Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শুরু হচ্ছে সব থানার কার্যক্রম, সরকারেরও অগ্রাধিকার আইনশৃঙ্খলা

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৯ আগস্ট ২০২৪ ০৮:২৬

ঢাকা: কোটা সংস্কার আন্দোলনের পথ ধরে সরকারের পদত্যাগের এক দফা আন্দোলনের সফল পরিসমাপ্তি ঘটেছে ছাত্র-জনতা গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের মধ্য দিয়ে। আচমকাই প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এরপর সেনাবাহিনী আপৎকালীন দায়িত্ব নিলেও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভয়াবহ। পুলিশ বাহিনী নৃশংস নির্যাতনের শিকার হলে দেশের থানাগুলোর কার্যক্রমই বন্ধ হয়ে রয়েছে কয়েক দিন হলো।

দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘরবাড়িতে হামলা-ভাঙচুর-আগুন, চাঁদাবাজির সঙ্গে প্রতি রাতেই ডাকাতির আতঙ্কে এখন দিন কাটছে সবার। এমন এক নৈরাজ্যকর বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে সোমবার (৫ আগস্ট) সরকার পতনের চার দিনের মাথায় বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট) দায়িত্বভার গ্রহণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ বিভিন্ন ইউনিটের নেতৃত্বে এসেছে পরিবর্তন। সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্ব সাক্ষাৎও করেছে।

সেনাবাহিনী বলছে, শুক্রবারের মধ্যেই দেশের সব থানার কার্যক্রম শুরু হবে। এর জন্য সহযোগিতা প্রয়োজন হলে তা দিতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত সেনাবাহিনী। এদিকে বৃহস্পতিবার রাতে অন্তর্বর্তী সরকারের শপথের পর সেই সরকারের প্রধান উপদেষ্টাও বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণকে সরকার অগ্রাধিকার দেবে। নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের আইনের আওতায় আনা হবে।

১ জুলাই থেকে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিলেন শিক্ষার্থীরা। ১৬ জুলাই থেকে পরবর্তী মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে দুই শতাধিক প্রাণহানি ঘটে এই আন্দোলনে। নজিরবিহীন সহিংসতার শিকার হয়ে দেশব্যাপী শিক্ষার্থীরা দাবি আদায়ে আরও অনড় হয়ে ওঠেন। সরকারও বলপ্রয়োগ অব্যাহত রাখলে এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে রূপ নেয়।

গত ৩ আগস্ট এই আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে আয়োজিত কেন্দ্রীয় কর্মসূচি থেকে সরকার পতনের ডাক দেয়। একদিন পরই সোমবার আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। দুপুর আড়াইটা নাগাদ দেশও ছাড়েন ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে। বিজয়োল্লাসে মেতে ওঠে রাজধানী ঢাকাসহ গোটা দেশ।

এদিকে সোমবার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের সেই মাহেন্দ্রক্ষণেই দেখা দেয় সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু চিত্র। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে ঢুকে পড়েন লাখো মানুষ। গণভবনের যেখানে যা কিছু ছিল, সব তারা নিয়ে নেন। উল্লাসে মত্ত জনতা ঢুকে পড়ে সংসদ ভবনে। সেখানেও নেওয়ার যোগ্য কিছুই ভেতরে আর অবশিষ্ট ছিল না।

এদিকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেই খবর মিলতে থাকে, আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতাকর্মী, জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী, ধর্মীয় সংখ্যালঘুসহ বিভিন্ন মানুষের ঘরবাড়ি ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভাস্কর্য-ম্যুরালও ভাঙচুর করা হয় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক। এমন নৈরাজ্য চলতে থাকে রাতেও। চলে থানায় হামলা। পিটিয়ে হত্যা করা হয় পুলিশ সদস্যদের। অনেক থানায় আগুন দেওয়া হয়। থানা কমপ্লেক্স ভাঙচুর করে বিধ্বস্ত করা হয় অনেক এলাকায়।

এমন অবস্থায় পুলিশ প্রশাসন সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। মঙ্গলবার থেকে বলতে দেশের প্রায় সব থানার কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। সড়কে বন্ধ হয়ে যায় ট্রাফিক কার্যক্রম। অন্যান্য বাহিনীর কার্যক্রমও স্থবির হয়ে যায়। এর মধ্যেই বিভিন্ন স্থানে সন্ধ্যার পর থেকে দলবেঁধে এলাকায় এলাকায় ডাকাতির অভিযোগ আসতে থাকে। সেনাবাহিনী বিভিন্ন এলাকার জন্য কিছু মোবাইল নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করার কথা বললেও সবসময় এসব নম্বর থেকে সহযোগিতাও মেলেনি। পুলিশ সদস্যরা সাফ জানিয়ে দেন, তারা চরম আতঙ্কিত, কাজে ফিরবেন না।

একদিকে নেই পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনীর কার্যক্রম বন্ধ, অন্যদিকে দেশের নির্বাহী বিভাগও অভিভাবকহীন— সব মিলিয়ে এক ভয়াবহ আতঙ্কের মধ্যে দিয়ে দিন কাটাতে থাকে মানুষ। এ অবস্থাতেই মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) মধ্যরাতে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়। তার জায়গায় নিয়োগ দেওয়া হয় মো. ময়নুল ইসলামকে।

দায়িত্ব পেয়ে বুধবার রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন নতুন আইজিপি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার মধ্যে সব পুলিশ সদস্যকে কর্মস্থলে যোগ দিতে নির্দেশ দেন। এর মধ্যে র‌্যাব ও ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) শীর্ষ পদেও বদল আনা হয়। পুলিশের নতুন এসব নেতৃত্ব বৃহস্পতিবার ও বিমান বাহিনী প্রধানের উপস্থিতিতে বৈঠক করেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তথা শুক্রবার বিকেলের মধ্যেই দেশের সব থানায় কার্যক্রম শুরু করবে পুলিশ।

আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) এক বার্তায় বলেছে, সেনাপ্রধানের সঙ্গে বৈঠকে সারা দেশে অরাজকতা, অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। চলমান অরাজকতা, অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম বন্ধের মাধ্যমে দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনীসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শক্ত অবস্থান গ্রহণের বিষয়ে বাহিনীপ্রধানদের সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।

এদিকে সরকার পতনের চারদিনের মাথায় বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নেয় বঙ্গভবনে। এই শপথের পর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকেই অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা জানিয়েছেন।

ড. ইউনূস বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জন উৎসবের মুহূর্তে এ স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার জন্য ষড়যন্ত্রকারীরা দেশে একটি অরাজকতা ও ভীতির পরিবেশ তৈরি করেছে। অরাজকতা আমাদের শত্রু। একে দ্রুত পরাজিত করতে হবে। অরাজকতার বিষবাষ্প এখন যে-ই ছড়াবে, বিজয়ী ছাত্র-জনতাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পূর্ণ শক্তি তাকে ব্যর্থ করে দেবে।

এ মুহূর্তে অরাজকতা দমনকেই সরকারের প্রথম কর্তব্য হিসেবে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। বলেন, স্বাধীনতার মুক্ত বাতাস যেন প্রত্যেকে বুক ভরে নিতে পারে, এ নিশ্চয়তা দানই আমাদের সরকারের প্রথম প্রতিশ্রুতি। এ ব্যাপারে দেশবাসীর সহযোগিতা কামনা করছি। স্বাধীনতার এই মিলন মেলা থেকে বাদ যাবে না শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও। সেনা, নৌ, বিমান বাহিনী, বর্ডার গার্ড, পুলিশ, আনসার, গ্রাম প্রতিরক্ষা, কোস্টগার্ড কেউ বাদ যাবে না। আমি জাতির পক্ষ থেকে প্রত্যেককে নির্ভয়ে, আনন্দচিত্তে নিজ নিজ কর্মস্থলে নিজ নিজ সামর্থ্য নিয়ে এগিয়ে আসার অনুরোধ করছি।

পুলিশ সদর দফতর ও ঢাকা মহানগর পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিন বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে আইজিপি, র‌্যাবের মহাপরিচালক ও ডিএমপি কমিশনারের বৈঠকের পর পুলিশ সদস্যরা কিছুটা হলেও চাঙ্গা হয়েছেন। রাতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর প্রধান উপদেষ্টার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে অগ্রাধিকার দেওয়াকেও ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। পুলিশের শীর্ষ নেতৃত্ব পরিবর্তনসহ এসব কার্যক্রম কিছুটা হলেও তাদের মনোবল শক্ত করছে।

আরও পড়ুন:

অসহযোগের প্রথম দিনে সংঘর্ষ-সহিংসতায় সারাদেশে নিহত ৯২

বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল হাসপাতালে তাণ্ডব, বাস ভাঙচুর-আগুন

বৃহস্পতিবার দেশব্যাপী ‘কমপ্লিট শাটডাউন’

কমপ্লিট শাটডাউনে দেশব্যাপী সংঘর্ষ, নিহত বেড়ে ১০

‘কমপ্লিট শাটডাউনে’ গুলিতে প্রাণ গেল ৪ ছাত্রের

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএমপির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, আন্দোলনের শেষ দিকে এসে যেভাবে টার্গেট করে থানায় ঢুকে পুলিশ সদস্যদের পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে, সেটি সব নৃশংসতাকে হার মানায়। সহকর্মীর এমন পরিণতি দেখে আমরা কাজ করার ন্যূনতম ইচ্ছাশক্তিও হারিয়ে ফেলেছি। তার ওপর দেশে কোনো সরকার না থাকায় আমরাও অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছিলাম। এখন একটি সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। এখন কিছুটা হলেও আমাদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে।

তারা বলেন, এরই মধ্যে কোথাও কোথাও পুলিশ সদস্যরা যোগ দিয়েছেন, যদিও তারা সবাই কাজে ফেরেননি। এই মূহূর্তে শতভাগ পুলিশ সদস্যকে কাজে ফেরানোর বাস্তবতাও নেই। তবে ৮০ শতাংশ পুলিশ সদস্যও যদি কাজে যোগ দেন, সেটিই বর্তমান বাস্তবতায় যথেষ্ট। আশা করি নতুন সরকার ও পুলিশ বাহিনীর নতুন নেতৃত্বের নির্দেশনায় খুব দ্রুতই আমরা স্বাভাবিক সময়ে ফিরতে পারব।

সারাবাংলা/টিআর

অন্তর্বর্তী সরকার আইজিপি আইজিপি বদল কোটা আন্দোলন কোটা সংস্কার আন্দোলন থানায় হামলা পুলিশ পুলিশ বাহিনী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

৯০০তম গোলে ইতিহাস গড়লেন রোনালদো
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৯:০৪

সম্পর্কিত খবর