নতুন বিদ্যুৎ সংযোগের নামে কমলগঞ্জে লাখ টাকার বাণিজ্য
২ জুন ২০১৮ ০৮:৫১
।। হৃদয় দেবনাথ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট ।।
মৌলভীবাজার: মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার রহিমপুর ইউনিয়নে নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার নামে স্থানীয় কিছু জনপ্রতিনিধি ও সরকার দলীয় নেতার বিরুদ্ধে লাখ লাখ টাকা আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। ২০১৫ সাল থেকে শুরু করে আগ্রহীরা গ্রাহকরা একাধিকবারে এই টাকা দিলেও এখনও বিদ্যুৎ সংযোগ পাননি।
বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য টাকা দিয়েছেন— এমন পাঁচ ব্যক্তি এলাকাবাসীর পক্ষে জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মৌলভীবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজারের কাছে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করলে বিদ্যুৎ সংযোগের নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়টি সামনে চলে আসে।
অভিযোগ করা পাঁচ জন হলেন— বড়চেগ গ্রামের মসুদ আলী, মাসুক মিয়া, মো. আসাদ, আমির হোসেন ও জোবায়ের আহমদ। তারা বলছেন, বিদ্যুতায়নের দ্বিতীয় দফায় স্থানীয় ওয়ার্ড সদস্য মাহমুদ আলী ও আওয়ামী লীগ নেতা সুলেমান মিয়া বড়চেগ গ্রামের গ্রাহকদের কাছ থেকে ২৭ লাখ টাকা চাঁদা নিয়েছেন। দ্বিতীয় দফায় মিটারপ্রতি অতিরিক্ত দুই হাজার টাকা নেয়ারও অভিযোগও রয়েছে তাদের।
অভিযোগে বলা হয়, প্রতিটি গ্রাহকের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা থেকে শুরু করে এক প্রবাসী পরিবারের কাছ থেকে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা নিয়েছেন অভিযুক্তরা। শুধু তাই নয়, কেবল চাঁদা না দেওয়ার কারণে গ্রামের ৮০টি পরিবারকে বিদ্যুৎ সংযোগের বাইরে রাখা হয়েছে বলেও অভিযোগ করা হয়।
এদিকে, এ ঘটনার সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে সম্প্রতি স্থানীয় দুই সংবাদকর্মীর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক ব্যবহার করে তাদের আটকে রাখেন মাহমুদ আলী। ওই দুই সংবাদকর্মীকে প্রাণনাশের হুমকিও দেওয়া হয়। ওই ঘটনায় কমলগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন একজন গণমাধ্যমকর্মী।
সরেজমিনে গ্রাহকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর শতভাগ বিদ্যুতায়ন সিদ্ধান্তের আওতায় রহিমপুর ইউনিয়নের বড়চেগ গ্রামে গত বছরের শেষ দিকে প্রথম দফায় ৫ কিলোমিটার ও দ্বিতীয় দফায় সাড়ে চার কিলোমিটার বিদ্যুতায়নের কাজ শুরু হয়। এই কাজের জন্য মোট ৫৬৬ জন গ্রাহকের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পরিমাণের অর্থ আদায় করা হয়।
এলাকাবাসী জানান, সাবেক চিপ হুইপ ও বর্তমান সাংসদ উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ এমপির ছোট ভাই আওয়ামী লীগ নেতা ও রহিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের নামে ওয়ার্ড সদস্য মাহমুদ আলী, সুলেমান মিয়া, জয়নাল মিয়া, মিন্নত আলী চাঁদা আদায় করছেন। এক প্রবাসী পরিবার পল্লী বিদ্যুতের পরিচালক মো. আব্দুল আহাদেরও এই প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকার অভিযোগ করেন।
বড়চেগ গ্রামের হাদিস মিয়া বলেন, দু’টি মিটারের জন্য ১৪ হাজার টাকা দিয়েছেন। টাকা না দিলে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে না—এই ভয় থেকেই তিনি টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিদ্যুতের খুঁটি পৌঁছেনি তার বাড়িতে। একই গ্রামের মো. খিজির মিয়া বলেন, আমার কাছ থেকে চার লাখ ৭৫ হাজার টাকা নিয়েছে। এটা সরকারি বিদ্যুৎ, তা বুঝতে পারিনি। তাই টাকা দিয়েছি।
এ ঘটনায় নিজের জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে স্থানীয় ইউপি সদস্য মাহমুদ আলী সারাবাংলা’কে বলেন, ‘শুনেছি জয়নাল মিয়া ও সুলেমান মিয়া বিদ্যুৎ নিয়ে ঠিকাদারের সাথে দৌড়াদৌড়ি করছে। এলাকায় কাকে বিদ্যুৎ দেওয়া যায়, কাকে দেওয়া যায় না, সেটা তারাই ঠিক করে।’
গ্রাহকদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়া হচ্ছে কিনা— জানতে চাইলে এই ইউপি সদস্য বলেন, ‘আমি শুনেছি মিটার সিকিউরিটির টাকা দিচ্ছেন গ্রাহকরা।’ সাংবাদিকদের কেন আটকে রেখেছিলেন— জানতে চাইলে তিনি এ অভিযোগ অস্বীকার করেন।
একই অবস্থা ইউনিয়নের কালাছড়া জগন্নাথপুর, রামচন্দ্রপুরসহ অন্যান্য গ্রামেও। জানা যায়, রামচন্দ্রপুর গ্রামে ২০১৫ সালের মে মাসে প্রথম দফায় ৩.৮৮৯ কিলোমিটার বিদ্যুতায়নের কাজ শুরু হয়। এলাকাবাসী জানায়, সাবেক ওয়ার্ড সদস্য আব্দুল মজিদ খানের মাধ্যমে ২২৬ জন গ্রাহকের একেকজনের কাছ থেকে তিন হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়। বড় অঙ্কের টাকা প্রবাসী পরিবারগুলোর কাছ থেকে আদায় করা হয়। গ্রাহকদের অভিযোগ, এই পুরো প্রক্রিয়ার তত্ত্বাবধানে ছিলেন রহিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইফতেখার আহমেদ বদরুল।
২০১৬ সালের প্রথম দিকে লাইন নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার পর মিটার সংযোগের নামে গ্রাহকদের কাছ থেকে বাড়তি দুই হাজার পাঁচশ টাকা করে আদায় করা হয়। যদিও সরকারিভাবে মিটার সিকিউরিটি ফি ৬শ টাকা ও সদস্য ফি ৫০ টাকা বলে জানা গেছে বিদ্যুৎ কার্যালয় থেকে। সরকারি নির্ধারিত এই ফি’র চেয়ে বাড়তি টাকা দিয়েও বিদ্যুৎ সংযোগ পাননি গ্রাহকরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আব্দুল মজিদ খান মোবাইল ফোনে সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই টাকা তো চেয়ারম্যান সাবের মাধ্যমে তোলা (আদায়) হয়েছে। আমি উনার কাছে দিয়েছি।’
সাবেক মেম্বার আব্দুল মজিদ খানের কথার উদ্ধৃতি দিয়ে প্রশ্ন করা হলে রহিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইফতেখার আহমেদ বদরুল বলেন, ‘এটা সম্পূর্ণভাবে ভিত্তিহীন, মিথ্যা ও বানোয়াট। তবে মিটার সিকিউরিটির জন্য যে টাকা তোলা হয়েছে তা অবশ্যই জমা দেওয়া হয়েছে।’
বড়চেগ গ্রামের মানুষের অভিযোগ প্রসঙ্গে এই ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, ‘কেউ টাকা-পয়সা নিলে আমার কাছে অভিযোগ করবে। কিন্তু কেউ তো অভিযোগ করেনি। তবে ঠিকাদারের লোকজন হয়তো টাকা-পয়সা খাওয়ার জন্য এদিক-সেদিক বলতে পারে। এ জন্য কেউ টাকা-পয়সা দিয়ে থাকলে সেটা অন্য জিনিস।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হাজাঙ্গীর আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঠিকাদাররা কোনো ধরনের আর্থিক লেনদেন করতে পারেন না। কারো বিরুদ্ধে এরকম অভিযোগ উঠলে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ নেবো। আর রামচন্দ্রপুর গ্রামের বিদ্যুতায়নে দেরি হয়েছে। তবে দ্রুত আমরা সংযোগের ব্যবস্থা করছি।’
জানতে চাইলে মৌলভীবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী শিবু লাল বসু সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের স্পষ্ট কথা, এই বিদ্যুৎ বিনা খরচে সরকার দিচ্ছে। তবে কিছু কিছু এলাকায় অর্থ নেওয়ার অভিযোগ আমাদের কাছে আসছে, আমরা ব্যবস্থাও নিচ্ছি। এসব দুর্নীতি একেবারে শেকড়ে চলে গেছে। এগুলো উপড়ে ফেলতে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। মানুষকে আমরা বিভিন্নভাবে সচেতন করার চেষ্টা করছি।’
প্রকৌশলী শিবু লাল আরো বলেন, ‘এখানে ঠিকাদারের লোকও জড়িত থাকার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। আমরা এক ঠিকাদারকে এরই মধ্যে কালো তালিকাভুক্ত করেছি, আরেক ঠিকাদারের লোককে হাতেনাতে ধরে থানায় সোপর্দ করেছি। আমরা এই ব্যাপারে সোচ্চার।’
রামচন্দ্রপুর, বড়চেগসহ রহিমপুর ইউনিয়নের মানুষের প্রতি মৌলভীবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার আহ্বান জানান, কোনো দালালকে যেন কেউ টাকা না দেন। চলতি বছরের জুলাইয়ের মধ্যে এই ইউনিয়নে শতভাগ বিদ্যুতায়ন নিশ্চিত হবে বলেও আশ্বাস দেন তিনি।
সারাবাংলা/টিআর