বিসিএসে ৫০ লাখ, অন্যান্য চাকরি পেতে চুক্তি হতো ২০ লাখ টাকায়
৯ জুলাই ২০২৪ ২৩:০৯
ঢাকা: বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) ও অন্যান্য নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে একের পর এক তথ্য বেরিয়ে আসছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে গ্রেফতার কয়েকজন এরই মধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তদন্তে নিয়োজিত পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কর্মকর্তারাও তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। সেসব জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।
সিআইডির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই চক্রের সঙ্গে প্রার্থীদের একটি চুক্তি হতো। চুক্তি অনুযায়ী বিসিএসের জন্য প্রার্থীকে দিতে হতো ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা। তিন ধাপে এই টাকা দেওয়ার জন্য চুক্তি হতো। এ ছাড়া অন্যান্য চাকরির পরীক্ষার জন্য ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকার চুক্তি হতো। এ সব টাকা ধাপে ধাপে নেওয়া হতো।’
সরকারি চাকরির প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ১৭ জনের নামে মঙ্গলবার (৯ জুলাই) মামলা হয়েছে। তাদের সবাইকে সিআইডি কার্যালয় এ দিন আদালতে হাজির করে পুলিশ। এর মধ্যে ছয়জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
এর আগে সিআইডি কার্যালয়ে মামলার তদন্তে নিয়োজিত কর্মকর্তারা গ্রেফতার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। কর্মকর্তাদের অনেকেই গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন। জানিয়েছেন প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের বিভিন্ন কর্মকৌশলের কথা।
আরও পড়ুন-
- প্রশ্নফাঁস: ৫ জনকে পিএসসি থেকে বরখাস্ত
- নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস, পিএসসি কর্মকর্তাসহ গ্রেফতার ১৭
- প্রশ্নফাঁস: স্বীকারোক্তির জন্য ৭ জন আদালতে, কারাগারে ১০ জন
- প্রশ্নফাঁস: আবেদ আলীর ছেলে সিয়ামকে ছাত্রলীগ থেকে অব্যহতি
সিআইডির এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে জানান, বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে প্রার্থীদের নির্বাচন করা হতো। টাকা দেওয়ার সামর্থ্যবান যারা, কেবল তাদেরই আলাদা করে কোচিং করানো হতো। এরপর ধীরে ধীরে তাদের টাকার বিনিময়ে চাকরির নিশ্চয়তার টোপ দেওয়া হতো। তাদের সঙ্গে চুক্তি করা হতো।
জিজ্ঞাসাবাদে উঠে এসেছে, প্রার্থী নির্বাচন ও তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার সিংহ ভাগ কাজ করতেন পিএসসির উপপরিচালক আবু জাফর। গ্রেফতার এই ব্যক্তি মালিবাগে জ্যোতি ইনস্টিটিউট নামে একটি কোচিং সেন্টার চালাতেন স্ত্রীর নামে। অন্যদিকে গ্রেফতার আরেকজন এস এম আলমগীর কবির মিরপুরে একটি কোচিং সেন্টার চালাতেন। এ দুটি কোচিং সেন্টারে সরকারি চাকরির পড়া ছাড়া আর কোনো বিষয়ে কোচিং করানো হতো না।
সিআইডি কর্মকর্তারা বলেছেন, এই দুই কোচিং সেন্টার থেকেই মূলত প্রার্থীদের বেছে নেওয়া হতো। তাদের মূল কৌশলই ছিল ধাপে ধাপে টাকা নেওয়া। একবারে টাকা দিতে না হওয়ায় প্রার্থীদের ওপর টাকা দেওয়ার চাপ যেমন কিছুটা কম ছিল, তেমনি পরীক্ষার একটি ধাপে টিকে গেলে তাদের আত্মবিশ্বাসও বেড়ে যেত। পরে সম্পদ-সম্বল বিক্রি করে হলেও তারা চাকরির জন্য টাকা দিতে কুণ্ঠা বোধ করতেন না।
এ চক্রের অন্যতম হোতা সরকারি কর্ম কমিশনের অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম। সিআইডির প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সাজেদুল জানান, বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্ন তিনি পিএসসির উপপরিচালক আবু জাফরের কাছ থেকে সংগ্রহ করতেন। তার সহযোগী সাখাওয়াত ও সাইম দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে চাকরিপ্রার্থী সংগ্রহ করতেন। পরে তাদের (চাকরিপ্রার্থী) ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় ভাড়া বাসা বা হোটেলে জড়ো করে পরীক্ষার আগে হুবহু প্রশ্নপত্র দিতেন।
প্রশ্নপত্র ফাঁস করার পর বিলি করতেন যিনি
বিসিএসের প্রশ্নপত্র ফাঁস কেলেঙ্কারির অন্যতম আলোচিত চরিত্র পিএসসির সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীও গ্রেফতার হয়েছেন পুলিশের হাতে। তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন সিআইডি কর্মকর্তারা।
আবেদ আলীকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে কর্মকর্তারা বলছেন, আবু সোলেমান মো. সোহেল বাংলাদেশ রেলওয়ের নিয়োগ পরীক্ষার জন্য প্রার্থী সরবরাহ করতেন। নিজেই বাসার একটি কক্ষেই বুথ পরিচালনা করতেন। এ ছাড়া নিয়োগ পরীক্ষা শুরুর আগে প্রশ্নপত্র প্রকাশ ও বিতরণের কাজে সহযোগিতা করতেন নিখিল চন্দ্র রায়। বিপিএসসির সাবেক এই সহকারী পরিচালক পলাতক রয়েছেন। তাকে ধরতে অভিযান অব্যাহত রেখেছে পুলিশ।
জিজ্ঞাসাবাদের তথ্য বলছে, উপপরিচালক আবু জাফর ও সহকারী পরিচালক আলমগীর কবিরের কোচিং ব্যবসার বিষয়ে পিএসসির সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীই অবগত। পিএসসিতে থাকার পরও এমন কোচিং সেন্টার তারা কীভাবে পরিচালনা করতেন, সে প্রসঙ্গে কখনো তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা হয়নি। এ বিষয়টিও তদন্তের আওতায় আসবে বলে জানিয়েছে সিআইডি।
অভিযুক্ত জাহাঙ্গীরও এই চক্রের একজন সক্রিয় সদস্য। তাকে শনাক্ত করে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় থেকে আটক করে পুলিশ। এই চক্রের আরও সক্রিয় সদস্য শাহাদাত হোসেন, মামুন ও নিয়ামুলকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম সক্রিয় সদস্য খলিল বাংলাদেশ রেলওয়ের নিয়োগ পরীক্ষাসহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র দীর্ঘদিন ধরে ফাঁস করে আসছেন।
খলিলকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তাকে এসব পরীক্ষার জন্য প্রার্থী সরবরাহ করতেন পিএসসির সহকারী পরিচালক আলমগীর। তিনিও (আলমগীর) বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র দীর্ঘদিন ধরে ফাঁস করে আসছেন।
জিজ্ঞাসাবাদে সাজেদুল জানান, তিনি তার সহযোগীদের মাধ্যমে চাকরিপ্রত্যাশীদের সংগ্রহ করার পাশাপাশি নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে চক্রের অন্যতম সদস্য পিএসসির সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীর কাছে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তর সরবরাহ করতেন।
এই চক্রটি শুধু চাকরির প্রশ্নপত্রই ফাঁস করত না, বিভিন্ন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্ন ফাঁসের চক্রের সদস্যও ছিলেন তারা। তাদের মেডিকেলের প্রশ্নপত্র ফাঁসের মামলারও আসামি করা হবে।
এদিকে প্রতিরক্ষা ও অর্থ বিভাগের অডিটর প্রিয়নাথ রায়ের জবানবন্দি থেকে জানা যায়, ডিজিএফআইয়ে কর্মরত অবস্থায় তার এক সহকর্মীর মাধ্যমে সাবেক সেনাসদস্য নোমান সিদ্দিকের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। পরে নোমান বিভিন্ন চাকরি ও মেডিকেল-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করার বিষয়ে তদবির করেন বলে জানান।
নোমানের কথা অনুযায়ী ২০১৫ সালে তার এক আত্মীয়কে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ভর্তি করান প্রিয়নাথ। পরীক্ষার আগের দিন রাতে নোমান তার মিরপুর-১০ সেনপাড়া পর্বতা এলাকার বাসায় বুথ খুলে পড়াতেন। তার মাধ্যমে পরে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরে আরও দুজনকে চাকরি পাইয়ে দেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় বিভিন্ন চাকরিতে লোক দিয়েছেন তিনি।
সিআইডির এক কর্মকর্তা বলেন, গত ৬ জুলাই সাইবার মনিটরিং করার সময় জানতে পারি, বিপিএসসির (সরকারি কর্ম কমিশন) অধীনে আয়োজিত বাংলাদেশ রেলওয়ের (নন-ক্যাডার) সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার পদে নিয়োগ পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে পরীক্ষার হুবহু প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। বেশকিছু পরীক্ষার্থীর কাছে টাকার বিনিময়ে সেই প্রশ্নের উত্তরপত্র বিতরণ করা হয়েছে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে ৭ জুলাই ঢাকার শ্যামলী থেকে অভিযুক্ত লিটন সরকারকে আটক করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, অভিযুক্ত লিটন গ্রেফতার প্রিয়নাথ ও জাহিদের কাছ থেকে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র নিয়েছেন। এর জন্য তাদের চুক্তির অর্থ পরিশোধও করেছেন।
লিটনের তথ্যের ভিত্তিতে মহাখালী থেকে প্রিয়নাথকে আটক করা হয়। প্রিয়নাথ আবার জানান, তিনি অভিযুক্ত জাহিদের কাছ থেকে প্রশ্নপত্র নিয়েছেন। পরে শ্যামলী থেকে জাহিদকে আটক করা হয়। জাহিদ জানান, রংপুরের সুমনের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র জোগাড় করতেন তিনি। জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া এসব তথ্যের ভিত্তিতেই প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সক্রিয় সদস্য হিসেবে সাবেক সেনা সদস্য নোমান সিদ্দীকীর নাম উঠে আসে। মিরপুর থেকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে তিনি এই চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন।
সিআইডি জানিয়েছে, এই চক্রের আরও ১৪ জনকে খোঁজা হচ্ছে। তাদেরও পল্টন থানার প্রশ্নপত্র ফাঁসের মামলায় আসামি করা হয়েছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
সারাবাংলা/ইউজে/একে