কোকেনের চালান নাইজেরিয়ান চক্রের, মাস্টারমাইন্ড ‘ডন ফ্রাংকি’
১৬ জুলাই ২০২৪ ২১:০৩
চট্টগ্রাম ব্যুরো : চট্টগ্রামে বাহামার নাগরিকের কাছ থেকে জব্দ হওয়া প্রায় চার কেজি কোকেনের চালানটি নাইজেরিয়ার একটি আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালান চক্রের বলে নিশ্চিত হয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। এর সূত্র ধরে তারা ঢাকায় নাইজেরিয়ার দুই নাগরিককে হেফাজতে নিয়েছে, যাদের সঙ্গে চট্টগ্রামে কোকেনসহ গ্রেফতার নারীর মোবাইলে যোগযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
গত জানুয়ারিতে ঢাকায় আট কেজি কোকেনসহ আটজনকে গ্রেফতার করেছিল অধিদফতর, যার মধ্যে নাইজেরিয়ার এক নাগরিকসহ ছয়জন বিদেশি। তদন্তে সেই কোকেনের চালান পাচারের নেপথ্যের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে ডন ফ্রাংকি নামে নাইজেরিয়ার এক নাগরিকের সম্পৃক্ততা পায়। চট্টগ্রামে আটক কোকেনের চালানের নেপথ্যের মাস্টারমাইন্ডও সেই ডন ফ্রাংকি বলে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে ধারণা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের।
সোমবার (১৫ জুলাই) সকালে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তিন কেজি নয়শ গ্রাম কোকেনের একটি চালানসহ আটক হন বাহামার নাগরিক স্টাসিয়া শান্টে রোলের নামে এক নারী। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), আর্মড পুলিশ ব্যাটেলিয়নের (এপিবিএন) নবম ইউনিট এবং বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা শাখার সদস্যদের যৌথ অভিযানে তাকে আটক করা হয়।
সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, স্টাসিয়া গত ৮ জুলাই ব্রাজিল থেকে এমিরেটসের একটি ফ্লাইটে (ইকে-২৬২) রওনা দিয়ে ১২ জুলাই দুবাই পৌঁছেন। ওইদিন ফ্লাই দুবাইয়ের একটি ফ্লাইটে (এফজেড-০৫৬৩) রওনা দিয়ে ১৩ জুলাই সকাল আটটায় চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছেন।
বিমানবন্দর থেকে স্টাসিয়া সরাসরি নগরীর হোটেল আগ্রাবাদে ওঠেন। সোমবার (১৫ জুলাই) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তিনি বিমানবন্দরে গিয়ে দুইদিন পর আসা লাগেজটি বুঝে নেন। এরপর লাগেজে তল্লাশি করে কোকেন সদৃশ বস্তু উদ্ধার করা হয়, যার ওজন তিন দশমিক নয়শ গ্রাম। লাগেজে একটি ইউপিএস’র ভেতরে সেগুলো রাখা হয়েছিল। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের রাসায়নিক পরীক্ষাগারের পরীক্ষক শফিকুল ইসলাম সরকার সেগুলো পরীক্ষা করে কোকেন বলে নিশ্চিত করেন। এরপর বেলা পৌনে একটার দিকে স্টাসিয়াকে গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতার স্টাসিয়ার বিরুদ্ধে অধিদফতরের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের পরিদর্শক দেওয়ান মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান বাদী হয়ে নগরীর পতেঙ্গা থানায় মামলা দায়ের করেছেন।
মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) সকালে চট্টগ্রামে এক সংবাদ সম্মেলনে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান জানিয়েছেন, গ্রেফতার স্টাসিয়াকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য এবং তার কাছে থাকা ডিজিটাল ডিভাইস পর্যালোচনা করে ঢাকায় অধিদফতরের একটি টিম অভিযান চালিয়ে নাইজেরিয়ার দুই নাগরিককে হেফাজতে নিয়ে কঠোর নজরদারিতে রেখেছে। এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য যাচাইবাছাই করে তাদের দ্রুত গ্রেফতার করা হবে।
‘গ্রেফতার নারীর সঙ্গে মোবাইলে বিভিন্নজনের তথ্য আদান-প্রদান হয়েছে। আমরা এসএমএসগুলো পেয়েছি। সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তবে যে দুজন নাইজেরিয়ার নাগরিককে আমরা কঠোর নজরদারিতে রেখেছি, তাদের সঙ্গে গ্রেফতার নারীর এসএমএস আদান-প্রদান হয়েছে। আমরা আশা করছি, তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আরও অনেক তথ্য বের হবে।’
গ্রেফতার বাহামার ওই নারীর বিষয়ে মহাপরিচালক জানান, ৫৪ বছর বয়সী স্টাসিয়া একজন কুমারী। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানিয়েছেন, বেশ কিছুদিন ধরে তিনি অসুস্থতায় ভুগছেন। নিজ দেশে চিকিৎসার অর্থ সংগ্রহের জন্য একজন ব্যক্তির কাছে গেলে তিনি তাকে বাংলাদেশে পাঠান। তার বিমানের টিকিট, হোটেলের বুকিং সবই অনলাইনে দেওয়া হয়েছে। তিনি আগে কখনও বাংলাদেশে আসেননি। লাগেজে ইউপিএসের ভেতরে কোকেন দেওয়া হয়েছে, সেটি তিনি জানতেন না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্টাসিয়াকে গ্রেফতার অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া অধিদফতরের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের পরিদর্শক দেওয়ান মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘নাইজেরিয়াভিত্তিক যে মাদক চোরাচালান চক্র, তারা কাট অফ পদ্ধতিতে কাজ করে। একজন মাস্টারমাইন্ড থাকে, তিনিই মূলত কাট অফ পদ্ধতিতে কাজ করেন। তিনি একেকজনকে একেক দায়িত্ব দেন। যার যতটুকু দায়িত্ব, সে শুধু ততটুকুই জানে। তার পরবর্তীতে কার দায়িত্ব বা এর আগের দায়িত্ব কে পালন করেছে, সেটা তারা জানতে পারে না, জানে শুধু মাস্টারমাইন্ড।’
‘এক্ষেত্রেও দেখা গেছে, গ্রেফতার হওয়া মহিলার সঙ্গে শুধুমাত্র দুজনের যোগযোগ ছিল, যাদের ঢাকায় নজরদারিতে রাখা হয়েছে। মহিলা আর কাউকে চেনে না। তার বিমানের টিকিট করেছে একজন, হোটেল বুকিং দিয়েছে আরেকজন। লাগেজ পাঠিয়েছে আরেকজন। রিসিভার অন্য কেউ। উনি কাউকেই চেনেন না, এটি হতে পারে।’
গত ২৪ জানুয়ারি ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আট কেজি তিনশ গ্রাম কোকনসহ আটজনকে গ্রেফতার করেছিল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। এদের মধ্যে নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন, মালউয়ি ও তানজানিয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের দুজন নাগরিক ছিল। দেশে আসা এপর্যন্ত সবচেয়ে বড় কোকেনের চালানটি আটকের পর অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, চালানটি পাচারের নেপথ্যের মাস্টারমাইন্ড নাইজেরিয়ার নাগরিক ডন ফ্রাংকি।
সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ডস ফ্রাংকি ৯ বছর ধরে বাংলাদেশে অবস্থানের পর গত বছরের মার্চে নাইজেরিয়া ফেরত যান। তিনি বাংলাদেশে বসবাসরত নাইজেরিয়ান কমিউনিটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ঢাকার বারিধারায় একটি ভাড়া বাসায় অবস্থান করে ডন ফ্রাংকি পোশাকের ব্যবসা করতেন। মূলত এ ব্যবসার আড়ালে তিনি বাংলাদেশকে ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করে কোকেন চোরাচালানে জড়িত ছিলেন।
পরিদর্শক দেওয়ান মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডন ফ্রাংকির বিষয়টি আমরা ঢাকায় আটক কোকেনের চালান তদন্তে পেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি নাইজেরিয়া থেকে আর বাংলাদেশে ফেরত আসেননি। এজন্য তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। তিনি নাইজেরিয়ার পাসপোর্ট ব্যবহার করতেন। আবার তার কাছে ক্যারিবিয়ান রাষ্ট্র সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসের একটি পাসপোর্টও ছিল বলে আমাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য আছে।’
‘ক্যারিবিয়ান রাষ্ট্র বাহামার নাগনিককে কোকেনের চালানসহ আটকের পর তার ডিজিটাল ডিভাইসে থাকা সব তথ্য আমরা পর্যালোচনা করেছি। আমরা নিশ্চিত হয়েছি, নাইজেরিয়ান মাদক চোরাচালান চক্রের কোকেনের চালান তিনি ক্যারিয়ার হিসেবে বহন করছিলেন। মাস্টারমাইন্ড ডন ফ্রাংকির নেতৃত্বাধীন যে চক্র, তারাই চালানটি বাংলাদেশকে ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করে পাচারের চেষ্টা করেছিল আমরা মোটামুটি ধারণা করতে পারছি। আগেও একটি চালান যেহেতু ঢাকা বিমানবন্দরে ধরা পড়ে গেছে, এবার তারা রুট পরিবর্তন করেছিল,’ – বলেন জিল্লুর রহমান।
চট্টগ্রাম জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের উপপরিচালক হুমায়ুন কবির খন্দকার সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের তদন্ত এবং রিচার্সে পাওয়া তথ্য হচ্ছে, বাংলাদেশে কোকেনের ব্যবহার নেই বললেই চলে। এখানে কোকেনসেবীও নেই। দুজন পাওয়া গিয়েছিল, যারা উত্তর আমেরিকা থেকে এডিক্টেড হয়ে এসেছিলেন। কোকেন মূলত ব্যবহার হয় আমেরিকা-ইউরোপের মতো ফার্স্ট ওয়ার্ল্ডের কান্ট্রিগুলোতে। এটার বাজারদর এত হাই, বাংলাদেশে ব্যবহারের সম্ভাবনা এখনও নেই। সেজন্য আমরা বলছি যে, বাংলাদেশকে ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করে নাইজেরিয়ান একটি চক্র কোকেনগুলো অন্য কোনো দেশে পাচারের জন্য পাঠিয়েছিল।’
বাংলাদেশকেই কেন ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, এ প্রশ্নের জবাবে পরিদর্শক দেওয়ান মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশে যেহেতু কোকেনের ব্যবহার নেই, সুতরাং এটার বিষয়ে নজরদারিও কম থাকবে স্বাভাবিক। সে কারণে বাংলাদেশকে ব্যবহার করে পাচারের কৌশল নিয়েছে আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালান চক্র।’
২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গত ১০ বছরে দেশে প্রায় ৪১ কেজি কোকেন ধরা পড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৩ কেজি কোকেন ধরা পড়েছে ২০২৩ সালে।
কোকেন জব্দের পর পাওয়া তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণ করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর বলছে, বাংলাদেশকে এক দশকের বেশি সময় ধরে কোকেন পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার করছে আন্তর্জাতিক মাদক পাচারকারী চক্র। বাংলাদেশ হয়ে ভারত, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন দেশে কোকেন পাচার হচ্ছে।
সারাবাংলা/আরডি/একে