Tuesday 19 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কেটে গেছে অর্থায়ন জটিলতা, চ্যালেঞ্জ এবার ভূমি অধিগ্রহণ

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২৯ জুন ২০২৪ ২২:৪৩

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামের কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর ওপর বহুল প্রত্যাশিত সেতু নির্মাণে প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান এসেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে চুক্তি সইয়ের মধ্য দিয়ে অর্থায়ন জটিলতা কেটে যাওয়ার পর এখন ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতাকে পরবর্তী চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে কালুরঘাট সেতুর নির্মাণকাজ শুরুর পূর্ণ প্রস্তুতি তাদের আছে। তবে ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে প্রচলিত যে সমস্যা অর্থাৎ মামলা-মোকদ্দমাসহ আইনি জটিলতা তৈরি হলে সেক্ষেত্রে নির্মাণ প্রক্রিয়া ফের ঝুলে যেতে পারে।

বিজ্ঞাপন

স্থানীয় সংসদ সদস্য মো. আবদুচ ছালাম ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে জটিলতা তৈরির আশঙ্কায় এ সংক্রান্ত নির্ধারিত অর্থ দুই হাজার ছয়শ কোটি টাকা আগে-ভাগে ছাড় করার জন্য জাতীয় সংসদে প্রস্তাব দিয়েছেন।

অন্যদিকে, সেতুর দাবিতে আন্দোলনকারী সংগঠন বোয়ালখালী-কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদের সংগঠকরা আইনি কিংবা অন্য কোনো জটিলতায় যাতে সময়ক্ষেপণ না হয়, সেজন্য পরবর্তী প্রতিটি পদক্ষেপ সতর্কতার সঙ্গে নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। এ বিষয়ে পরিষদের অবস্থান তুলে ধরতে রোববার (৩০ জুন) সকাল ১১টায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করেছে সংগঠনটি।

চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর ওপর বিদ্যমান প্রায় ১০০ বছরের পুরনো জরাজীর্ণ রেলসেতুটি নিয়ে মানুষের দুর্ভোগের অন্ত নেই। অথচ বোয়ালখালী-পটিয়াসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষের একাংশের নগরের সঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম এই সেতু। ১৯৯১ সাল থেকে প্রত্যেক জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কালুরঘাট সেতু নির্মাণের বিষয়টি রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে প্রার্থীদের প্রচারণা ও প্রতিশ্রুতিতে গুরুত্ব পেয়ে আসছে। কিন্তু সেতু নির্মাণের বিষয়টি এতদিন এগোয়নি।

বিজ্ঞাপন

২০১৪ সাল থেকে বোয়ালখালী-কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদ সেতুর দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলন করে আসছে। নানামুখী আলোচনা, আন্দোলন, কখনও আশার আলো, কখনও হতাশা নিয়ে প্রায় চার দশক পার হওয়ার পর দৃশ্যমান অগ্রগতির খবর আসে গত ২৭ জুন। এদিন বাংলাদেশ ও কোরিয়া সরকারের মধ্যে ‘কর্ণফুলী নদীর ওপর কালুরঘাট পয়েন্টে রেল কাম সড়ক সেতু নির্মাণ’ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য দুটি ঋণচুক্তি সই হয়েছে।

চুক্তি অনুযায়ী, সেতু নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ দক্ষিণ কোরিয়ার কাছ থেকে সহজ শর্তে ৮১ কোটি ৪৯ লাখ ১০ হাজার ডলার ঋণ পাচ্ছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ৯ হাজার ৫৩৪ কোটি ৪৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা (প্রতি ডলার ১১৭ টাকা হিসেবে)। এর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ড (ইডিসিএফ) থেকে ৭২ কোটি ৪৭ লাখ ৩০ হাজার ডলার এবং ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট প্রমোশন ফ্যাসিলিটি (ইডিপিএফ) তহবিল থেকে ৯ কোটি ১ লাখ ৮০ হাজার ডলার ঋণ দেওয়া হচ্ছে। ইডিসিএফ’র আওতায় ঋণচুক্তির সুদের হার শূন্য দশমিক শূন্য এক শতাংশ এবং ঋণ পরিশোধের মেয়াদ সাড়ে ১৫ বছর, তবে গ্রেস পিরিয়ডসহ সাড়ে ৪০ বছর। ইডিপিএফ তহবিলের আওতায় ঋণচুক্তির সুদের হার ১ শতাংশ ও ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ৭ বছর, গ্রেস পিরিয়ডসহ মেয়াদ ৩০ বছর। সুদের হার ও শর্তাবলি উভয় ঋণের ক্ষেত্রেই নমনীয়।

রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সেতু নির্মাণে মোট ব্যয় হবে ১১ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। দক্ষিণ কোরিয়ার ঋণের পর বাকি টাকা সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে যোগান দেবে।

নানামুখী আলোচনা, বারবার প্রতিশ্রুতির পরও বছরের পর বছর ধরে ঝুলে থাকা কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় হঠাৎ গতি এসেছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্টরা জানান, সংসদ সদস্য চট্টগ্রামের ওয়াসিকা আয়শা খান অর্থ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাবার পরপরই অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে তাগাদা দিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে অর্থায়নের আলোচনা এগিয়ে নেন। এর মধ্য দিয়ে ঋণচুক্তি সইয়ের কার্যক্রম ত্বরান্বিত হয়। এছাড়া সংসদ সদস্য আবদুচ ছালামও নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে রেলমন্ত্রী এবং মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখেন। এতে সেতু নির্মাণের বিষয়টি রেলসহ সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে।

জানতে চাইলে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘কালুরঘাট সেতু শুধু বোয়ালখালী কিংবা পটিয়ার বিষয় নয়, এটি সমগ্র দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসীর প্রাণের দাবি। এ বিষয়ে আমার আগ্রহ থাকাটাই স্বাভাবিক। কালুরঘাটে নতুন সেতু নির্মাণ হলে শুধু যে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হবে, তা-ই নয়। সেতুর অপরপ্রান্তে নদীর দক্ষিণ তীরে আরেকটি শহর গড়ে উঠবে। বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন হবে। আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্য সুবিধা বাড়বে, এতে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে। ট্রান্স-এশিয়ান রেলপথের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পথে আমাদের যে বিদ্যমান অপারেশনাল সীমাবদ্ধতা, সেটা দূর হবে।’

ঋণচুক্তি সইয়ের মধ্য দিয়ে কালুরঘাট সেতু নির্মাণের উদ্যোগ দৃশ্যমান হওয়ার পর কর্ণফুলী নদী তীরের বাসিন্দাদের মধ্যে আশার আলো তৈরি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন, কেউ কেউ আবার আদৌ হবে কি না সেটা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করছেন। তবে সবার প্রত্যাশা, সেতুর নির্মাণকাজ দ্রুত শুরু হবে।

নির্মাণকাজ শুরুর পথে পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে চাইলে কালুরঘাট সেতুর প্রকল্প পরিচালক রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী (সেতু) মো. গোলাম মোস্তফা সারাবাংলাকে বলেন, ‘অর্থ নিয়ে আর কোনো সমস্যা নেই। কয়েকদিন পর যে অর্থবছর শুরু হবে, সেটার শুরুতেই আমরা অর্থ পাব বলে আশা করছি। এটা আমাদের শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন আমাদের কাজ হচ্ছে, দ্রুততার সঙ্গে ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) একনেকে পাস করিয়ে আনা। আমরা অলরেডি ডিপিপি পাঠিয়ে দিয়েছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দশ জুলাই চীন সফরে যাবেন। সেখান থেকে ফেরার পর একনেকের মিটিং হবে। পনের থেকে বিশ জুলাইয়ের মধ্যে মিটিং হবে আশা করছি। তারপরও আমরা বলছি যে, জুলাইয়ের মধ্যে প্রকল্পটা একনেকে পাস হয়ে যাবে।’

‘একনেক অনুমোদন দেওয়ার পর আমরা কনসালটেন্ট নিয়োগ দেব, ডিটেইল ডিজাইন হবে। এরপর আমরা টেন্ডার কল করব। এসব কাজ শেষ করতে আমাদের আরও একবছর সময় লাগবে। অর্থাৎ ২০২৫ সালের জুলাই মাসে আমরা টেন্ডার কল করতে পারব বলে আশা করছি। এরপর চূড়ান্ত কার্যাদেশ দেওয়া, ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনসহ আরও কিছু আনুষাঙ্গিক কাজ থাকবে। সেগুলো ছয়মাসের মধ্যে শেষ করে ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে আমরা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করব। ২০৩০ সালে সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করে সেতু রেল ও সড়কযান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে।’

নির্মাণকাজ শুরুর পথে আর কোনো চ্যালেঞ্জ আছে কি না? জানতে চাইলে গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘চ্যালেঞ্জ আছে। আমাদের কাছে এখন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ভূমি অধিগ্রহণ। সেতুর জন্য আমাদের মোট ১৪০ একর ভূমি অধিগ্রহণ করতে হবে। এর মধ্যে ষাট শতাংশ রেলওয়ের মালিকানাধীন ও সরকারি খাসজমি। এটা আমাদের জন্য বেশ সুবিধা হয়েছে। বাকি চল্লিশ শতাংশের মতো ব্যক্তিমালিকানাধীন ভূমি। সেগুলো মামলা-মোকদ্দমা এড়িয়ে অধিগ্রহণ করাটা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ। যদি আইনি জটিলতায় পড়ি, তাহলে সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করতে দেরি হতে পারে।’

ভূমি অধিগ্রহণের কাজ জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে জুলাই-আগস্ট থেকে শুরুর সিদ্ধান্ত রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের আছে বলে জানান প্রকল্প পরিচালক।

চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী ও নগরীর একাংশ) আসনের সংসদ সদস্য আবদুচ ছালাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার এলাকার মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি কালুরঘাট সেতু। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় এ সেতুর কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। আমার এলাকাবাসী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ। বলা হচ্ছে, ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে কাজ শুরু হবে। আমি চেষ্টা করবো, সেটা ২০২৫ সালের মাঝামাঝির দিকে এগিয়ে আনা যায় কী না। কাজকে লম্বা করলে লম্বা হয়, ইচ্ছা থাকলে সংক্ষেপেও করা যায়। অযথা সময়ক্ষেপণ যাতে না হয়, বিষয়টি আমি নজরে রাখব।’

জানতে চাইলে বোয়ালখালী-কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদের আহবায়ক মো. আব্দুল মোমিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘সমস্যা থাকলে সমাধানও থাকবে। ভূমি অধিগ্রহণ কেন, যেকোনো জটিলতাই আন্তরিকভাবে সমাধান সম্ভব। বিপুল সংখ্যক ভূমি অধিগ্রহণ করে পদ্মা সেতু, টানেল, মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প হতে পারলে, মাত্র ১৪০ একরের জন্য তেমন জটিলতা সৃষ্টি হবে বলে আমাদের মনে হয় না। মনে রাখতে হবে, এটা লাখ, লাখ মানুষের প্রাণের দাবি। অযথা সময়ক্ষেপণ কিংবা অনাকাঙ্খিত কোনো পরিস্থিতি তৈরি হলে মানুষ হতাশ হবে।’

কালুরঘাট সেতুর প্রস্তাবিত নতুন নকশা অনুযায়ী, কর্ণফুলী নদীর ওপর বিদ্যমান রেলসেতুর ৭০ মিটার উজানে নতুন সেতু নির্মিত হবে। সেতুর দুই পাশে দুই লেন করে চার লেনের সেতু তৈরি করা হবে। এক পাশে চলবে ট্রেন, অন্যপাশে চলবে বাস-ট্রাকসহ সাধারণ যানবাহন। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ৭০০ মিটার। পানি থেকে সেতুর উচ্চতা ১২ দশমিক ২ মিটার। ভায়াডাক্টসহ সেতুর দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ছয় কিলোমিটার।

সমীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, নতুন সেতু দিয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে প্রতিদিন ২০ জোড়া ট্রেন এবং দিনে প্রায় ১৫ হাজার যানবাহন চলাচল করবে। এর মাধ্যমে আনুমানিক ১০ মিলিয়ন মানুষ সরাসরি উপকৃত হবে।

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

অর্থায়ন কালুরঘাট সেতু জটিলতা ভূমি অধিগ্রহণ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর