মোংলা-যশোর-বেনাপোল রুটে ট্রেনের শিডিউলে অসন্তুষ্ট যাত্রীরা
২৫ জুন ২০২৪ ০৮:৪৮
বাগেরহাট: পুরাতন বগি এবং ইঞ্জিন দিয়েই যাত্রা শুরু করেছে ট্রেন। মোংলা বন্দর প্রতিষ্ঠার ৭৩ বছর পর আনুষ্ঠানিকভাবে গত ১ জুন থেকে যাত্রা শুরু হয়। এখন মোংলা-যশোর-বেনাপোল রুটে বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচল করছে। প্রথম অবস্থায় নতুন এ রুটে আগে থেকে চলাচলরত খুলনা-বেনাপোল রুটের একটি লোকাল ট্রেনকে ‘মোংলা কমিউটার’ নামে নতুন নামকরণ করে মোংলা থেকে বেনাপোল পর্যন্ত চলাচলের মধ্যে দিয়ে যাত্রীবাহী এ ট্রেন চলাচলের সূচনা করা হয়েছে।
৪ হাজার ২শ ৬০ কোটি ৮৮ লাখ ৬৯ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ রেলপথে প্রথম অবস্থায় ট্রেন চলছে মাত্র একটি। এ অঞ্চলের মানুষের জন্য এ যাতায়াত ব্যবস্থা আশীর্বাদ হলেও মোংলা থেকে খুলনা ও বেনাপোলগামী ট্রেনের যে সময়সূচি নিয়ে সাধারণ যাত্রীদের মাঝে ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। মোংলা-খুলনা রুটে প্রথম অবস্থায় নতুন শিডিউল করে অন্তত ৪টি ট্রেন চালানোর দাবি জানিয়েছেন এ অঞ্চলের মানুষ।
সকালে মোংলা থেকে খুলনার ও ভারতের সীমান্তপথ বেনাপোলের উদ্দেশ্যে মানুষ মূলত ব্যবসা, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং অফিসিয়াল কাজে রওয়ানা হন। কিন্তু দুপুর ১টায় ট্রেন ছাড়ার সময় হওয়ায় অনেকেই এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। দুপুরের দিকে খুলনা থেকে মোংলায় এসে আবার খুলনা যাওয়ায় এ রুটে পর্যাপ্ত যাত্রী নাও উঠতে পারে। আসা এবং যাওয়া দুই পথেই পর্যাপ্ত যাত্রী না হলে এই ট্রেনটি লোকসানের মুখে পড়বে। দিনের পর দিন লোকসান দিয়ে এক পর্যায়ে ট্রেনপথটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই যাত্রীদের সার্বিক সুবিধার কথা বিবেচনা করে ট্রেনের শিডিউল পরিবর্তন করে মোংলা থেকে সকাল বেলা ছাড়া ও এ রুটে ট্রেন চলাচলের সংখ্যা বৃদ্ধির জোর দাবি জানিয়েছেন এই রুটের চলাচলকারীরা।
মোংলা বন্দর বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কামরুল হাসান খোকন জানান, অনুমোদনের দীর্ঘ ১০ বছর ধরে নির্মাণ কাজ শেষ করার পর অবশেষে চালু হয়েছে মোংলা-খুলনা রেললাইন। চিকিৎসা, শিক্ষা, দাফতরিক এবং ব্যবসার কাজে আমাদের প্রতিনিয়ত খুলনা-যশোর-বেনাপোল যেতে হয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ট্রেনের শিডিউল নিয়ে। এ ছাড়া রুটে একটি মাত্র ট্রেন চলাচলে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এ ব্যবসায়ী এ রুটে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অন্তত ২ জোড়া ট্রেন চলাচলের দাবি জানান।
উম্মী আয়েশা ইতু নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘মোংলা-খুলনা ট্রেন চালু হওয়াতে আমরা খুবই খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমরা শিক্ষার্থীরা এই সেবাটি নিতে পারছি না। কারণ আমাদেরকে সকাল বেলায় খুলনায় পৌঁছাতে হয়। আবার বিকেল বেলায় খুলনা থেকে মোংলায় ফিরতে হয়। কিন্তু ট্রেনের শিডিউল দুপুর বেলা হওয়াতে আমার মত অনেক শিক্ষার্থী এই সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই ট্রেনের সংখ্যা ও সময়সূচি পরিবর্তন করা হলে রোগী থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, ছাত্রছাত্রী, সাধারণ মানুষের সমস্যা অনেকখানি লাঘব হবে।’
সালমা বেগম নামে মোংলার এক রোগী জানান, প্রায়ই চিকিৎসার কাজ ও ডাক্তার দেখাতে তাকে মোংলা থেকে খুলনায় যেতে হয়। বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ডাক্তার দেখিয়ে খুলনা থেকে মোংলায় রওনা দিতে রাত ৮/৯টা বেজে যায়। আর খুলনার অধিকাংশ ডাক্তার বিকেলের দিকে রোগী দেখেন। এ অবস্থায় রাত ৮/৯টা দিকে খুলনা থেকে মোংলায় ট্রেন ছাড়লে এ রুটে রোগীসহ সাধারণ মানুষের উপকার হবে।
মোংলা বন্দরে খুলনা থেকে এসে নিয়মিত অফিস করেন সাধন কুমার চক্রবর্তী নামের এক শিপিং ব্যবসায়ীকে। তিনি বলেন, ‘সকাল থেকে খুলনা থেকে মোংলায় ট্রেন ছাড়লে শিপিং ব্যবসায়ীসহ বন্দর কেন্দ্রিক সরকারি চাকরিজীবীদের ভীষণ উপকার হয়।’
রামপাল উপজেলা উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সবুর রানা বলেন, ‘এ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের প্রাণের দাবি মোংলা-খুলনা-যশোর রুটে বাণিজ্যিক ট্রেন চলাচল শুরু হলেও এর শিডিউল ও ট্রেন সংখ্যা নিয়ে আমরা হতাশ। এ রুটটি অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ স্বল্প খরচে এ রুট দিয়ে ট্রেনে চলাচল করতে ইচ্ছুক। কিন্তু কর্তৃপক্ষ স্বল্প পরিসরে রেল চালাচ্ছে।’ এ অবস্থায় এ রুটে নতুন শিডিউলে অন্তত ৪টি যাত্রীবাহি ট্রেন চালানোর দাবি জানান তিনি।
শাজাহান সিদ্দিকী নামের এক রাজনীতিবিদ জানান, মোংলাসহ আশপাশের লোকজন পার্শ্ববর্তী দেশে চিকিৎসার জন্য যেয়ে থাকে। তারা যদি সকালে ট্রেনে যেতে পারত তাহলে খরচ ও সময় উভয় বাঁচত। এখন যে সময় ট্রেন চলাচল করে তাতে রোগীরা ট্রেন করে যাতায়াত করতে পারবে না।
মোংলা বন্দর উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ভিপি শাহ আলম বলেন,‘মোংলা বন্দরের উন্নয়নের স্বার্থে আমরা মোংলায় রেলপথ চালুর দাবি জানিয়ে আসছিলাম। সরকারও রাজস্ব আয়ের জন্য এই পথটি চালু করে। কিন্তু ট্রেন চলাচলের সময় যা দেওয়া হয়েছে তা জনসাধারণের কোনো কাজে আসছে না। এক সময় লোকসান দেখিয়ে এই ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। মোংলা-খুলনা রুটে প্রথম অবস্থায় নতুন শিডিউল করে অন্তত ৪টি ট্রেন চালানোর দাবি জানাই। সকাল ও বিকেলে বেলায় ট্রেন চলাচল করলে লোক ও আয় দুটোই বাড়বে।’
মোংলা পৌরসভার মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আ. রহমান বলেন, ‘মোংলা শুধু একটি বন্দরই নয়, সুন্দরবন কেন্দ্রিক একটি পর্যটন এরিয়াও। এখানে ইপিজেডও রয়েছে। রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং ইপিজেডের কারণে এ অঞ্চলে মানুষের সমাগমও বাড়ছে। তাছাড়া এ এলাকার মানুষ চিকিৎসার জন্য প্রায়ই ভারতে আসা যাওয়া করে এবং ব্যবসা ও ডাক্তার দেখাতে খুলনা শহরে যায়। প্রতিবছর এখানে দেশ বিদেশ থেকে পর্যটকরা আসে সুন্দরবন দেখতে। সার্বিক দিক বিবেচনা করে ট্রেনের সময়সূচি পরিবর্তন ও এ রুটে অন্তত ৪টি ট্রেন চালালে সাধারণ মানুষ ও যাত্রীরা উপকৃত হবেন।’
মোংলা রেলস্টেশন মাস্টার এসএম মনির আহম্মেদ জানান, এ রুটে ট্রেন চালু হওয়ারি পর মোংলা থেকে প্রতিদিন গড়ে দুই শো থেকে আড়াই শো যাত্রী যাতায়াত করছে। যাত্রীদের সুবিধা-অসুবিধার কথা চিন্তা করে ট্রেনের সময়সূচির ব্যাপারে আমাদের উর্ধতন কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানানো হয়েছে। তারা বিষয়টি বিবেচনা করবেন ।
মোংলা বন্দরকে দেশের রেল নেটওয়ার্কে যুক্ত করতে ২০১৬ সালে শুরু হয় খুলনা-মোংলা রেলপথ নির্মাণ। ২০১৯ সালে নির্মাণ কাজ শেষ করার কথা থাকলেও ৫ দফা সময় বাড়িয়ে নির্মাণ কাজ শেষ হয় ২০২৩ সালের অক্টোবরে। খুলনার ফুলতলা থেকে মোংলা পর্যন্ত ৬৪ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথে রয়েছে রুপসা নদীর ওপর ৫ দশমিক ১৩ কিলোমিটার একটি রেলসেতু, ১০৭টি ছোট বড় কালভার্ট, ৮ টি প্লাটফর্ম ও ৯টি আন্ডারপাস।
গত বছরের ১ নভেম্বর এই রেলপথ বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ভার্চুয়ালি উদ্ধোধন করেন। এর ৭ মাস পর খুলনা-মোংলা রেলপথে ১ জুন আনুষ্ঠানিক ট্রেন চলাচল শুরু হয়। এই পথে মঙ্গলবার বন্ধ রেখে সপ্তাহে ৬ দিন চলবে মোংলা এক্সপ্রেস নামে একটি কমিউটার ট্রেন চলাচল করছে ট্রেনটি বেলা সাড়ে ১২টায় মোংলায় পৌছায় এবং বেলা ১টায় খুলনা-যশোর-বেনাপোলের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে।
সারাবাংলা/একে