স্থবির ঢাকা, অনড় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা
১০ জুলাই ২০২৪ ১৯:০১
ঢাকা: রাজধানীর অন্তত ২০ পয়েন্টে কোটা বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা ‘বাংলা ব্লকেড’র অংশ হিসেবে অবরোধ করায় পুরো ঢাকা কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছিল। ফলে নগরবাসী যেদিক দিয়েই গন্তব্যে যেতে চেয়েছেন সেদিকেই বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। বুধবার (১০ জুলাই) সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্ট ঘুরে এসব চিত্র দেখা গেছে।
বেলা ১২টার দিকে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের শেরেবাংলা নগর পূর্ব গেটের সামনে সড়ক অবরোধ করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ সময় সেনাবাহিনীর এক ক্যাপ্টেন সিভিল ড্রেসে সেখান দিয়ে মোটরসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু অবরোধের কারণে তাকে থেকে যেতে হয়। এ সময় তিনি নিজের পরিচয় দিলেও শিক্ষার্থীরা কোনো কর্ণপাত না করে তাকে ফিরিয়ে দেন। এতে তাকে ভীষণ লজ্জায় পড়তে দেখা যায়। একই সময় পোশাকধারী দুই পুলিশ সদস্য মোটরসাইকেল নিয়ে যেতে চাইলে রাস্তায় বেঞ্চ ফেলে তাদের আটকে দেন শিক্ষার্থীর।
এই পয়েন্টে নেতৃত্ব দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী হাসান জামিল বলেন, ‘এই আন্দোলন আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। কাজেই সবাই আমাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করুন। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে।’
একই চিত্র দেখা যায় ফার্মগেট পয়েন্টেও। সেখান দিয়েও কোনো যানবাহন পার হতে দিচ্ছেন না আন্দোলনকারীরা। একজন মোটরসাইকেল আরোহী পেছনে অন্য একজনকে নিয়ে যেতে অনুরোধ করে বলেছিলেন, ‘হাসপাতালে রক্ত দিতে নিয়ে যাচ্ছি। একটু যেতে দিন।’ কিন্তু কোনো শিক্ষার্থী তাদের মোটরসাইকেলও পার হতে দেয়নি। একইভাবে অন্যান্য গাড়িও যেতে দেননি। ফলে বাধ্য হয়ে অনেকে হেঁটে পার হচ্ছিলেন। বিজয় সরণি থেকে কারওয়ান বাজার ও বাংলামোটর হয়ে শাহবাগ পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা অবরোধ করে বসেছিল। প্রত্যেক পয়েন্টে তারা বেরিকেড বসিয়েছে।
বেরিকেড বসিয়েছে এফডিসি সংলগ্ন গেটে। সেখানে এক্সপ্রেসওয়ে সড়ক দিয়ে যেসব গাড়ি আসছিল সেগুলোও থামিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। পাশাপাশি রেললাইনও আটকে রেখেছিল আন্দোলনকারীরা।
এদিকে, মগবাজার মোড় ফাঁকা থাকলেও সবাই এসে আটকে যাচ্ছে কাকরাইল মোড় ও প্রধান বিচারপতির বাস ভবনের সামনের সড়কে। মৎস্য ভবন মোড়েও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা বেরিকেড দিয়ে বসেছে। বেরিকেড বসিয়েছে পল্টন মোড় ও গুলিস্তান জিরো পয়েন্টেও।
কোটাবিরোধীদের অবস্থান ছিল শাহবাগ চৌরাস্তা ও চাঁনখারপুল এলাকায়। এ ছাড়া রাজধানীর নীলক্ষেত ও সায়েন্সল্যাব মোড় অবরোধ করে তারা তাদের দাবিরে পক্ষে অনড় অবস্থান নেয়। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দাবি, তারা রাজপথ ছেড়ে যাবে না। দাবি আদায় না হলে এর সমাধান তারা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই দেখতে চান।
কারওয়ান বাজারে ঢাকা বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু হানিফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক দলের আন্দোলন নয়। এই আন্দোলন সাধারণ শিক্ষার্থীদের অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন। ২০১৮ সালের পর শিক্ষার্থীরা কোনো আন্দোলন করেনি। তারা ক্লাস করেছে, পড়াশুনায় মন দিয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে ফের আমাদের রাস্তায় নামতে হলো কেন? আমরা এর যৌক্তিক সমাধান চাই। এটি সরকারের সদিচ্ছার অভাবে হয়েছে। আমরা কোটা চাই না। তবে সরকার রাখতে চাইলে সেটা যৌক্তিক হতে হবে। কোটা যেন ৫ ভাগের বেশি না হয়।’
এদিকে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো আটকে থাকায় বিপদে পড়ে হাসপাতাল, অফিস ও বিভিন্ন কাজে বেরিয়ে পড়া মানুষজন। যানবাহন না পেয়ে তাদের অনেককে হাঁটতে হয়েছে মাইলের পর মাইল। আবার রিকশায় উঠতে চাইলেও ভাড়া গুনতে হয়েছে বেশি। সেজন্য পথে পথে বিপাকে পড়তে হয় সাধারণ মানুষদের।
কারওয়ান বাজারে কথা হয় ফাতেমা নামে এক নারীর সঙ্গে। তিনি ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন তার মেয়ের কাছে যাবেন, এসেছেন মিরপুর থেকে। এরই মধ্যে কয়েকবার রিকশা পরিবর্তন করতে হয়েছে তাকে। তাতেও রাস্তা শেষ হচ্ছে না। তিনি সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘সরকার মেনে নিলেই হয়। তাহলে আন্দোলন থাকবে না, জনগণের ভোগান্তিও হবে না।’
আকিজ গ্রুপের বিপণন বিভাগে কর্মরত হাসিবুর রহমান সকালে বেরিয়েছেন কাজে। মৎস্যভবন মোড়ে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘সাইকেল নিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে হয়। কিন্তু শুধু ঘুরছি আর ঘুরছি। কোনো পয়েন্ট দিয়েই বের হতে পারিনি। এ রকম চলতে থাকলে তো গরিব মানুষ না খেয়ে মারা যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স ছেড়ে দিলেও সবাই তো অ্যাম্বুলেন্সে যাচ্ছেন না। যারা যান না তারা নিশ্চয়ই অন্য যানবাহনে চিকিৎসা নিতে যাবেন। কিন্তু তাদের তো ছাড়া হচ্ছে না। বাসও চলছে না।’
অন্যদিকে, সবচাপ যেন গিয়ে ঠেকেছিল মেট্টোরেলে। যদিও কারওয়ান বাজার, শাহবাগ আর আগারগাঁও স্টেশনের মূল ফটক বন্ধ করে দিয়েছিল আন্দোলনকারীরা। এরপরেও যেসব স্টেশন খোলা ছিল তাতে উপড়ে পড়া ভিড় দেখা গেছে। মেট্টোরেল চালুর পর এমন ভিড় কেউ কখনো দেখেছে কিনা সন্দেহ রয়েছে।
সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম