গুলশান-বনানী লেক যেন প্রদীপের নিচে অন্ধকার
৩০ জুন ২০২৪ ২২:৫৯
ঢাকা: গুলশান, বনানী, বারিধারা— দেশের সবচেয়ে অভিজাত এলাকা হিসেবেই পরিচিত। সুউচ্চ মনোরম ভবন, পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট, পার্ক, মাঠ, শপিং মল মিলিয়ে ঝাঁ চকচকে রূপ। এই এলাকাতেই একদিকে যেমন বসবাস ধনিক শ্রেণির, অন্যদিকে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতগুলোও অবস্থিত। ‘প্রদীপের নিচে অন্ধকারে’র মতো সেই ঝাঁ চকচকে রূপের পাশেই দেখা মেলে কদর্য রূপেরও। পুরো এলাকায় বিস্তৃত যে লেক, সেই লেকই বয়ে বেড়াচ্ছে নোংরা আর দূষিত পানি, ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। সেই লেকই যেন বিভিন্ন এলাকায় পরিণত হয়েছে ভাগাড়ে!
গুলশান-বনানী এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এলাকাজুড়ে লেকের কোথাও কোথাও পরিবেশ এতটাই খারাপ যে নাক না ঢেকে রাস্তা পার হওয়ার উপায় নেই। কালো মিশমিশে নোংরা পানির পাশাপাশি লেকের দুই পারে জমে থাকা আবর্জনায় লেকের পারকে ডাস্টবিনও মনে হতে পারে। কর্তৃপক্ষের দাবি, নিয়মিতই পরিষ্কার করা হয় এই লেক। আশপাশের বাসাবাড়ির সুয়ারেজ লাইন লেকের পানিতে যুক্ত হওয়াকে দুর্গন্ধের কারণ হিসেবে অভিহিত করছে তারা।
সরেজমিনে গুলশান-বনানী-বারিধারা-নিকেতন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, গুলশান-২ থেকে বনানী যাওয়ার পথে কামাল আতাতুর্ক সড়কের সেতুর অংশে লেক ভয়াবহ দূষণের শিকার। প্রচণ্ড দুর্গন্ধে পথচারীরা নাকে হাত চেপে দ্রুত পার হয়ে যাচ্ছেন। দেখা গেল, লেকের দুপাশেই নানা ধরনের বর্জ্য জমে আছে। পানির ওপর সবুজ রঙের আস্তরণ। কোথাও কোথাও তা নীলচে রঙ ধারণ করেছে। সেতুর নিচের পাইপ দিয়ে আসছে কালো দুর্গন্ধযুক্ত পানি।
দূষণের এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখা যায় গুলশান, বারিধারা, বনানীর বিভিন্ন স্থানেও। কোথাও দূষিত পানির দুর্গন্ধে টেকা দায়, কোথাও দূষণের ফলে পানি কালো রঙ ধারণ করেচে। লেকের ভেতরে ও পাড়ে জমে থাকা আবর্জনার স্তূপ তো আছেই। সব মিলিয়ে এই এলাকার বাসিন্দাদের পাশাপাশি অফিসগামীদেরও জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে লেকের এই দূষণের জন্য। এর মধ্যে ডিপ্লোম্যাটিক জোন অংশের লেকের অবস্থা তুলনামূলক ভালো। এলাকাটি সংরক্ষিত ও লেকের পাড় মূল রাস্তা থেকে দূরে হওয়ায় এই লেকে বর্জ্য ফেলা হয় না বললেই চলে।
বনানীর কামাল আতাতুর্ক সড়কে অবস্থিত একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন সালমা ইসলাম। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘উত্তর বাড্ডা থেকে অফিসে আসার পথে ব্রিজটুকু পার হতে গেলেই গন্ধ পাই। গাড়ির কাঁচ উঠানো থাকলে অতটা না পাওয়া গেলেও সিএনজি, মোটরসাইকেল বা হেঁটে আসতে গেলে গন্ধ লাগেই। এত সুন্দর একটা এলাকা। লেকের পাড়েই ফুলের গাছ, সুন্দর সুন্দর ভবন। কিন্তু লেকের এই অবস্থা দেখতেই খারাপ লাগে।’
গুলশান লেকের দুর্গন্ধ ও অপরিচ্ছন্নতা নিয়ে অভিযোগ শুধু বড়দেরই নয়, শিশুদেরও। মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের কয়েকজন শিক্ষার্থীরে সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা বলছিল, স্কুলের পাশেই গুলশান লেকের একটি অংশ। সেই অংশের দুর্গন্ধে স্কুল করা মুশকিল হয়ে পড়ে তাদের জন্য।
লেকের এই দুরবস্থা নিয়ে স্বয়ং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামও ওয়াকিবহাল। গত ১৬ মার্চ লেক পরিষ্কার কার্যক্রমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি গুলশান লেকের কিছু অংশের অবস্থা ‘জাহান্নামের চেয়েও খারাপ’ বলে অভিহিত করেন। লেকের এই দূষিত পানিতে মাছ নয়, মশার চাষ হয় বলেই ওই এলাকায় মশা বেশি বলেও মন্তব্য করেন তিনি। লেকের আশপাশের ভবনগুলোর পয়ঃবর্জ্যের সংযোগ লেকের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার জন্য রাজউককে দায়ী করেন তিনি।
লেকের এই দুরবস্থার দায় কার— এমন প্রশ্নের উত্তরে এই এলাকার ভবনগুলোর সুয়ারেজ ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলার পাশাপাশি লেকের তদারকি নিয়ে অব্যবস্থাপনার কথাই উঠে আসছে। ডিএনসিসি বলছে, এই এলাকার অধিকাংশ বাড়িতেই নেই নিজস্ব স্যুয়ারেজ ব্যবস্থাপনা। তাদের এক জরিপের তথ্য বলছে, গোটা এলাকার তিন হাজার ৮৩০টি বাড়ির মধ্যে দুই হাজার ২৬৫টি বা প্রায় ৮৫ শতাংশ বাড়ির স্যুয়ারেজ লাইনের সংযোগই দেওয়া হয়েছে লেকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীতে ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা দুই ধরনের। এর মধ্যে স্টর্ম ওয়াটার ড্রেনের মাধ্যমে বৃষ্টির পানি এবং বাথরুম ছাড়া বাসাবাড়ির অন্যান্য কাজের জন্য ব্যবহৃত পানি লেকে বা খালে ফেলা হয়, যার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। আরেকটি ড্রেন হলো মলমূত্র বহনের জন্য সুয়ারেজ লাইন, যার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ওয়াসার। অন্যদিকে লেকের তদারককারী সংস্থা হলো রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।
সিটি করপোরেশন বলছে, এই অঞ্চলের ভবন মালিকরা কোটি কোটি টাকা খরচ করে বাড়ি করলেও সুয়ারেজের সংযোগ লাইন মিশিয়ে দিয়েছেন স্ট্রর্ম ওয়াটার ড্রেনেজের সঙ্গে, যা গিয়ে মিশছে লেকের পানিতে। এখন ভবনের নকশাজনিত এই বিষয়টি ছাড়াও লেক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব রাজউকের হাতে থাকায় সিটি করপোরেশন বেশি কিছু করতে পারে না।
লেক পরিষ্কারের দায়িত্ব কার— সেটি নিয়েও রয়েছে জটিলতা। লেকের ভেতরের অংশ পরিষ্কার রাখবে রাজউক, আর লেকের চারপাশের কঠিন বর্জ্য সরানোর দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। দুই সংস্থার সমন্বয়ের অভাবেই এত বর্জ্য জমেছে কি না— জানতে চাইলে দুই প্রতিষ্ঠানেরই দাবি, তারা তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছে। তারা নিয়মিতই পরিষ্কার করছে। মূল সমস্যা সুয়ারেজ লাইনের বর্জ্য।
জানতে চাইলে গুলশান সোসাইটির সভাপতি ওমর সাদাত সারাবাংলাকে বলেন, ‘গুলশান-বনানী লেকের সমস্যা একদিনের না। ৪০-৫০ বছর ধরে এখানে গুলশান, বনানী, বাড্ডা, নিকেতন ইত্যাদি এলাকার সুয়ারেজের লাইন মিশেছে। তার জন্যই এত দুর্গন্ধ ও দূষণ। তাছাড়া এটি স্ট্রাকচারাল (কাঠামোগত) সমস্যা। একদিনে এর সমাধান করা যাবে না।’
সুয়ারেজ লাইনের সমস্যা তো আছেই, গুলশান লেককে আশপাশের এলাকার ডাস্টবিন হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতাও রয়েছে। আশপাশের বাজারের বর্জ্য তো বটেই, ভাসমান হকারদের বর্জ্য এবং এমনকি বাসাবাড়ির বর্জ্যও এই লেকে ফেলা হয়। ফলে লেক পরিষ্কারের সময় ডাবের খোসা, প্লাস্টিকের বোতল, চিপস বা বিস্কুটের প্যাকেট থেকে শুরু করে নানা ধরনের পলিবর্জ্য ও অন্যান্য কঠিন বর্জ্য উঠে আসে।
এদিকে লেকের দীর্ঘ এলাকা পাড়ি দিয়েও পাশে কোনো বর্জ্য সংগ্রহের স্থায়ী বা অস্থায়ী বিন দেখা যায়নি। তাছাড়া রাজউকের লোকজনকেও পানি থেকে বর্জ্য তুলে পারে জমা করতে দেখা যায়। স্থানীয়রাও বলছেন, লেকের পানি থেকে ছেঁকে ময়লা নিয়ে আবার পারেই জমা করা হয়। সেই ময়লা সরিয়ে ফেলা হয় না। ফলে বৃষ্টি নামলেই তা আবারও লেকের পানিতে গিয়ে মেশে।
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকা উত্তর সিটির অধীন গুলশান-বারিধারা লেক, বনানী লেকের দায়িত্ব আমাদের। এসব লেকের ভেতরটা আমরাই পরিষ্কার করি। আমরা ময়লা তুলে দিলে সিটি করপোরেশন তা সংগ্রহ করে। লেক দেখভালের জন্য আলাদা টিমই আছে।’
নিয়মিত পরিষ্কার করলেও লেকের পানির দুর্গন্ধ ও পারের আবর্জনার স্তূপ নিয়ে জানতে চাইলে রাজউকের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘মূলত সুয়ারেজ লাইনের জন্যই এই অবস্থা। বাসাবাড়িতে এসটিপি প্ল্যান্ট কেউই করতেই চায় না। আইনি বিধিমালার মধ্যে থাকলেও অনেকে নিয়ম ভেঙে মলমূত্রের লাইন লেকে দেন। আর আমরা নিয়মিতই পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালাই। তারপরও কোথাও ময়লা জমে থাকলে সেটি অপসারণ করা হবে।’
এদিকে সিটি করপোরেশন বলছে, লেকের পারে ময়লা থাকার কথা না। এগুলো নিয়মিতই সংগ্রহ করা হয়। তাছাড়া লেক পরিষ্কারের দায়িত্ব রাজউকের হলেও সিটি করপোরেশন মাঝেমধ্যেই নিজ উদ্যোগে এসব লেক পরিষ্কার করে থাকে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান বর্জ্য কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন ফিদা হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘লেকগুলোর দূষণের জন্য প্রধানত দায়ী বাসাবাড়ির সুয়ারেজের লাইন। আর লেকের পানি পরিষ্কারের জন্য আমরা দায়িত্বশীল সংস্থা না হলেও মাঝেমধ্যেই লেক পরিষ্কার করি। তবে এখানে যারা ময়লা ফেলছে, তারা বেআইনি কাজ করছে। তারাও সমানভাবে দায়ী। রাজউক বর্জ্য পরিষ্কার করে নির্দিষ্ট জায়গায় রাখলে নিয়ম অনুযায়ী সিটি করপোরেশন সেটি সংগ্রহ করে ডাম্প করে।’
লেকের পারে বাজার, হকার ও ভাসমান খাবারের দোকান থেকেও অনেক আবর্জনা লেকে মেশে। এসব দোকানদারদের সম্পর্কে সিটি করপোরশনের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘বাজারের বর্জ্যও বাসাবাড়ির বর্জ্যের মতো সিটি করপোরেশনই নিয়ে যাবে। নির্দিষ্ট জায়গায় ময়লা না ফেলে লেকের পানিতে ফেললে তার মাধ্যমেও আইন ভঙ্গ করা হয়।’
লেকের চারপাশে কোন বিন বা নির্দিষ্ট ময়লা ফেলার জায়গা না থাকা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ক্যাপ্টেন ফিদা হাসান বলেন, ‘বিন দিলেও সেগুলো কীভাবে চুরি হয়, তা কারও অজানা নয়। এসব সমস্যার সমাধানে কার্যক্রম চলমান। সীমাবদ্ধ শক্তি নিয়েই আমরা নগরকে পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কমিউনিটি এং গেজমেন্টও গুরুত্বপূর্ণ। লেকে ময়লা না ফেলার জন্য আমরা নিয়মিত মানুষকে সচেতন করার কাজও করে যাচ্ছি। ময়লা নির্দিষ্ট জায়গায় রাখলে তা আমাদের কর্মীরাই নিয়ে যাবে।’
এদিকে গুলশান সোসাইটির সভাপতি ওমর সাদাত বলেন, ‘আমরা সিটি করপোরেশনের সঙ্গে মিলিতভাবে লেক পরিষ্কার কার্যক্রম চালাচ্ছি। ভাসমান দোকানকে সতর্কবার্তা দেওয়া হয় যেন ময়লা না ফেলে। এ ছাড়া আমরা বিন চুরি ঠেকাতে এখন আধুনিক বিন বসাচ্ছি। এখানে অ্যালার্ম সিস্টেম থাকবে। চুরি করতে গেলেই অ্যালার্ম বেজে উঠবে। আশা করছি দুই-তিন মাসের মধ্যেই দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখা যাবে।’
সারাবাংলা/আরএফ/টিআর
ওয়াসা গুলশান লেক গুলশান-বনানী লেক রাজউক লেক দূষণ সিটি করপোরেশন