Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

থামছেই না যমুনা, ঘর-বাড়ি-স্কুলসহ গিলতে চাচ্ছে কিল্লাও

রিপন আনসারী, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
১ জুলাই ২০২৪ ১০:২২

মানিকগঞ্জ: সাফিয়া বেগম। যমুনার নদীর ভাঙন বিধ্বস্ত এলাকার কোথায়ও স্থায়ীভাবে বসবাসের সৌভাগ্য হয়নি। যেখানেই মাথা গুঁজতে গেছেন সেখানেই উত্তাল যমুনা এসে তার আশ্রয় গিলে খেয়েছে। ভাঙনের সঙ্গে লড়াই করতে করতে এখন ক্লান্ত তিনি। এর সঙ্গে রয়েছে সংসারের অভাব-অনটন। এ পর্যন্ত তাকে সাত বার ভিটে-মাটি হারাতে হয়েছে। এবার বর্তমান আশ্রয়ের কয়েক হাত দূরেই দেখা দিয়েছে তীব্র ভাঙন। যেকোনো সময় নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে তার শেষ আশ্রয়স্থল। তাই বসত ভিটার একমাত্র দো-চালা টিনের ঘরটি ইতোমধ্যে সরিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন ষাট ঊর্ধ্ব সাফিয়া। কিন্তু বসত-ভিটার মায়া ছাড়তে না পারায় সারাদিনই নাতি-নাতনি নিয়ে পড়ে থাকছেন ভাঙন কবলিত যমুনার পাড়ে।

বিজ্ঞাপন

সরেজমিনে শিবালয় উপজেলার যমুনা নদীর দুর্গম আলোকদিয়া চরে গিয়ে দেখা গেল, সাফিয়া বেগম কাঠফাটা রোদ আর তীব্র গরমে একটি তালাই বাশের ছাউনির নিচে নাতি-নাতনি নিয়ে বসে আছেন। তার চোখে মুখে ভয় আর হতাশার ছাপ। যমুনা নদী তার জীবনটাকে তছনছ করে দিয়েছে। সাফিয়া বেগম সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘রাক্ষুসী যমুনা আমাগো সব তছনছ কইর‌্যা দিছে। সাতবার বাড়ি ঘর ছাড়া করছে। ছোট ছোট নাতি নাতনি নিয়ে কই যামু, কই থাকুম, কি খামু জানি না। জীবন ভর ভাঙনের সাথে লড়াই করতে করতে এহন ক্লান্ত হয়ে গেছি।’

বিজ্ঞাপন

তিনি জানান, বসত ভিটার মায়া ত্যাগ করতে কষ্ট হয় বলেই নাতি-নাতনি নিয়ে সারাদিন নদী পাড়ের শূন্য ভিটায় পড়ে থাকেন। আর সন্ধ্যা হলে পরিবারের লোকজন নিয়ে পাশের মুজিব কিল্লায় চলে যান। কিন্তু যেভাবে ভাঙন শুরু হয়েছে, তাতে সাফিয়া বেগমের মনে শঙ্কা জাগে ‘মনে হয় মুজিব কিল্লাও থাকব না’।

যমুনার ভাঙন বিধ্বস্ত চর এলাকায় শুধু সাফিয়া বেগমই নন, তার মতো শতাধিক পরিবার ইতোমধ্যে ভিটেমাটি হারিয়ে মানবতার জীবন-যাপন করছেন। তাদের বেশিরভাগই আশ্রয় নিয়েছেন নদী তীরবর্তী মুজিব কিল্লাসহ চরের উঁচু জায়গায়। যমুনায় তাদের ঠিকানা গিলে খাওয়ায় জীবনযাত্রায় দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।

আলোকদিয়া চরে বছর তিনেক আগে যখন মুজিব কিল্লার আংশিক নির্মাণ করা হয় তখনও নদী ছিল প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে। কিন্তু গত দুই বছরে ভাঙরের তীব্রতা ভয়াবহ রূপ নেওয়ায় যমুনা এখন মুজিব কিল্লা থেকে মাত্র ৩০০ গজ দূরে। ভাঙনের তীব্রতা বাড়লে অসহায় মানুষের আশ্রয়স্থল মুজিব কিল্লাও যেকোনো মুহূর্তে চলে যাবে যমুনা গর্ভে। অবশ্য ইতোমধ্যে ভাঙনের আশঙ্কায় মুজিব কিল্লাটি নিলামে বিক্রির ঘোষণা দিয়েছে জেলা প্রশাসন।

শুধু তাই নয়, নদী পাড়ের টেঙ্গুরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিরও একই অবস্থা। বিদ্যালয়টি বিলীন হয়ে গেলে চরাঞ্চলের ১৩০ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনও অনিশ্চয়তার দিকে চলে যাবে। কথা হয় যমুনার ভাঙন বিধ্বস্ত এলাকার আরও বেশ কয়েকজন মানুষের সঙ্গে। তারা জানান তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা। ঘরবাড়ি হারিয়ে তাদের অনেকেই মানবেতর জীবন যাপন করলেও দেখার কেউ নেই।

যমুনার ভাঙনের শিকার আব্দুল বাতেন মিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত এক মাসে আমাদের চরের অসংখ্য বাড়ি-ঘর যমুনা নদীতে চলে গেছে। বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে দেবে- এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনপ্রতিনিধিরা আমাদের ভোট আদায় করে নিয়ে যায়, কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পর তাদের পা এই চরে পড়ে না। চরের সহজ-সরল মানুষদের সঙ্গে তারা শুধু ধোঁকাবাজি করে।’

ভাঙনের শিকার মো. ইসহাক ফকির সারাবাংলাকে বলেন, ‘যমুনার ১০ নম্বর টাওয়ারের কাছে আমার বাড়ি ছিল। এ পর্যন্ত ভাঙতে ভাঙতে পশ্চিমে চলে এসেছি। এরপর পশ্চিমে যাওয়ার আর জায়গা নেই। এবার যেভাবে ভাঙন শুরু হয়েছে এভাবে আরও কিছুদিন ভাঙতে থাকলে মুজিব কিল্লাও ছাড়িয়ে যাবে।’

এলাকার কৃষক মো. মহিদুর রহমান বলেন, ‘প্রতিবছরই যমুনা নদীতে আমাদের বাড়ি-ঘর চলে যায়। অভাবের সংসারে পরিবার-পরিজন নিয়ে দু’বেলা খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকাই কঠিন। তার মধ্যে বছর বছর ভাঙনে বাড়ি-ঘর সরাতে গিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছি। ভাঙন রোধে আমাদের চরে কেউ এগিয়ে আসে না।

টেঙ্গুরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী শাহাদাত হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই বিদ্যালয়টি ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও এ পর্যন্ত পাঁচ থেকে ছয় বার ভাঙনের কারণে স্থানান্তর করা হয়েছে। প্রায় পাঁচ বছর আগে আলোকদিয়ায় চরে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি স্থাপন করা হলেও বর্তমানে যমুনার ভাঙনের মুখে রয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে স্কুলটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া প্রতিবছর নদী ভাঙনে অসংখ্য বাড়িঘর বিলীন হয়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে।’

মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মঈন উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘যমুনা নদীবেষ্টিত চরাঞ্চলে প্রতিবছরই ভাঙন দেখা দেয়। আলোকদিয়া চরে এবারের ভাঙন অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি। প্রায় তিন থেকে চার কিলোমিটার বিস্তৃত এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনের গভীরতা বেশি হওয়ায় জিও ব্যাগ দিয়ে ঠেকানো যাচ্ছে না। ওই এলাকায় গিয়েছিলাম। কিন্তু চর রক্ষায় আপাতত কোনো প্রকল্প হাতে নেই। সেজন্য এই মুহূর্তে কোনো ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। তবে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে মুজিব কিল্লাসহ সরকারি স্থাপনা সরিয়ে নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।’

জেলা প্রশাসক রেহেনা আকতার সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আলোকদিয়া চরে নির্মাণাধীন মুজিব কিল্লার কাজ এখনো শেষ হয়নি। এরই মধ্যে যমুনায় ভাঙন শুরু হয়েছে। ভাঙনের গভীরতা এতই বেশি যে, সেখানে জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। যে কারণে মুজিব কিল্লা ও স্কুলটি রক্ষা করা যাচ্ছে না। সেক্ষেত্রে সরকারি বিধিমালা অনুযায়ী নির্মাণাধীন কিল্লাটি আমরা নিলামের আওতায় এনেছি। পাশাপাশি স্কুলের গুরুত্বপূর্ণ জিনিস সরিয়ে নিয়ে সেগুলো নিলামের ব্যবস্থা করেছি। এ ছাড়া চরবাসীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ মুজিব কিল্লাটি নিরাপদ জায়গায় স্থানান্তরেরও পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।’

এদিকে, যমুনার ভাঙন বিধ্বস্ত এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের অভিযোগ, সরকারিভাবে তারা এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের সহযোগিতা পায়নি।

সারাবাংলা/পিটিএম

আলোকদিয়া চর ঘর-বাড়ি ভাঙন মানিকগঞ্জ মুজিব কিল্লা যমুনা নদী স্কুল

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর