এর আগেও ৪ বার নিষিদ্ধ হয়েছিল জামায়াত
৩১ জুলাই ২০২৪ ১০:০৬
ঢাকা: রাত পোহালেই বাঙালি জাতি আরেকটি ইতিহাস গড়তে যাচ্ছে! সব কিছু ঠিক থাকলে সরকারের নির্বাহী আদেশে বুধবার (৩১ জুলাই) নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
এরইমধ্যে গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়ে দিয়েছেন, বুধবারের মধ্যেই নিষিদ্ধ হচ্ছে একাত্তরের ঘাতকদের সংগঠন জামায়াত। এর আগে, সোমবার রাতে গণভবনে অনুষ্ঠিত ১৪ দলের বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয় জামায়াত নিষিদ্ধের।
কোটাবিরোধী আন্দোলনে অনুপ্রবেশ করে ব্যাপক সহিংসতা ও জান-মালের প্রভুত ক্ষতিসাধনের অভিযোগ তুলে নির্বাহী আদেশে জামায়ত নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছে সরকার। তবে জামায়াতের ওপর নিষিদ্ধের খড়ক এবারই প্রথম নয়। এর আগে, অসংখ্যবার নিষিদ্ধ করা হয়েছে উপ-মহাদেশের বিতর্কিত রাজনৈতিক এই দলটিকে।
অবশ্য ২০১৩ সালের আগস্ট মাস থেকে রাজনৈতিক দল হিসেবে দলটির নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে রেখেছেন বাংলাদেশের হাইকোর্ট। বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে এ রায় দিয়েছিলেন।
রায়ের ফলে জামায়াত দলগতভাবে ও দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করার অধিকার হারায়।
সেই সময় আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘এই রায়ের ফলে জামায়াতকে এদেশে নিষিদ্ধের বিষয়টি সহজ হলো। আশা করি জামায়াতের রাজনীতি খুব শিগগিরই নিষিদ্ধ হবে। তার পর কেটে গেছে ১১ বছর। অবশেষে মঙ্গলবার বিকেলে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক জানালেন, বুধবারই নিষিদ্ধ হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী।’
একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষকে নির্বিচার হত্যা করে জামায়াতের নেতা-কর্মীরা। মানুষের সহায় সম্পদ ধ্বংস করা ছাড়াও সর্বাত্মকভাবে স্বাধীনতার বিপক্ষে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয় তারা। দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর শোচনীয় পরাজয়ে তাদের সহযোগী শক্তি হিসেবে জামায়াত ও স্বাধীনতা বিরোধী পরাজিত শক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সৈয়দ আবুল আলা মওদুদী হাতে গড়া একটি বিতর্কিত রাজনৈতিক সংগঠন। প্রতিষ্ঠাকালে এর নাম ছিল জামায়াতে ইসলামী হিন্দ। ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উসকানির অভিযোগে ১৯৫৯ সালে প্রতমবারের মতো পাকিস্তানে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান প্রণীত মুসলিম পরিবার আইনের বিরোধিতার কারণে ১৯৬৪ সালের ৪ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর কর্মকাণ্ড আবারো নিষিদ্ধ হয়। দলের প্রধান মওদুদীসহ গ্রেফতার করা হয় ৬০ জামায়াত নেতাকে। এদের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের যে ১৩ জন জামায়াত নেতা ছিলেন তাদের অন্যতম গোলাম আযম।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তীব্র বিরোধিতা করে জামায়াতে ইসলামী। জামায়াত পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সাহায্য করতে রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি বাহিনী গড়ে তোলে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে দলটির সদস্যরা হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, সংখ্যালঘু নির্যাতন, হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে জোরপূর্বক ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা, ১৪ ডিসেম্বর ডিসেম্বর বুধিজীবী হত্যকাণ্ডে জড়িত থাকাসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যাপকভাবে অংশ নেয়।
দেশ স্বাধীন হলে দলটির প্রধান গোলাম আযম পাকিস্তানে আশ্রয় নেন। অন্যদের কেউ কেউ দেশ ছেড়ে পালান ও বাকিদের দালাল আইনে গ্রেফতার হয়।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে। এই বছরেই অধ্যাদেশের মাধ্যমে দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে এই বিবেচনায় জামায়াতও রাজনীতির অধিকার হারায়। ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নৃসংশভাবে নিহত হলে জিয়াউর রহমান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও পরে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন।
১৯৭৬ সালের আগস্টে জেনারেল জিয়াউর রহমানের সরকার রাজনীতি উন্মুক্ত করে রাজনৈতিক দল অধ্যাদেশ ঘোষণা করেন। এ সময় ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক পার্টি নামের একটি দলের ছত্রছায়ায় জামায়াতে ইসলামী প্রকাশ্যে কর্মকাণ্ড পরিচালনা শুরু করে। জিয়ার সরকার এসময় গোলাম আযমকে পাকিস্তান থেকে দেশে ফেরার অনুমতি দেন। ১৯৭৯ সালের মে মাসে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ দেশে পুনরায় আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করে।
একাত্তরে অপরাধমুলক কর্মকাণ্ডের দায়ে জামায়াতে ইসলামী এরইমধ্যে আদালতে অভিযুক্ত হয়েছে। বিভিন্ন মাত্রায় দণ্ডিত হয়েছেন দলটির বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা। দলটির অতীত কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা এখনও বজায় রেখে চলেছে বর্তমান নেতৃত্ব। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধ থেকে শুরু করে এখনও সুযোগ পেলেই কারণে অকারণে নৃসংশ ও সহিংস হয়ে ওঠে দলটির নেতা-কর্মীরা ।
জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবির গত কয়েক দশকে শিক্ষাঙ্গণে ব্যাপক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। নৃসংশতার চরম পর্যায় সৃষ্টি করে জনমানসে গভীর ভীতির সঞ্চার করে তারা। পায়ের রগ কাটা থেকে শুরু করে কুপিয়ে হত্যার বীভৎস নজির শিবিরই স্থাপন করেছে এ দেশে।
দলটির নেতাকর্মীরা এখনও সুযোগ পেলেই হয়ে উঠছে হিংস্র। ফলে জামায়াতকে নিষিদ্ধের দাবি দীর্ঘদিন ধরেই উচ্চকীত হচ্ছিল। সব মহল থেকেই দাবি উঠছিল জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার। তাদের মতে, জামায়াতের মতো দলের এ দেশে রাজনীতি করার সুযোগ থাকা উচিত নয়।
সারাবাংলা/এজেড/এমও