Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সীমাবদ্ধতায় আটকে যেতে পারে কফি-কাজুবাদামের সম্ভাবনা

জোসনা জামান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২৭ জুন ২০২৪ ১০:০২

খাগড়াছড়ির পাহাড়ে কফির আবাদ হচ্ছে। সারাবাংলা ফাইল ছবি

ঢাকা: দেশের পাহাড়ি এলাকায় কফি ও কাজুবাদামের আবাদ সম্ভাবনাময় হয়ে এসেছিল। ২১১ কোটি টাকার পাঁচ বছর মেয়দি এক প্রকল্পের অধীনে এই দুটি ফসলের আবাদ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল পাহাড়ে। এরই মধ্যে প্রকল্পের সাড়ে তিন বছর শেষ। এ অবস্থায় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদন বলছে, সম্ভাবনার পাশাপাশি নানা ধরনের জটিলতা আর সীমাবদ্ধতাও রয়েছে এই প্রকল্পে। ফলে এ প্রকল্প থেকে সুফল পাওয়া কঠিন হয়ে যেতে পারে।

বিজ্ঞাপন

আইএমইডির প্রতিবেদনে প্রকল্পটির দুর্বল দিক তুলে ধরে বলা হয়েছে, প্রকল্পের কার্যক্রম প্রধানত পার্বত্য এলাকায় হওয়ায় তদারকিতে সমস্যা হতে পারে। কৃষি শ্রমিকের সংকট ও মজুরি বেশি হওয়ায় প্রাথমিক ব্যয় বেশি। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি গ্রহণে কৃষকদের অনীহা রয়েছে। যথাযথ উৎপাদন প্রযুক্তির অভাবে ফসল নষ্ট হতে পরে। ফল প্রক্রিয়াজাত করার যথাযথ ব্যবস্থাপনাতেও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। রয়েছে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনবলের অপর্যাপ্ততা। সব মিলিয়ে পাহাড়ের জন্য সম্ভাবনাময় দুটি ফসলের পক্ষে সম্ভাবনার আলো ফুটিয়ে তোলা কঠিন।

বিজ্ঞাপন

‘কাজু বাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ’ প্রকল্পের নিবিড় পরিবীক্ষণ সমীক্ষার খসড়া প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন মূল্যয়ন। আইএমইডির নিয়োগ দেওয়া পরামর্শক এই খসড়া প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। মাঠপর্যায়ে কৃষকদের সঙ্গে আলোচনা করে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আইএমইডি বলছে, বর্তমানে কিছু কিছু গাছ থেকে কফি উত্তোলনের কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু কৃষকরা এখন পর্যন্ত পালপিং মেশিন, শুকানো মেশিন, পার্চমেন্ট মেশিন, রিমুভার মেশিন, রোস্টার মেশিনসহ কফি প্রক্রিয়াজাত করা কোনো যন্ত্রপাতিই পাননি। এ ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে।

‘কাজু বাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ’ প্রকল্পটি ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য অনুমোদন পায়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রকল্পটির মোট বাস্তবায়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২১১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই) অংশের ব্যয় ১৫৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই) অংশের ব্যয় ৫৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা।

প্রকল্পের অগ্রগতি

আইএমইডির পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ডিএই এই প্রকল্পে ব্যয় করেছে ৯১ কোটি ৫১ লাখ ৭৪ হাজার টাকা, বিএআরআই ব্যয় করেছে ২৭ কোটি ৯৬ লাখ ২১ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ৫৬ শতাংশের বেশি। এ সময়ে ভৌত কাজের অগ্রগতি ডিএই অংশে ৬৫ শতাংশ, বিএআরআই অংশে ৫২ শতাংশ।

আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের আওতায় বিএআরআই অঙ্গে দুটি কফি ও দুটি কাজুবাদামের জাত উদ্ভাবনের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত কফির একটি নতুন জাত (বিএআরআই কফি) অনুমোদন পেয়েছে। কৃষকদের মধ্যে এটি বিতরণের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কাজুবাদামের একটি নতুন জাত নির্বাচন করা হয়েছে, যা অনুমোদনের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

প্রকল্পের ঝুঁকি

পাহাড়ি ধসে ও ভূমি ক্ষয়ে প্রকল্পের কার্যক্রম ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। অনুন্নত বাজার ও যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্যপ্রাপ্তির ঝুঁকি রয়েছে। আমদানি করা বীজ গবেষণাগারে পরীক্ষিত না হয়ে সরাসরি মাঠ পর্যায়ে সরবরাহ করা হয়েছে। ফলে মাঠ পর্যায়ে রোগ বা মোকামাকড় আক্রমণ এবং আবহাওয়ার কারণে ফসলের উৎপাদন ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। পণ্য বিক্রিতে বিদেশি পণ্যের তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে পারে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে সময়মতো সেচের ব্যবস্থা না থাকায় চারা মরে যাওয়া ও উৎপাদন কম হওয়ার ঝুঁকি আছে।

আইএমইডির পরামর্শ

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাজুবাদাম ও কফি উৎপাদনের জন্য প্রত্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চল এবং পতিত উঁচু ও টিলাযুক্ত জমিতে আবাদ উৎসাহিত করা হচ্ছে। সেচের সীমাবদ্ধতা ও খরার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে কাজুবাদাম ও কফির চাষে সমস্যা হচ্ছে। এসব জমিতে ভালো ফলন পেতে হলে সোলার পাম্পের সাহায্যে সেচ সুবিধা গড়ে তুলতে হবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ফিল্ড অফিসার ও কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা সহযোগীদের কাজুবাদাম ও কফি উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাত সম্পর্কে ধারণা অনেক সীমিত। প্রকল্পের আওতায় এর উৎপাদন প্রযুক্তি, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণ বিষয়ে দক্ষ জনবল গড়ে তোলা জরুরি। তার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ের গবেষক ও কর্মকর্তাদের দেশের বাইরে প্রশিক্ষণের সংস্থান থাকলেও সরকারি সিদ্ধান্তের কারণে তাদের বিদেশে পাঠানো যায়নি। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট প্রতিটি বিষয়ে দক্ষ জনবল গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে।

প্রতিবেদন বলছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে অঞ্চলে যোগাযোগ একটি বড় সমস্যা। দূরদূরান্তের পাহাড়ে কৃষিকাজও অত্যন্ত কঠিন। ফলে প্রকল্প মনিটরিংয়ের কাজও কঠিন হয়ে পড়ে। সেই যোগাযোগের সীমাবদ্ধতা কাটাতে প্রয়োজনীয় যানবাহন সরবরাহ করতে হবে।

আইএমইডি বলছে, কাজুবাদাম ও কফি দুটোই উচ্চ মূল্যের ফসল। একে নারীবান্ধব হিসেবে উৎপাদনের কৌশল বাস্তবায়ন করতে পারলে তা নারীদের কর্মসংস্থান ও আয়ে ভূমিকা রাখবে। এ ছাড়া এখন বিচ্ছিন্নভাবে এই দুটি ফসল চাষ হলেও এগুলো বাজারজাত করার জন্য নির্দিষ্ট স্থান তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি প্রক্রিয়াজাত করার সুবিধা তৈরি করতে হবে। তাহলে কৃষক সঠিক বাজারমূল্যে পাবেন, আর্থিকভাবেও লাভবান হবেন। মাঠপর্যায়ে কৃষির দুই দফতরের মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো গেলে তা প্রকল্প কার্যক্রম বাস্তবায়নে সহায়ক হবে।

সম্ভাবনা

আইএমইডির অভিমত, পার্বত্য অঞ্চলে কাজুবাদাম ও কফি চাষ সম্প্রসারণের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। এ অঞ্চলে নতুন নতুন বাগান তৈরির মাধ্যমে অনাবাদি বিপুল পরিমাণ জমিকে আবাদের আওতায় আনা সম্ভব। আর সেটি করা গেলে দেশে কাজুবাদাম ও কফির প্রক্রিয়াজাতকরণের কারখানা গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। ভিয়েতনামের মতো বিদেশ থেকে কাঁচা কাজুবাদাম ও কফি আমদানি করে তা আন্তর্জাতিক মানে প্রক্রিয়াজাত ও মোড়কজাত করে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহের সুযোগ আছে।

দেশীয় প্রক্রিয়াজাত কারখানাগুলোকে উৎসাহিত করে আন্তর্জাতিক বাজার তৈরির জন্য কাজুবাদাম ও কফির কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছে আইএমইডি। পরিকল্পনা অনুযায়ী সবকিছু বাস্তবায়ন করা গেলে কাজুবাদাম ও কফির দেশীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন সম্ভব হবে। তবে ফসল দুটিতেই কাঙ্ক্ষিত ফলন পেতে পাঁচ থেকে ছয় বছর সময় লেগে যেতে পারে। তাই ফসল দুটি নিয়ে দীর্ঘ মেয়াদি প্রকল্প গ্রহণের সুপারিশ করছে আইএমইডি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইএমইডি সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, প্রতিবেদনটি খসড়া আকারে রয়েছে। দুয়েক দিনের মধ্যেই চূড়ান্ত করা হবে। খসড়া প্রতিবেদন নিয়ে মন্তব্য করা ঠিক নয়। তবে এটুকু বলতে পারি— কাজুবাদাম ও কফি চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা আছে।

দেশের পাহড়ি অঞ্চলের অনাবাদি জমিতে এগুলোর চাষ বাড়িয়ে বাজার ব্যবস্থা উন্নত করলে এবং প্রক্রিয়াকরণের ব্যবস্থা করা গেলে দেশীয় চাহিদা মেটানোর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের পাশাপাশি রফতানির মাধ্যমে বিদেশি মুদ্রা অর্জনের সম্ভাবনা রয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন কাশেম মো. মহিউদ্দিন।

সারাবাংলা/জেজে/টিআর

আইএমইডি কফি চাষ কাজুবাদাম চাষ পরিকল্পনা কমিশন প্রকল্প মূল্যায়ন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর