জাতিকে নিয়ে মশকরা কইরেন না— ডিবির উদ্দেশে হাইকোর্ট
২৯ জুলাই ২০২৪ ১৬:৩৫
ঢাকা: কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) হেফাজতে নিয়ে রাখা ও সেখানকার ছবি প্রচারের ঘটনায় উষ্মা প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেন, ‘জাতিকে নিয়ে মশকরা করবেন না। যাকে খুশি ধরে নিয়ে গিয়ে খাবার টেবিলে বসিয়ে দেন, ছবি তুলে আবার সেটি প্রচার করেন!’
সোমবার (২৯ জুলাই) এক রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও রাষ্ট্রপক্ষের উদ্দেশে এ মন্তব্য করেন হাইকোর্ট। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘কথিত আটক’ ছয় সমন্বয়ককে অবিলম্বে মুক্তি দিতে ও দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি না চালাতে নির্দেশনা চেয়ে রিটটি করা হয়েছিল।
এর আগে রোববার (২৮ জুলাই) রাতে ডিবিপ্রধানের সঙ্গে ওই ছয় সমন্বয়কের একসঙ্গে টেবিলে খাওয়ার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এর কিছুক্ষণ পরই ডিবি কার্যালয় থেকেই এক ভিডিওবার্তায় ছয় সমন্বয়ককে আন্দোলনের কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতে দেখা যায়। অন্য সমন্বয়করা অবশ্য বলছেন, জোর করে তাদের দিয়ে এ কর্মসূচি ঘোষণা করানো হয়েছিল। তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
সোমবার বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসাইন দোলনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে ওই রিটের ওপর শুনানি হয়। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, ব্যারিস্টার অনীক আর হক, ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এস এম মুনীর, শেখ মোহাম্মদ মোর্শেদ ও ব্যারিস্টার মেহেদী হাসান চৌধুরী।
শুনানিতে আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নাম দিয়ে এখন যে কার্যকলাপ হচ্ছে তা মেনে নেওয়া যায় না। একাত্তর সালে দেখেছি, পাকিস্তানি হানাদাররা রাতের বেলা ব্লক রেইড দিয়ে বাসায় বাসায় খুঁজত মুক্তিবাহিনী আছে কি না। যে দেশটা আমরা ৩০ লাখ শহিদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন করেছি, সেই দেশে ২০২৪ সালে রাত ২টা-৩টায় ব্লক রেইড দিয়ে বাসায় ছাত্র আছে কি না খোঁজা হয়। যদি ছাত্র থাকে তাহলে তাদের মোবাইল ফোন চেক করা হয়। রাস্তাঘাটেও ফোন চেক করা হয়। আমার প্রশ্ন এটা হচ্ছে— সেটা করা হচ্ছে কোন আইনের বলে? কোন অধিকারের বলে? আইন অনুযায়ী ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন চেক করার অধিকার কারও নেই।
শুনানিতে ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, আমরা এসেছি আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের ওপর গুলি না করার আবেদন নিয়ে। ছয়জনকে তুলে নেওয়া হয়েছে। কাউকে নিরাপত্তার স্বার্থে তুলে নেওয়া যায় না। তাদের যেন মুক্তি দেওয়া হয় বা আদালতে হাজির (কোর্টে প্রডিউস) করা হয়। একজনকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিরাপত্তার নামে তুলে নিয়ে রাখা যাবে, এটা কোথায় আছে? সংবিধানের ৬১ অনুচ্ছেদে অনুযায়ী এভাবে হেফাজতে রাখা বেআইনি। উচ্চ আদালতের অনেক নির্দেশনা আছে। এই আদালতও নির্দেশ দিতে পারেন। তারা বলছেন, যে ছয়জন তাদের হেয়াজতে আছে। এখন প্রশ্ন হলো— তাদের সম্মতি নিয়ে হেফাজতে রাখা হয়েছে কি না। এ বিষয়ে যেকোনো ব্যক্তি আবেদন করতে পারেন। আমরা আমাদের বিবেকের তাগিদে এসেছি।
এ সময় অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ মেহেদী হাছান চৌধুরী বলেন, উনারা কি নিশ্চিত করে বলতে পারবেন যে বিটিভি ভবন, মেট্রোরেলে, সেতু ভবনে আর হামলা হবে না? ছাত্র নিহতের ঘটনায় তদন্ত কমিশন হয়েছে। কেউ বেআইনি কাজ করলে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।
মেহেদী হাছান আরও বলেন, দেশে যদি মব (বিশৃঙ্খলা) হয়, সেখানে কি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আইন প্রয়োগ করতে পারবে না? যারা মারা গেছে তাদের মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। পুলিশ যদি বেআইনিভাবে গুলি করে থাকে, তদন্তসাপেক্ষে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, প্রতিটি ঘটনার তদন্ত হবে।
‘এই রিট আবেদনের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। আমরা দেখতে পেয়েছি যে ডিবি অফিসে ছয়জন কাটা চামচ দিয়ে খাচ্ছে,’— যোগ করেন রাষ্ট্রপক্ষের এই আইনজীবী।
এ পর্যায়ে আদালত বলেন, ‘জাতিকে নিয়ে মশকরা করবেন না। যাকে খুশি ধরে নিয়ে গিয়ে খাবার টেবিলে বসিয়ে দেন, ছবি তুলে আবার সেটি প্রচার করেন!’ রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর উদ্দেশে আদালত আরও বলেন, ‘জাতিকে নিয়ে মশকরা করবেন না।’
অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোর্শেদ বলেন, দুই দিক থেকে ইনজুরি হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও আক্রান্ত।
এ সময় আদালত বলেন, ‘আটকের কথা বলে কি দিনের পর দিন রেখে দেবেন?’ জবাবে শেখ মো. মোর্শেদ বলেন, ‘যে ছয়জনের কথা এসেছে, তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ আদালতে আসেননি।’ তখন আদালত বলেন, ‘আজকের প্রথম আলো দেখেন। তাদের হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।’
মেহেদী হাছান চৌধুরী আরও বলেন, ‘প্রতিটি ঘটনারই বিচার হবে। সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা হবে বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন।’
এরপর আদালত এ বিষয়ে উভয় পক্ষের আরও শুনানি শেষে আদেশের জন্য আগামীকাল মঙ্গলবার দিন নির্ধারণ করেন।
এর আগে গত শুক্রবার নিরাপত্তার কথা বলে আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদারকে হাসপাতাল থেকে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়। পরে শনিবার সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহ ও নুসরাত তাবাসসুমকেও হেফাজতে নেয় ডিবি।
এরপর সোমবার সকালে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি না চালানো এবং ডিবি হেফাজত থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়কের মুক্তির দিতে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মানজুর আল মতিন প্রীতম ও আইনুন্নাহার সিদ্দিকা লিপি।
রিটে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ছাড়াও স্বরাষ্ট্র সচিব, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান এবং সেনাবাহিনী, নৌ বাহিনী ও বিমান বাহিনীর প্রধানকে বিবাদী করা হয়েছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে গত ১৫ জুলাই আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষ শুরু হয়। টানা এক সপ্তাহের সহিংসতায় ১৫০ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সহিংসতার মধ্যে মেট্রোরেল, সেতু ভবন, দুর্যোগ ভবন, বিআরটিএ ভবন, বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবনসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে রোববার রাতে সরকারের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীদের মৃত্যুর প্রতিটি ঘটনা, হত্যা, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, নাশকতা ও নাশকতাপরবর্তী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ীদের যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে জবাবদিহি করতে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
এসব ঘটনা তদন্তে গত ১৮ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে। কমিশন এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে। এ ছাড়া হত্যাকাণ্ড ও সহিংসতার ঘটনায় বেশ কয়েকটি বিভাগীয় তদন্তও পরিচালিত হচ্ছে।
সারাবাংলা/কেআইএফ/ইআ/টিআর
আন্দোলনের সমন্বয়ক ছাত্র আন্দোলন টপ নিউজ ডিবি কার্যালয় হাইকোর্ট