Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আড়াই হাজার বছর আগের ভূমিকম্প পাল্টে দেয় গঙ্গার গতিপথ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
৬ জুলাই ২০২৪ ১১:৪৯

ঢাকা: সম্প্রতি প্রকাশিত নতুন এক গবেষণাপত্রে দাবি করা হয়েছে আড়াই হাজার বছর আগে বড়মাত্রার ভূমিকম্প গঙ্গা (বাংলাদেশে পদ্মা) নদীর গতিপথ পাল্টে দিয়েছে। ওই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭.৫ বা ৮। এর ফলে যে তীব্র ঝাঁকুনি সৃষ্টি হয় তাতে  পাল্টে যায় নদীটির চলার পথ।

ন্যাচার কমিউনিকেশন জার্নালে সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায় এ তথ্য জানানো হয়েছে।

অনলাইন লাইভ সায়েন্স এর খবরে বলা হয়, গঙ্গার মূল প্রবাহ ভূমিকম্পের উৎস থেকে ১১০ মাইলের বেশি দূরে থাকলেও তা বিচ্যুত হয়।

এর আগে গবেষকরা প্রামাণ্য আকারে দেখিয়েছেন যে, সিসমিক কারণে বা ভূমির কম্পনে এই ঘটনা ঘটে। নিউ ইয়র্কে কলাম্বিয়া ক্লাইমেট স্কুলের ল্যামন্ট-ডোহার্টি আর্থ অবজার্ভেটরির ভূ-পদার্থবিদ ও গবেষক, প্রফেসর মাইকেল স্টেকলার এই গবেষণার সহ-লেখক।

বিশ্বে সবচেয়ে বড় নদীগুলোর অন্যতম গঙ্গা। এই নদী প্রবাহিত হয়েছে প্রায় ১৬০০ মাইল। এর সূত্রপাত হিমালয়ে ভারত ও চীন সীমান্তের মধ্যবর্তী স্থানে। তারপর তা পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা সহ কতগুলো বড় বড় নদীর সঙ্গে সে মিশে গেছে। পানির এই সম্মিলিত ধারা বিশ্বে সবচেয়ে বড় ব-দ্বীপ সৃষ্টি করেছে। তারপর তা বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পতিত হয়েছে।

স্যাটেলাইটে পাওয়া ছবিতে বিজ্ঞানীরা প্রথমে তথ্যসূত্র পেয়েছেন যে, অতীতে খুবই ভয়ঙ্করভাবে গঙ্গা তার গতিপথ পাল্টে ফেলেছে।

এতদিন বিজ্ঞানীদের কাছে ওই ভয়ানক ভূমিকম্পের তথ্য অজানা ছিল। ঢাকার অদূরের বিশাল অঞ্চলের ভূমির গঠন ওলট-পালট করে দেওয়া বিপুল সেই শক্তির মাটির গভীর থেকে ফুঁড়ে বেরিয়ে আসার কিছু কারণ জানতে পেরেছেন গবেষকরা।

তারা প্রথমবারের মত এমন তথ্য সামনে এনেছেন ‘ন্যাচার কমিউনিকেশনস’ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে। এতে বলা হয়, রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৫ থেকে ৮ তীব্রতার প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে আঘাত করে ভূমিকম্পটি, যার প্রভাবে পদ্মা বা গঙ্গার মূল গতিপথ বহু দূর সরে যায়। যদিও ভূমিকম্পের কেন্দ্র থেকে সরে যাওয়া পদ্মার অংশটির দূরত্ব ছিল অন্তত ১৮০ কিলোমিটার।

নদীর গতি পরিবর্তনের চলমান প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘অ্যাভালশন’ বা ‘ছিন্নকরণ’। ভূমিকম্পের কারণে নদীর অ্যাভালশনের নজির আগেই পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। গবেষণাপত্রটি সম্পর্কে এক বিবৃতিতে এর সহ-লেখক মাইকেল স্টেকলার বলছেন, ‘আমার মনে হয় না, (পদ্মা) নদী ছিন্নকরণের এমন বিশাল ঘটনা আগে কেউ কখনও দেখেছেন।’

তার বিবৃতির তথ্য অনুযায়ী, অতীতে পদ্মার গতিপথ বদলানোর সূত্র তারা প্রথমবার ধরতে পারেন স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করে। চিত্রগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সময় তারা দেখতে পান, ঢাকার প্রায় ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণের অবস্থানে পদ্মার কাছে মাটির গভীরে সমান্তরালে পুরোনো নদীর মত একটি চ্যানেল রয়েছে।

চ্যাম্বারলাইন লিখেছেন, এরপর তারা আরও তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের জন্য ঢাকার দক্ষিণের ওই অঞ্চলে অনুসন্ধান শুরু করেন এবং কাদামাটির নিচে পুরোনো চ্যানেলের মত আঁকাবাঁকা আরও পথ খুঁজে পান।

ভূমিকম্পের কারণে কাদামাটির নিচে এমন উলম্ব আঁকাবাঁকা বালির চ্যানেল তৈরি হয়, যেগুলোকে ‘সিসমাইট’ বা ভূকম্পনের ফলে সৃষ্ট ‘বালির উলম্ব বেণী’ বলা হয়।

চ্যাম্বারলাইন ও তার সহকর্মীরা এটা প্রমাণ করতে পেরেছেন, ঢাকার দক্ষিণে পদ্মার সমান্তরালে চলা বালির উলম্ব বেণীগুলো আসলেই সিসমাইট অর্থাৎ ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট চ্যানেল। তারা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, একটি ঘটনা থেকেই চ্যানেলগুলো তৈরি হয়।

মাটি ও বালির রাসায়নিক পরীক্ষায় তারা এটিও দেখতে পেয়েছেন, গবেষণা অঞ্চলটিতে অন্তত আড়াই হাজার বছর আগে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়।

ওই শক্তিশালী ভূমিকম্প দুটি কারণের যে কোনো একটির জন্য হয়েছিল বলে বিশ্বাস চ্যাম্বারলাইন ও তার সহকর্মীদের।

প্রথমত, ভারতের উত্তর-পূর্বের শিলং মাসিফ অঞ্চলে ভারতীয় টেকটোনিক প্লেট ও ইউরেশিয়ান প্লেটের মধ্যে টক্করের কারণে আড়াই হাজার বছর আগের ওই ভূমিকম্পটি হয়ে থাকতে পারে।

দ্বিতীয়ত, ভারত মহাসাগরের খড়িমাটি ক্রমেই বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও উত্তর-পূর্ব ভারতীয় প্লেটের নিচে আরও গভীরে ডুবতে থাকার চাপজনিত শক্তির বিস্ফোরণ ঘটে। তবে যে দুই অঞ্চলে ঘটা ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার কারণে ভূমিকম্পটির সৃষ্টি হয়েছিল, সেখান থেকে পদ্মার গতিপথ বদলের যাওয়ার বা বালির চ্যানেলগুলো খুঁজে পাওয়ার স্থানের দূরত্ব অন্তত ১৮০ কিলোমিটার।

এর আগে অধ্যাপক মাইকেল স্টেকলারের নেতৃত্বে শিলং মাসাফি ও ইন্দো-বার্মা অঞ্চলের প্লেট বিশ্লেষণ করে ২০১৬ সালে একটি সমীক্ষা প্রকাশ করা হয়। তাতে বলা হয়, সাড়ে ৭ বা ৮ তীব্রতার শক্তিশালী ভূমিকম্প আবারও এ অঞ্চলে আঘাত করতে পারে। এর প্রভাব পড়তে পারে ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষের ওপর।

ভূমিকম্পে তৈরি ‘বালির আগ্নেয়গিরি’

একদিন কাজ শেষে হোটেলে ফেরার পথে ঢাকার রাস্তার পাশে খুঁড়ে রাখা নতুন গর্ত দেখতে পান গবেষক দল। গর্তটি নতুন খোঁড়া হওয়ায় ওটার স্ট্র্যাটিগ্রাফি—অর্থাৎ গর্তের দেয়ালে পলিমাটির স্তর দেখতে পাচ্ছিলেন তারা। ওই স্তর দেখে তারা সঙ্গে সঙ্গে গর্তে নেমে যান বলে জানান চেম্বারলেন।

গর্তটিতে গাঢ় কালো রঙের মাটিতে ১০ ফুট উচ্চতার হালকা রঙের পলিমাটির কলাম (স্তম্ভ) দেখতে পান গবেষকরা। ভূমিকম্পের কারণে নদীর গতিপথ বদলানোর কারণেই এখানে গাঢ় রঙের মাটির সঙ্গে হালকা রঙের পলিমাটি মিশে রয়েছে।

যখন ভূমিকম্প হয়, নদীগর্ভে জমে থাকা হালকা পলিমাটি সরে গিয়ে নিচের এ গাঢ় কাদা উপরে উঠে আসে আগ্নেয়গিরির উদগীরণের মতো।

চেম্বারলেন এ বিষয়ে বলেন, ‘ভূমিকম্পের সময় যে কম্পন হয়, তাতে বালি ও কাদা জায়গা থেকে সরে যায়। আর বালি ও কাদার নড়াচড়া আলাদা। কাদা খুব আঠালো, পরস্পরের সঙ্গে খুব শক্তভাবের যুক্ত থাকে। অন্যদিকে বালির স্তর হালকা হয়। বালির কণা কিছুটা মুক্তভাবে নড়াচড়া করে, বিশেষ করে পানিতে থাকার সময়।’

তাই ভূমিকম্পের সময় বালি বেশি নড়াচড়া করে, জায়গাও বেশি নেয়। আর কাদামাটি এ বালিকে চাপ দিলে ব্যাপক চাপের সৃষ্টি হয়। ওই চাপ অনেক বেশি হলে কাদামাটির নিচে থাকা বালি ঠেলে ওপরে চলে আসতে পারে। আর তাতেই সৃষ্টি হয় ‘বালির আগ্নেয়গিরি’।

গবেষণাটির সহলেখক ও নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া ক্লাইমেট স্কুল ল্যামন্ট-আর্থ অবজারভেটরির ভূ-পদার্থবিদ ড. মাইকেল স্টেকলার তার ২০১৬ সালের এক গবেষণায় উল্লেখ করেছেন, টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষ কীভাবে গাঙ্গেয় গঙ্গার বদ্বীপ এলাকার চেহারা বদলে দিয়েছিল। পৃথিবীর উপরিভাগের কতগুলো বিশাল অনমনীয় প্লেটকেই টেকটোনিক প্লেট বলা হয়। এরা খুব ধীরে ধীরে নড়াচড়া করে। কোনো কারণে প্লেটগুলোর নিজেদের মধ্যে বড় ধরনের সংঘর্ষ হলেই সৃষ্টি হয় ভূমিকম্প।

পলিমাটি প্রকাশ করল প্রাচীন রহস্য

বিশাল মাত্রা ভূমিকম্পটি কবে হয়েছিল, তা জানতে ঢাকায় খোঁড়া গর্তের মাটির নমুনাগুলোর অপটিক্যাল স্টিমুলেটেড লুমিনিসেন্সস পরীক্ষা করেন চেম্বারলেন ও তার সহকর্মীরা। এ পরীক্ষার মাধ্যমে মাটির নমুনাগুলো সর্বশেষ কত সময় আগে সূর্যালোকের সংস্পর্শে এসেছিল, তা নির্ণয় করা হয়।

চেম্বারলেন জানান, এ মাটির কণাগুলো যখন চাপা পড়া অবস্থায় থাকে, তখন এগুলোতে বিকিরণের মাত্রা কম থাকে। সে কারণে এগুলোর মধ্যে শক্তি সঞ্চিত থাকে। চেম্বারলেন ও তার সহকর্মীরা এক ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করে এ মাটির কণা কতটুকু বিকিরণের সংস্পর্শে এসেছে, তা নিরূপণ করেন। এর মাধ্যমে মাটিগুলো ভূমিকম্পের কারণে চাপা পড়ে সূর্যালোকের সংস্পর্শের বাইরে ছিল, তা বের করা যায়।

গবেষকদের হিসাব অনুযায়ী, এ বালির আগ্নেয়গিরি গঠিত হয়েছে আড়াই হাজার বছর আগে, অর্থাৎ মাটির কণাগুলো ২ হাজার ৫০০ বছরের পুরনো। চেম্বারলেন ও তার দল মাটির বয়স বের করার এ কাজ করেছেন ডার্করুমে, যাতে আলোর সংস্পর্শে এসে পলির নমুনা ‘দূষিত’ না হয়ে পড়ে।

ঢাকায় রাস্তার পাশের যে গর্তে বালির আগ্নেয়গিরি পাওয়া গেছে, সেখান থেকে ৮৫ কিলোমিটার দূরেও একটি বড় নদীর চ্যানেল পান বিজ্ঞানীরা। ওই নদী থেকে মাটির আরও কিছু নমুনা সংগ্রহ করেন তারা। পরীক্ষা করে দেখেন, সেগুলোও একই সময়ের মাটির কণা।

ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলস-এর সিভিল ও পরিবেশ প্রকৌশলবিদ্যার অধ্যাপক ড. জনাথন স্টুয়ার্ট বলেন, ‘প্রকৌশলগত দিক থেকে, নদীর গতিপথের এ অস্থিতিশীলতা চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

গবেষণাটি বিভিন্ন দিক থেকে বাংলাদেশের জন্য উপকারী বলে মন্তব্য করেন তিনি। কারণ বাংলাদেশে কত সময় পরপর বড় ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে এবং আঘাত হানলে কোন অঞ্চলগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সে বিষয়ে আরও অনেক তথ্য দিতে পারবে এ গবেষণা।

সারাবাংলা/একে

গঙ্গা গঙ্গার গতিপথ টপ নিউজ ভূমিকম্প


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর