থানা নয়, যেন ভূতের বাড়ি!
১১ আগস্ট ২০২৪ ২২:১১
চট্টগ্রাম ব্যুরো: ছাত্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পর চট্টগ্রামসহ সারা দেশে শতাধিক থানা ও পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙচুর করা হয়, দেওয়া হয় আগুন। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) সদর দফতর ওে ১১টি থানাতেও হামলা হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত পাঁচটি থানা রীতিমতো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। আক্রমণের মুখে আত্মরক্ষার্থে থানা ও স্থাপনা ছেড়ে যেতে বাধ্য হন পুলিশ সদস্যরা।
প্রশাসনের আহ্বান মেনে শুক্রবার (৯ আগস্ট) থেকে থানাগুলোতে ফিরতে শুরু করেছেন পুলিশ সদস্যরা। তবে তিন দিনেও অল্প কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছাড়া তেমন কেউ যোগ দেননি। যারা কাজে ফিরেছেন, তারাও দিনে থাকলেও রাতে থানায় থাকছেন না। নেই কোনো সেবাপ্রার্থীও। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া থানাগুলো যেন হয়ে উঠেছে এক একটি ‘ভূতের বাড়ি’! তবে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ বলছে, এমন বিপর্যস্ত অবস্থাও কাটিয়ে ওঠার কার্যক্রম গ্রহণ করেছেন তারা। এ সপ্তাহ নাগাদ থানাগুলো ফিরে আসবে স্বাভাবিক কাজে।
গত সোমবার (৫ আগস্ট) শেখ হাসিনা পদত্যাগের পর চট্টগ্রাম নগরীর ১১টি থানা আক্রান্ত হয়। আগুন দেওয়া হয় আটটি থানায়। ছয়টি থানা থেকে লুট করে নেওয়া হয় অস্ত্র। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কোতোয়ালি, পতেঙ্গা, ইপিজেড, সদরঘাট ও ডবলমুরিং থানা। এরপর থেকে ১১ দফা দাবিতে কর্মবিরতিতে যান পুলিশ সদস্যরা।
রোববার (১১ আগস্ট) সকালে নগরীর কোতোয়ালি থানায় গিয়ে দেখা যায়, আগুনে পোড়া একটি ভবন দাঁড়িয়ে আছে। এক সপ্তাহ আগেও যে এটি একটি থানা ছিল, দেখে বোঝাই মুশকিল! আগুনে পুড়ে থানার দেয়ালগুলো কালচে রঙ ধারণ করেছে। থানার বাইরে রাখা পুলিশের গাড়িগুলো পুড়ে আবর্জনায় পরিণত হয়েছে। ভেতরের কক্ষগুলোতে শুধুই ধ্বংসস্তূপ।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কয়েকজন পরিচ্ছন্ন কর্মীকে থানা পরিষ্কারের কাজে নিয়োজিত দেখা গেল। চন্দনপুরা ফায়ার স্টেশনের একটি ইউনিটের কয়েকজন সদস্যকেও ঘটনাস্থলে কাজ করতে দেখা গেছে।
দুপুর ১২টার দিকে স্থানীয় একজন জমি দখলসংক্রান্ত অভিযোগ করতে এসেছিলেন কোতোয়ালি থানায়। দায়িত্বে থাকা পুলিশের এক কর্মকর্তা তাকে পরে যোগাযোগ করতে বলেন। ওই কর্মকর্তা সেবাপ্রার্থী ব্যক্তিকে বলেন, ‘বেশি সমস্যা হলে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা নেন।’
কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম ওবায়দুল হক কার্যালয়ের বাইরে খোলা স্থানে টেবিল পেতে কাজ করছিলেন। সঙ্গে ছিলেন কয়েকজন পুলিশ সদস্য। তবে আশপাশে কোনো সেবাপ্রার্থীকে দেখা যায়নি। দায়ের হয়নি কোনো অভিযোগও। ওসিকে ঘিরে বসে ছিলেন বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীরাও। থানার নিরাপত্তায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাত সদস্য বাইরে ও ভেতরে টহল দিচ্ছিলেন।
ওসি ওবায়দুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের ২৫ থেকে ৩০টি গাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে হামলাকারীরা। কোতোয়ালি জোনের সহকারী কমিশনার, দক্ষিণের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার, কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক (অপারেশন) ও পরিদর্শক (তদন্ত), ছয়টি মোবাইল প্যাট্রোলিং গাড়ি, সাঁজোয়া যান ও বিভিন্ন আলামতের গাড়িতে আগুন দিয়েছে তারা। থানার ভেতরে রাখা সব অস্ত্র লুট করে নিয়ে গিয়েছিল। পরে কিছু কিছু অস্ত্র সেনাবাহিনী ও জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে ফিরিয়ে দেয় অনেকে।’
কী পরিমাণ অস্ত্র লুট হয়েছে— এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশের এ কর্মকর্তা বলেন, ‘সব অস্ত্র লুট করে নিয়ে গেছে। থানায় থাকা রেজিস্ট্রার খাতাসহ সব নথিপত্র আগুনে পুড়ে গেছে। তাই কী পরিমাণ অস্ত্র লুট হয়েছে, সেটা এখনই নির্দিষ্ট করে বলতে পারছি না। সেটা নিয়ে আলাদাভাবে তদন্ত হচ্ছে। তদন্ত শেষে বলতে পারব। এক সপ্তাহের মধ্যেই আমরা পুরোপুরি কার্যক্রমে ফিরতে পারব বলে আশা করছি।’
চন্দনপুরা ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র অফিসার মো. আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘যেহেতু থানায় আগুন দেওয়া হয়েছিল, ভেতরে এখনো কিছু কিছু জায়গায় সমস্যা থাকতে পারে। তাই আমরা এসে আগে থানা পর্যবেক্ষণ করেছি। পরিচ্ছন্ন কর্মীদের সঙ্গে আমাদের সাত সদস্য কাজ করছে।’
এদিকে দুপুর ১টার দিকে নগর পুলিশের সদরঘাট থানায় গিয়ে দেখা যায়, থানার সামনে স্তূপ করে রাখা আছে পুলিশের কিছু পোশাক, কয়েক জোড়া বুটসহ আরও সরঞ্জাম। সব কিছুই অর্ধেকের মতো পোড়া ও ব্যবহারের অনুপযোগী। থানার বাইরে রাখা হয়েছে অর্ধশতাধিক আগুনে পোড়া মোটরসাইকেল ও সিএনজি অটোরিকশা, যেগুলোর বেশির ভাগই আলামতের গাড়ি।
পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, থানার ভেতরে থাকা নগর পুলিশের উপকমিশনার (ট্রাফিক), ওসি ও দুটি মোবাইল প্যাট্রোলিংয়ের গাড়িতেও আগুন দিয়েছিল দুর্বৃত্তরা। তাদের দেওয়া আগুনে চারটি গাড়িই পুড়ে প্রায় সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে গেছে।
দুপুর দেড়টার দিকে থানায় আসেন সদরঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফেরদৌস জাহান। আগে থেকেই থানায় অবস্থান নিয়েছিলেন স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা। ওসি আসার পরপরই তারা সবাই তাকে ঘিরে ধরেন এবং সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সদরঘাট থানার এক উপপরিদর্শক (এস আই) সারাবাংলাকে বলেন, ‘ওই দিন (৫ আগস্ট) বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে প্রায় দুই শ মানুষ আমাদের থানায় হামলা করে। তখন ওসি স্যারসহ আমরা সবাই ভেতরেই ছিলাম। পরিস্থিতি বুঝে যে যার মতো করে সাবধানে বের হয়ে চলে গেছি। আমাদের থানা থেকে কোনো অস্ত্র লুট হয়নি।’
সদরঘাট থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আতিক সারাবাংলাকে বলেন, ‘থানায় অনেক গাড়িতে আগুন দিয়েছে আক্রমণকারীরা। দরজা-জানালা ভেঙে ফেলেছে। চার থেকে পাঁচটি ল্যাপটপ চুরি করে নিয়ে গেছে। তবু আমরা সীমিত আকারে কার্যক্রম শুরু করেছি। ইন্টারনেটের সংযোগ এখনো বিচ্ছিন্ন। শিগগিরই পুরোদমে কাজ শুরু হবে থানায়।’
ডবলমুরিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফজলুল কাদের পাটোয়ারী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের থানায় ভালোই ক্ষতি হয়েছে। যে ক্ষতি হয়েছে, পূরণ করা সময়সাপেক্ষ। থানায় থাকা সবগুলো গাড়ি দুর্বত্তরা পুড়িয়ে দিয়েছে। পাঁচটি গাড়ি ছিল, একটাও ব্যবহার করার মতো অবস্থায় নেই। কিছু অস্ত্রও লুট হয়েছে। কম্পিউটার, ল্যাপটপসহ অনেক কিছু চুরি করে নিয়ে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার থানায় পাঁচ-ছয়জন ছাড়া সবাই যোগ দিয়েছে। তবে কোনো কার্যক্রম শুরু হয়নি। যারা বলছে কার্যক্রম শুরু হয়েছে তারা মিথ্যা বলছে।’
পতেঙ্গা থানা ভবনটির যে অবস্থা, তাতে সেটিতে কার্যক্রম পরিচালনা করাই সম্ভব না। আপাতত নতুন একটি ভবনে থানার কার্যক্রম শুরু করা হবে জানিয়ে এ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রবিউল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের থানায় কার্যক্রম শুরু করার মতো অবস্থায় নেই। ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে সব। আমরা নতুন একটি ভবনে শিফট হচ্ছি।’
চান্দগাঁও থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোমিনুল হাসান বলেন, ‘আমাদের থানার সব পুলিশ সদস্যই কাজে যোগ দিয়েছেন। কোনো অভিযোগ আসেনি। দিনের বেলায় আমরা অফিস করলেও সন্ধ্যা আগেই চলে যাই। সেনাবাহিনী ও আনসার সদস্যরা থানা পাহারা দিচ্ছে।’
সোমবার শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর গত কয়েকদিন ধরেই বন্ধ ছিল দেশের সব থানার কার্যক্রম। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নেয়। এর মধ্যেই দায়িত্বভার বুঝে নেওয়া পুলিশের নতুন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট) সন্ধ্যার মধ্যে সব ইউনিটের সদস্যকে কাজে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরপর দেশের অন্যান্য এলাকার মতো চট্টগ্রাম নগর পুলিশের বিভিন্ন থানায় সীমিত আকারে কার্যক্রম শুরু হয়। পুলিশ সদর দফতর জানিয়েছে, রোববার নাগাদ দেশের ৬৩৯টি থানার মধ্যে ৫৯৯টি থানাই কাজে ফিরেছে।
সিএমপির অতিরিক্ত উপকমিশনার (মিডিয়া) কাজী মো. তারেক আজিজ সারাবাংলাকে বলেন, ‘দুর্বত্তদের হামলায় নগরীর ১৬টি থানা কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পাঁচটি থানা। পুলিশ সদস্যরা কাজে যোগ দিতে শুরু করেছেন। তবে কোনো থানায় এখনো অভিযোগ জমা হয়নি। এক সপ্তাহের মধ্যে থানাগুলোর কার্যক্রম স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।’
এদিকে রোববার বিকেলে নগর পুলিশের সদর দফতর পরিদর্শনে যান সিএমপি কমিশনার সাইফুল ইসলাম, জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, চট্টগ্রামের সমন্বয়করা।
পরিদর্শন শেষে সিএমপি কমিশনার কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে পুলিশ কমিশনার সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ছাত্র-জনতার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পুলিশ কাজ করে যাবে। আমাদের আজ ক্ষতিগ্রস্ত থানাগুলো পরিদর্শন করার কথা ছিল। কিন্তু আমরা প্রথমে যারা আন্দোলন করতে গিয়ে শহিদ হয়েছেন তাদের বাড়িতে যাব। তারপর থানা পরিদর্শনে যাব।’
জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ‘আমরা পুলিশকে নিরাপত্তা দেবো। আন্দোলনে গিয়ে যারা নিহত হয়েছেন তাদের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আলাদাভাবে সহযোগিতা করা হবে।’
সারাবাংলা/আইসি/টিআর
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ চট্টগ্রামের থানা ছাত্র আন্দোলন থানা ভাঙচুর থানায় অগ্নিসংযোগ থানায় আক্রমণ থানায় আগুন থানায় হামলা থানার কার্যক্রম সিএমপি