যেভাবে তৈরি হয় সরকারের বাজেট
১ জুন ২০১৮ ০৯:২১
।। এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: বাজেট হচ্ছে সরকারের সারা বছরের আয় ও খরচের হিসেব। আগের অর্থবছরের পূর্বাভাস দেখে পরের অর্থবছরে নির্ধারণ করা হয় সরকারের আয় ও খরচ। মূলত অর্থনৈতিক এ হিসেবের উপর ভর করে এগিয়ে চলে কোন একটি দেশের অর্থনীতি।
বাজেটের প্রধান দুটি অংশ আয় ও ব্যয়। রাজস্ব আয়ের অংশটি নির্ধারণ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে কোন কোন খাতে কর বা ভ্যাট বসবে কিংবা কোন খাতটি কর অব্যাহতি পাবে তা নির্ধারণ করে এনবিআর। অপরদিকে বাজেটের খরচের খাতগুলো নির্ধারণ করে সরাসরি অর্থ মন্ত্রণালয়।
একই সঙ্গে কোন একটি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) পরিকল্পনা করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। এর বাইরেও প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ তাদের আলাদা চাহিদা ও বাজেট তৈরি করে। পরবর্তীতে ওই প্রস্তাবগুলো তারা অর্থ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। একইভাবে প্রতিটি ব্যবসায়ী সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানই তাদের রাজস্ব সংক্রান্ত প্রস্তাবনা এনবিআরের কাছে জমা দেয়।
নতুন বছরের বাজেট তৈরি করতে প্রতি বছরের আগস্টে ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের বৈঠক শুরু হয়। বাজেটে কিছুটা সংশোধন আসে ডিসেম্বরে। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকেই নতুন বাজেট প্রণয়ণের বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় বৈঠক শুরু হয়। এপ্রিলে হয় সম্পদ কমিটির বৈঠক। আর বাজেট প্রণয়নের দু’মাস আগে থেকেই চলে প্রাক বাজেট আলোচনা।
ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া বৈঠক থেকে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর কাছে নতুন বাজেটের প্রস্তাব চাওয়া হয়। একই ধরণের বৈঠক করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও এনবিআর। আর সবকিছুর সমন্বয় করে অর্থ মন্ত্রণালয়।
বাজেট কাঠামোর বড় অংশটিই নির্ধারণ করা হয় সম্পদ কমিটির বৈঠকে। এ কমিটির সভাপতি অর্থমন্ত্রী। কমিটির সদস্য হিসেবে আছে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিব ও শীর্ষ কর্মকর্তারা। এতে বাণিজ্যমন্ত্রী, পরিকল্পনা মন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীরাও যুক্ত থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এ কমিটির কিছু সদস্য বৈঠক করে চূড়ান্ত বাজেট কাঠামো নির্ধারণ করেন।
তবে এরও আগে অর্থনৈতিক মডেলের মাধ্যমে রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের পরিমাণ নির্ধারণ করে অর্থ মন্ত্রণালয়। আয় ও ব্যয় নির্ধারণে ইকোনোমেট্রিক্সের সূত্র অবলম্বন করা হয়ে থাকে। ম্যাক্রো ইকোনমিক উইং বা সামষ্টিক অর্থনৈতিক শাখার একদল বিশেষজ্ঞ এই কাজটি করে থাকেন। আর এখানে প্রয়োগ উপযোগী ইনপুট হিসেবে সরকারের পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনা, পরিকল্পনা কমিশন ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করা হয়।
অর্থবছরের ৬ মাস শেষ হওয়ার আগেই অর্থাৎ ডিসেম্বরে সংশোধিত বাজেট নির্ধারিত হয়। এতে বাজেটের মূল অঙ্ক ঠিক রেখে আয়-ব্যয়ে কিছুটা পরিবর্তন আসে। প্রতিটি মন্ত্রণালয়কে ফেব্রুয়ারিতেই চিঠি দিয়ে তাদের চাহিদা জানতে চাওয়া হয়। আর সব মন্ত্রণালয়ের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতা তৈরি করেন। এনবিআর তার প্রস্তাবনা দেয়। এর উপর ভিত্তি করে আয়ের উৎস নির্ধারণ করা হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বাজেটের ঘাটতি সবসময় ৫ শতাংশের মধ্যে রাখা হয়। ঠিকমতো রাজস্ব আদায় ও প্রকল্পের অর্থ খরচ করা গেলে ঘাটতি কমে আসত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ঘাটতি মেটানোর জন্য অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নেয়া হয়। এর পেছনে কল্যাণ অর্থনীতি কাজ করে। কারণ সঞ্চয় পত্রের যে সুদ, তার চেয়ে চার ভাগের এক ভাগ বিদেশ থেকে ঋণ আনা সম্ভব। ফলে এখানে একটা রাজনৈতিক অর্থনীতিও কাজ করে।
নতুন বাজেটে ব্যবসায়ীদের দাবি দাওয়ার প্রতিফলন ঘটাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রতিবছরই প্রাক বাজেটের আয়োজন করে থাকে। মাসব্যাপী চলে এই আলোচনা। এতে ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা তাদের বিভিন্ন দাবি দাওয়া তুলে ধরে। আয়কর-ভ্যাট-কাস্টমস নীতিতে বিভিন্ন সংস্কারের প্রস্তাব দেন তারা। বাজেটেও এর কিছুটা প্রতিফলন থাকে।
তবে, বাজেট প্রণয়নের জন্য আলাদা কোন বরাদ্দ থাকে না। নিত্য নৈমত্তিক কাজের অংশ হিসেবে কর্মকর্তারা তা করে থাকেন। তবে বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের কর্মকর্তাদের বাড়তি পারিশ্রমিক দেয়া হয়। বাজেট প্রণয়ন করতে গিয়ে যেসব অনুষ্ঠান হয়ে থাকে, বিশেষত কোন আলোচনা সভা তা অনুষ্ঠানাদির খরচ থেকে মেটানো হয়। তাই বাজেটের জন্য আসলে কতো টাকা খরচ হয়ে থাকে তা জানা যায় না সহজে।
সর্বোপরি, বাজেট প্রণয়ন মূলত একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। পুরো বছর জুড়েই চলে বাজেটের কাজ। এ ছাড়া সরকারের মধ্য মেয়াদি বাজেট কাঠামোর আওতায় দীর্ঘ মেয়াদে বাজেটের একটি অংশ তৈরিই থাকে। বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত তারা এক বাজেটের কাজ শেষ হওয়া মাত্রই চলমান ও পরবর্তী বাজেট নিয়ে ভাবতে শুরু করেন।
বাজেট বক্তৃতার কাজ শুরু হয় এপ্রিলের পর থেকে। অর্থমন্ত্রণালয় ও এনবিআর এই কাজটি করে থাকে। তবে সব কিছুরই সমন্বয়ের দায়িত্বে অর্থমন্ত্রণালয়। এখানেও সার্বিক নির্দেশনা থাকে প্রধানমন্ত্রীর। বাজেট পাসের এক থেকে দুই দিন আগে ছাপানোর জন্য তা বিজি প্রেসে যায়। প্রস্তাবিত বাজেট সংসদে উঠার আগে সংসদের মন্ত্রিপরিষদের একটি বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে বাজেট অনুমোদন দেয়া হয়। পরে সংসদে তা উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। দীর্ঘ প্রায় তিন সপ্তাহ আলোচনার পর এটি সংসদে পাস করা হয়। তখন তা চূড়ান্ত বাজেটে রুপ নেয়। প্রস্তাবিত বাজেট প্রতিবছর ৩০ জুন পাস করা হয়। ১ জুলাই থেকে নতুন অর্থবছরের বাজেটের কার্যক্রম শুরু হয়।
সারাবাংলা/ইএইচটি/জেএএম