Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মহাখালী যেন আগুনে পোড়া ধ্বংসস্তূপ

এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
২৪ জুলাই ২০২৪ ২২:৪৬

ঢাকা: সেতু ভবন, বিআরটিএ কার্যালয় ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরে ভাঙচুর ও আগুন! তিন ভবনের শতাধিক গাড়িতে অগ্নিসংযোগ! লুট!— সবই হয়েছে রাজধানীর মহাখালীতে। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র চলেছে এই ধ্বংসযজ্ঞ। আগুনে পুড়ে গেছে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ নথি। সেতু ভবনের পাশে থাকা সোনালী ব্যাংকের এটিএম বুথেও ভাঙচুর চালানো হয়েছে। খাজা টাওয়ারে আগুন দেওয়ায় বন্ধ হয়ে যায় দেশব্যাপী ইন্টারনেট সেবা।

বিজ্ঞাপন

সেইসঙ্গে পুড়িয়ে দেওয়া হয় মহাখালীর সবক’টি পুলিশবক্স। রেললাইনের উপর পড়ে ছিল আগুনে পোড়া পুলিশের গাড়ি, মূল রাস্তায় ভস্মীভূত একটি জিপ। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মহাখালী টোলপ্লাজাটিও দুর্বৃত্তদের অগ্নিসন্ত্রাসের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। গেল বৃহস্পতি ও শুক্রবার (১৮ ও ১৯ জুলাই) নজিরবিহীন এমন ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়।

পোড়ানো হয়েছে তিন ভবনের শতাধিক গাড়ি

রোববার (২১ জুলাই) বিকেলে সেতু ভবনের উল্টোপাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখা যায়, ১০ তলা ভবনের তিন থেকে চার তলা পর্যন্ত কাচ ভেঙে গেছে। আন্দোলকারীদের ছোড়া ঢিল ও আগুনে বিধ্বস্ত পুরো ভবন। ভবনের ঠিক সামনের রাস্তায় আগুনে পোড়া দুটি গাড়ি পড়ে আছে। সেতু ভবনের ভেতরে থাকা ৫৫টি গাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভবন দেখেই আঁচ করা যায়, এতে প্রচুর ঢিল ছোড়া হয়েছিল। ভাঙা কাচ ও আগুনে পোড়া ভবনের ভেতর প্রবেশ অনেকটাই দুরূহ।

একইদিন বিকেলে ভবনের ক্ষয়ক্ষতি নিরুপনে কাজ করছিলেন সেতু বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) রশিদুল হাসান। তার সঙ্গে কথা হলে সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে ৫৫টি গাড়ি পুড়ে গেছে। গ্রাউন্ড ফ্লোর, ফার্স্ট ফ্লোর ও সেকেন্ড ফ্লোর সিরিয়াস ড্যামেজ হয়েছে। লিফট, সাব স্টেশন- এগুলো সম্ভবত বিকল হয়ে গেছে। এগুলো আরও বিস্তর চেকিংয়ের বিষয় রয়েছে। সেন্ট্রাল এসি সিস্টেমের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। নিচে বঙ্গবন্ধু কর্নার যেটি ছিল, সেটিও ধ্বংস হয়ে গেছে। অডিটোরিয়ামও এখন ধ্বংসস্তূপ। আমরা এখনো এসেসমেন্ট লেভেলে আছি। ১০ তলা ভবনের প্রতিটি ফ্লোরই কিছু না কিছু ক্ষতি হয়েছে।’ তবে প্রাথমিকভাবে তিনি ক্ষয়ক্ষতির কোন পরিমাণ জানাতে পারেননি।

বিজ্ঞাপন

ভাঙচুর চালানো হয় সোনালী ব্যাংকের বুথে

সেতু ভবনের সামনে সোনালী ব্যাংকের একটি এটিএম বুথ ছিল। বুথের শাটার ভেঙে ফেলা হয়েছে। ভেতরে থাকা এটিএম মেশিন ও অন্যান্য জিনিসের কিছুই নেই। ভেতরে প্রবেশ করে দেখা গেছে, ভাঙা কাচ ও ছেঁড়া তার ঝুলছে। জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আফজাল করিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সেতু ভবনের পাশে থাকা আমাদের এটিএম বুথে ভাঙচুর চালানো হয়েছে। তবে ক্যাশ লুট হয়নি। ট্রেলার মেশিনের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু সেটি পুরো ভাঙতে পারেনি। সেদিন রাতের বেলা আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর উপস্থিতিতে আমাদের লোকজন ট্রেলার মেশিন উদ্ধার করে নিয়ে আসে। সেখানে আমাদের ট্রেলার মেশিন ও স্থাপনা মিলিয়ে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।’

পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বিআরটিএ ভবন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর

সেতু ভবনের পাশেই সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কার্যালয়। সেখানে ভবনের নিচে রাখা গাড়িগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভবনটির নিচতলা থেকে পাঁচ তলা পর্যন্ত আগুনে পুড়ে গেছে। ইলেকট্রিক ও এসি সিস্টেম থেকে শুরু করে দাফতরিক বহু জিনিস পুড়ে ছাই। গুরুত্বপূর্ণবহু নথির অস্তিত্বই নেই।

১৮ জুলাই আগুন দেওয়া হয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরেও। আগুনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের ৫৬টি গাড়ি, ২০টি মোটরসাইকেল, ১০০ কেভির ২টি জেনারেটর ও ১ হাজার কেভির সাবস্টেশন পুড়ে গেছে। এ ছাড়া ইআরসিসি ডাটা সেন্টার, সার্ভার রুম ও ওয়ার্ক স্টেশনের ৬০টি কম্পিউটার পুড়ে গেছে। ভবনের ভেতর ও বাইরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যার পরিমাণ কমপক্ষে ৪০০ কোটি টাকা।

বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর মহাখালীতে দফায় দফায় ধাওয়া-পালটাধাওয়ার ঘটনা ঘটছে। মহাখালী রেলগেট ও ডিওএইচ গেইটের সামনে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অবস্থান নেয়। রেলগেইটের অদূরে রেললাইন, আবাসিক এলাকার সবগুলো অলিগলিতে অবস্থান নেয় আন্দোলনকারীরা। বিভিন্ন বাসা থেকে আন্দোলনকারীদের সহায়তা করা হয়। পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল ছুড়ছে। দুপুর ১২টা থেকে দফায় দফায় সংঘর্ষ চলে।

খাজা টাওয়ারে আগুন দিলে বন্ধ হয়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা

একইদিন মহাখালীতে অবস্থিত খাজা টাওয়ারে আগুন দেওয়া হলে ডাটা সেন্টার অকার্যকর হয়ে পড়ে। ফলে দেশজুড়ে বন্ধ হয়ে যায় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা। তারও আগে বুধবার (১৭ জুলাই) সারাদেশে মোবাইল ইন্টারনেট সংযোগ স্লো করে দেওয়া হয়। মূলত গুজব প্রতিরোধে ইন্টারনেট সংযোগ স্লো করা হয় বলে জানিয়েছিলেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।

পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে টোলপ্লাজা, পুলিশের গাড়ি ও পুলিশ বক্স

১৯ জুলাই বিকেলে আগুন দেওয়া হয় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মহাখালী টোলপ্লাজায়। আগুনের ধোঁয়া দেখা যাচ্ছিল মহাখালীর আয়েশা মেমেরোয়িাল হাসপাতালের পাশ্ববর্তী ট্রাস্টের মাঠ থেকেও। ২১ জুলাই বিকেলে টোল প্লাজায় গিয়ে দেখা যায়, অগ্নিতাণ্ডবের চিত্র।

মহাখালী রেলগেইটের রেললাইনের উপর পুলিশের একটি গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয় ১৯ জুলাই জুমার নামাজের পর। একইদিন মহাখালীর মূল রাস্তায় সরকারি একটি ঝিপে আগুন দেওয়া হয়। এ ছাড়া, রাওয়া গেইটের সামনের পুলিশবক্স পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এমনকি পুড়িয়ে দেওয়া সেই বক্স রাস্তার উপর ফেলে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে লোহাজাতীয় জিনিষ আলগা করে নিয়ে যাচ্ছিল কেউ কেউ। রাস্তার ভিভাইডারগুলোরও বেহাল দশা। সেগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে। মহাখালী রেলগেইটের পুলিশবক্সটিও এখন ধ্বংসস্তূপ। আগুনের চিহ্ন লেগে আছে আমতলীর পুলিশবক্সেও।

১৯ জুলাই বিকেল ৫টার দিকে মহাখালী এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোলপ্লাজায় আগুন দেওয়া হয়। আয়েশা মেমোরিয়াল হাসপাতালের পাশে দাঁড়িয়ে দেখা গেছে, আগুনের লেলিহান শিখা। সারাবাংলার এই প্রতিবেদক সেই ছবিটি ধারণ করেন। শাহীনবাগ ও আশেপাশের এলাকার মানুষজন নিজ নিজ বাসা থেকে আগুনের সেই লেলিহান শিখা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলছিলেন। শুক্রবার বিকেলে মহাখালীর আকাশে হেলিকপ্টার থেকে টিয়ারশেল ও আগুন নেভাতে পানি ছুড়তে দেখা গেছে।

কারফিউ

বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার দু’দিনই আন্দোলনকারীরা মহাখালী রেলগেইটে থেকে নাখালপাড়া রেলগেইট ও পাগলার পুল এলাকায় অবস্থান করে। ধাওয়া-পালটাধাওয়ার সময় আশেপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে তারা। ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হয় পুলিশের। শনিবার কারফিউ জারির মধ্যেও রেইলাইনের ওপর সাধারণ মানুষকে অবস্থান করতে দেখা গেছে। শনিবার মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা দিয়ে সাধারণ মানুষকে রেললাইন ছেড়ে বাসায় অবস্থান করার অনুরোধ জানানো হয়।

সারাবাংলা/ইএইচটি/পিটিএম

আগুন আন্দোলন কোটা ধ্বংসস্তূপ মহাখালী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর