কয়েদি নিহতের ঘটনায় দুই কারারক্ষী বরখাস্ত, তদন্ত কমিটি গঠন
১৭ আগস্ট ২০২৪ ০৯:৩৮
রংপুর: রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বাহারাম বাদশার মৃত্যুর ঘটনায় দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগে দুই কারারক্ষীকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তে জেলা প্রশাসনের একজন নির্বাহী মেজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক মোবাশ্বের হাসান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
কারাগার সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার রাগার ঝাড়ু দিচ্ছিলেন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদি রফিকুল ইসলাম। এ সময় পাশের গাছ থেকে লাঠি দিয়ে আমড়া পারছিলেন বাহারাম। এতে ঝাড়ু দেওয়া অংশে গাছে পাতা ও আমড়া পরে নষ্ট হওয়ায় রফিকুল তাকে বকাঝকা করেন। এ নিয়ে বাগ্বিতণ্ডা সৃষ্টি হলে রফিকুলসহ কয়েকজন কয়েদি বাহারামকে মারধর করেন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কারাগারের অভ্যন্তরে ‘ক্যাশ টেবিলের’ নামে জেল সুপারের নেতৃত্বে বিচার বসে। সেখানে শত শত বন্দিদের সামনে কারাগারের সিআইডিতে কর্মরত মোতালেব, সুবেদার শাহাজাহান ও জামাদার মাহবুব বাহরামকে গামছা দিয়ে হাত-পা বেঁধে নির্যাতন করলে এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েন। তখন কারারক্ষীরা তড়িঘড়ি করে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে কারাগারের পাশেই রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
জরুরি বিভাগ থেকে বলা হয়, কারাগার থেকে হাসপাতালে আনার পথেই অথবা কারাগারের মধ্যেই বাহরাম মারা গেছেন। চিকিৎসকের ভাষায়, ব্রট ডেড বলা হয়।
এদিকে কারাগারে নির্যাতনে বাহরাম বাদশার নিহতের ঘটনা কারা অভ্যন্তরে জানাজানি হলে দুপুর ১২টার দিকে গোসলের সময় বন্দিরা এক জোট হয়ে তিন কারারক্ষীর বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন। পুরো কারাগারে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়। এ সময় কারারক্ষীরা বন্দিদের দমন করার নামে লাঠিচার্জ করলে ৫০ জনেরও বেশি বন্দি আহত হন। পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে বন্দিরা কারারক্ষীদের ওপর চড়াও হওয়ার চেষ্টা করলে তারা অর্ধশতাধিক রাউন্ড গুলি বর্ষণ করেন। এরপরও পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এ সময় কারা কর্তৃপক্ষ জেলা প্রশাসক মোবাশ্বের হাসানকে কল করে পরিস্থিতি জানালে তিনি তাৎক্ষণিক সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশকে কারাগারের অবস্থা জানান।
খবর পেয়ে রংপুর সেনানিবাসের এরিয়া কমান্ডার ও ৬৬ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল সাকিল আহমেদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া গাড়িসহ বিপুল সংখ্যক সেনা সদস্য র্যাব ও পুলিশ কারাগারের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে প্রথমে ফাঁকা গুলি ছোড়ে। এ সময় পরিস্থিতি শান্ত হলে বন্দিরা রংপুর কারাগারের জেল সুপার, জেলার, ডেপুটি জেলারসহ কারাগারের সিআইডিসহ অন্য কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ বিভিন্ন অভিযোগ করেন।
বন্দিরা সেনাবাহিনী, পুলিশ, জেলা ও বিভাগীয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করে বলেন, প্রতিবাদ করলেই ‘কেস টেবিলের’ নামে ধরে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগার সব অপকর্মের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এখানে ১০ টাকা মিনিটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলা যায়। মাদক হাতের কাছে পাওয়া যায়। নিম্ন মানের খাওয়া সরবরাহ করা হয়।
কারাগার সূত্রে জানা গেছে, নিহত বাহরামের রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বগের বাড়ি গ্রামের বাদশা মিয়ার ছেলে। ২০০৮ সালে জমি সংক্রান্ত বিরোধকে কেন্দ্র করে হত্যা মামলায় আসামি বাহরাম বাদশা ও তার অপর তিন ভাই আলমাস, ওসমান গনি ও শাহ আলমের যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেন আদালত। ২০১১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বিচারক এ রায় দেন। ২০১১ সাল থেকে আসামি বাহরাম বাদশাসহ তারা চার ভাই রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক আছেন। তার কয়েদি নম্বর ৯৮০০-এ।
রংপুর জেলা প্রশাসক মোবাশ্বের হাসান বলেন, সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় কারাগারের ভেতরে প্রবেশ করে বন্দিদের সঙ্গে কথা বলা হয়। তাদের ওপর নির্যাতনসহ সব বিষয়ে তদন্ত করে দায়ীদের শাস্তি দেওয়ার আশ্বাস দিলে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়। দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি পুরো ঘটনাটির নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্ত করবে।
তিনি বলেন, ‘কারারক্ষীদের লাঠির আঘাতে বন্দি বাহরাম নিহত হয়েছে। তাকে লাঠিপেটা করার সময় সে বার বার বলেছে, সে হার্টের রোগী ও গুরুতর অসুস্থ। তারপরও তাকে পেটানো হয়েছে।’
বন্দিরা কারাগারের কর্মকর্তা ও সদস্যদের বিরুদ্ধে অনেক অনিয়মের অভিযোগ করেছে- এসব বিষয়ে তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।
সারাবাংলা/একে