আলোর মুখ দেখেনি দুই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন
২ আগস্ট ২০২৪ ১১:০৬
রংপুর: সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবির আন্দোলনে রংপুরে পুলিশের গুলিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ নিহতের ঘটনা তদন্তে করা পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পৃথক দুটি কমিটির প্রতিবেদন এখনও আলোর মুখ দেখেনি। এছাড়া ঘটনার ১৬ দিন পেরিয়ে গেলেও ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন জমা না হওয়া, আবু সাঈদকে পুলিশ গুলি করলেও পুলিশের করা মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে ভিন্ন কথা উপস্থাপন করা, গ্রেফতার আতঙ্ক যেন সবমিলিয়ে বাড়িয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা; আর ক্ষোভ তৈরি হয়েছে বিভিন্ন মহলে। এদিকে আন্দোলনকারীরা যেন কোনোভাবেই কর্মসূচি করতে না পারে এজন্য কঠোর অবস্থান নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
গত ১৬ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। তিনি কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন। আবু সাঈদ রংপুরের পীরগঞ্জের জাফরপাড়া বাবনপুর গ্রামের হতদরিদ্র বাবা মকবুল হোসেনের ছেলে। ১৬ জুলাই দুপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সংলগ্ন ঢাকা- কুড়িগ্রাম মহাসড়কের পাশেই ১ নম্বর ফটকের সামনে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষ ঘটে। পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া কয়েকটি ভিডিওতে দেখা যায়, পুলিশের তাক করা অস্ত্রের বিপরীতে বুক পেতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন আবু সাঈদ। এ সময় পুলিশ সদস্যরা গুলি ছুড়তে থাকেন। হাতে থাকা লাঠি দিয়ে গুলি ঠেকানোর চেষ্টা করেন সাঈদ। এক পর্যায়ে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পরে হাসপাতালে নেওয়া হলে সাঈদের মৃত্যু হয়। তার শরীরে রাবার বুলেটের একাধিক ক্ষতচিহ্ন পাওয়া গেছে বলে জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
সাঈদের মরদেহের ময়নাতদন্ত করেন রংপুর মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক রাজিবুল ইসলাম। তিনি বলেন, আবু সাঈদের বুক ও পেট ছররা গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল। অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়। তিনি জানান, কয়েক দিনের মধ্যে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে।
আবু সাঈদ নিহতের ঘটনা তদন্তে তার নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছিল। দ্রুততম সময়ের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হলেও প্রতিবেদন দিতে ব্যর্থ হয়েছে কমিটির প্রধান অধ্যাপক ড. মতিউর রহমান।
তিনি বলেন, ‘সুষ্ঠু তদন্তের জন্য সাঈদের সহপাঠী, সঙ্গে থাকা আন্দোলনকারী, প্রত্যক্ষদর্শীসহ অনেকের সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন। কিন্তু ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় তা সম্ভব হচ্ছে না। তাই প্রতিবেদন জমা দিতে আরও সময় লাগবে।’
গত ১৮ জুলাই রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রধান রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার সায়েফুজ্জামান ফারুকী। তদন্ত কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়।
এ বিষয়ে কমিটির প্রধান সায়েকুজ্জামান ফারুকী বলেন, ‘বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় নিখুঁতভাবে তদন্ত করতে সময় লাগছে। গত সোমবার সাত কর্মদিবস শেষ হয়েছে। তবে তদন্ত শেষ না হওয়ায় আরো সাত কর্মদিবস সময় বাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে।’
আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনায় মেট্রোপলিটন তাজহাট থানায় প্রথম মামলা করেন বিশ্ববিদ্যালয় পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই বিভূতিভূষণ রায়। ঘটনার পরদিন পেনাল কোডের (১৪৩/১৮/৬/৩৩২/ ৩৩৩/৩৫৩/৩৭৯/৪৩৫/ ৪২৭/৩০২/৩৪) ধারায় মামলাটি করা হয়। তবে এজাহারে গুলিতে সাঈদ মারা গেছেন—এমন কোনো তথ্য নেই। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, ইটপাটকেলের আঘাতে মৃত্যু হয়েছে। আসামি হিসেবে কারও নাম নেই। অজ্ঞাত দুই-তিন হাজার আন্দোলনকারীকে আসামি করা হয়। এ নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা। ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘বেলা ২টা ১৫ মিনিটের দিকে ছাত্র নামধারী সুবিধাভোগী রাষ্ট্রবিরোধী আন্দোলনরত দুর্বৃত্তগণ বিভিন্ন দিক থেকে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল ও তাদের নিকটে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র হতে এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্যে তাদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশও এপিসি গাড়ির মধ্য হতে কং/ ১১৮৬ সোহেল তার নামীয় সরকারি ইস্যুকৃত শটগান হইতে ১৬৯ রাউন্ড রাবার বুলেট ফায়ার করে। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
সাঈদের মৃত্যুর বিষয়ে বলা হয়, বিভিন্ন দিক থেকে আন্দোলনকারীদের ছোড়া গোলাগুলি ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের এক পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থীকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। সহপাঠীরা ধরাধরি করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামা ২/৩ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।”
তবে এই এজাহার নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলছেন, নিজেদের দোষ ঢাকতে বিক্ষোভকারীদের ওপর দোষ চাপাতে চাইছে পুলিশ। আবু সাঈদকে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করলেও এজাহারে ইটপাটকেলের আঘাতের কথা উল্লেখ করেছে। প্রকাশ্যে বুকে গুলির যে ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সারা বিশ্ব দেখলো, সেটি কী তাহলে মিথ্যা। তার পুরো শরীর ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। এ ছাড়া আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল না, ভিডিও দেখলে তার প্রমাণ মিলবে। এতে গুলি বর্ষণকারী পুলিশ সদস্য এবং গুলি করার নির্দেশদাতার নাম উল্লেখ করা হয়নি। এটি সাজানো এজাহার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, আবু সাঈদের হাত, বুক, পিঠ, মুখসহ শরীরের শতাধিক স্থানে বুলেটের আঘাতের চিহ্ন ছিল। ময়নাতদন্ত কিংবা তদন্ত প্রতিবেদন পেতে যে কারণেই দেরি হোক, আমরা চাই প্রকৃত সত্যতা উঠে আসুক।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থীরা বলেন, আবু সাঈদ আহত হয়ে পড়ে গেলেও পুলিশ নির্বিচার গুলি ছোড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক সাবিনা আক্তার বলেন, সাঈদকে টার্গেট করে হত্যা করা হয়েছে।
এ বিষয়ে পুলিশ কমিশনার মনিরুজ্জামান বলেন, প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে ঘটনার বিবরণ দেওয়া হয়। বিবরণীতে সাঈদের মৃত্যুর বিষয়টি আছে; কিন্তু এটা চূড়ান্ত কিছু নয়। অনুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদন ও চিকিৎসকের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন এবং ঘটনার আশপাশের ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করে তদন্তে পুরো বিষয়টি উঠে আসবে।
পুলিশ কমিশনার আরও বলেন, ঘটনার দিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড ও শটগানের ছররা গুলি ব্যবহার করেছিল পুলিশ। পুলিশের কাউকে গুলি করার অনুমোদন দেওয়া হয়নি বা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি। বিস্তারিত তদন্তে পুলিশের কোনো সদস্যের গুলি করার প্রমাণ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনে রংপুরে ঘটে যাওয়া সংঘর্ষ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগে এখন পর্যন্ত ২২ মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে ২৫৮ জনকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। রংপুর মহানগর পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (অপরাধ) আবু মারুফ হোসেন বলেন, মহানগরীতে ২০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্যদিকে, জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইফতে খায়ের আলম বলেন, জেলায় ৫৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে রংপুরে সংঘর্ষ, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগে যতগুলো মামলা হয়েছে অধিকাংশই অজ্ঞাতানামা আসামি করা হয়েছে। এসব মামলায় বিএনপি, জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীকেই গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া কলেজ শিক্ষার্থী গ্রেফতারের অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে গ্রেফতার আতঙ্ক, উদ্বিগ্ন-উৎকন্ঠায় দিন পার করছেন নগরবাসী, শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী।
রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি আব্দুল বাতেন এবং রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মনিরুজ্জামান জানান, সুনির্দিষ্ট তথ্য উপাত্ত ও ভিডিও ফুটেজ পরীক্ষা করে চিহ্নিত অপরাধীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। নিরপরাধ কাউকেই হয়রানি কিংবা গ্রেফতার করা হচ্ছে না।
সারাবাংলা/একে