা হলেও তা ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। ইতিমধ্যে অনেক বালুর বস্তাও নদীতে বিলীন হয়েছে।’
পানি উন্নয়ন বোর্ড রংপুর কার্যালয়ের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আহসান হাবিব বলেন, ‘নদী ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করা হয়েছে। এক মাস আগে এক হাজার বালুর বস্তা ফেলা হয়েছে। ভাঙনরোধে চেষ্টা চলানো হচ্ছে।’
রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান বলেন, ‘নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল ও চরে থাকা মানুষজনের ভোগান্তি লাঘবে মাঠ পর্যায়ে উপজেলা প্রশাসন কাজ করছে।’
রংপুর বিভাগীয় কমিশনার জাকির হোসেন বলেন, ‘প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক নদীপাড়ের পরিস্থিতির খোঁজখবর রাখা হচ্ছে।’
পরিবেশবাদীরা বলছেন, শুষ্ক মৌসুমে পানির জন্য হাহাকার আর বর্ষায় সেই পানিতেই সর্বনাশ– এই হলো তিস্তা। ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহার ও অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেওয়ার খেলায় একপ্রকার যুদ্ধ করেই এখন বাঁচতে হচ্ছে তিস্তা পাড়ের লাখো মানুষকে।
তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রস্তাবিত তিস্তা মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ভাটি থেকে তিস্তা-যমুনার মিলনস্থল পর্যন্ত নদীর প্রস্থ কমিয়ে ৭০০ থেকে ১০০০ মিটারে সীমাবদ্ধ করা হবে। নদীর গভীরতা বাড়বে ১০ মিটার। নদীশাসনের মাধ্যমে তিস্তা নদীকে সঠিক ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা, ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে পানিবহন ক্ষমতা বাড়ানো, নদীর দুই পাড়ে বিদ্যমান বাঁধ মেরামত করা, দুই পারে মোট ১০২ কিলোমিটার নতুন বাঁধ নির্মাণ করা হবে। তবে সেই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের স্বপ্ন কবে পূরণ হবে সেটিও অজানা।
সারাবাংলা/এমও