নিয়তির দিকে তাকিয়ে গোমতীপাড়ের বাসিন্দারা
২২ আগস্ট ২০২৪ ২৩:২৫
কুমিল্লা থেকে ফিরে: ‘হঠাৎ পানি বাড়তে থাকায় বাড়ির কিছু জিনিসপাতি যা পারছি, নিয়ে রাস্তায় এসে উঠছি। বৌ-বাচ্চা নিয়ে এখন রাস্তাতেই আছি। গতকাল থেকে এই জন, ওই জন এসে খাওয়া দিয়ে যাচ্ছে, তা খেয়েই কাটাচ্ছি দিন। বাড়ির কিছু আর নাই। যা নিয়ে রাস্তায় উঠতে পারছি, সেগুলো বাদে বাকি সব কিছু ভেসে গেছে। ঢলের পানি কমলে আবার ঘর বাঁধব কীভাবে, জানি না। এখন নিয়তির দিকে তাকিয়ে আছি। আর কিছুই করার নাই।’
চোখের পানি মুছতে মুছতে সারাবাংলাকে কথাগুলো বলছিলেন কুমিল্লার আড়াইওরার ৫২ বছর বয়সী রমিজ মিঞা। একটি পোলট্রি ফার্মে কাজ করতেন তিনি। টানা বৃষ্টিতে কয়েকদিন কাজে যেতেই পারেননি। জানালেন, সেই পোলট্রি ফার্মও পানিতে তলিয়ে গেছে বলে জানতে পেরেছেন।
রমিজ মিঞার মতো আরও অনেকে ঘরের জিনিসপত্র নিয়ে ঠাঁই নিয়েছেন গোমতী বাঁধের মূল সড়কে। সবার চোখেমুখে অনিশ্চয়তার ছাপ। হঠাৎ হাজির হওয়া বন্যায় অনেকে ঘরবাড়ি থেকে তেমন কিছুই বের করে আনতে পারেননি। কেউ কিছু জামাকাপড় নিতে পারলেও আনতে পারেননি টাকা-পয়সা।
আরও পড়ুন-
- বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শনে যাবেন উপদেষ্টারা
- চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু, পাঠানো হলো ত্রাণ
- খাগড়াছড়িতে হাজারও পরিবার পানিবন্দি, উদ্ধারে সেনাবাহিনী
- উপদেষ্টাদের বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ ড. ইউনূসের
- তলিয়ে গেছে ২ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর জমি, কর্মকর্তাদের ছুটি বাতিল
- ৮ জেলার ৩৫৭ ইউনিয়নে পানিবন্দি সাড়ে ৪ লাখ পরিবার, ৩ জনের মৃত্যু
কুমিল্লার গোমতী নদীর বাঁধের ভেতরের দিকে থাকা গ্রামগুলোর অধিবাসীদের চিত্র এখন এমনই। ঘরের ছাদ বা চাল পর্যন্ত পানি উঠে যাওয়ায় কেবল প্রাণ নিয়ে বেঁচে আসাকেও অনেকে প্রাপ্তি মনে করছেন। পানি নেমে গেলে অন্তত তারা আশ্রয়টুকু পাবেন। তবে যাদের বাড়িঘর কাঁচা, তারা প্রাণে বাঁচলেও তাদের ঘরবাড়ি বাঁচেনি। বন্যা চলে গেলে নতুন করে ঘর বাঁধতে হবে তাদের।
স্থানীয় ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কেবল কুমিল্লা সদর উপজেলা ও বুড়িচং উপজেলাতেই বাঁধের ভেতরে বসবাসকারী অন্তত দেড় হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘরবাড়ির পাশাপাশি অনেকের ক্ষেতের ফসল, হাঁস-মুরগির খামারও ভেসে গেছে পানির স্রোতে। তলিয়ে গেছে শত শত মাছের ঘের, পুকুর, দিঘি, আউশ ধান ও আমনের বীজতলা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য বলছে, বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) পর্যন্ত জেলার ৬৫ হাজার হেক্টরেরও বেশি জমি বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। এর মধ্যে কেবল বাঁধের ভেতরের গ্রামগুলোতেই ফসলি জমি আক্রান্ত হয়েছে অন্তত চার হাজার হেক্টর। দুই দিনের বন্যাতেই ক্ষতির পরিমাণ এতটা হলে সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি কী হতে পারে, তা ভাবতেও ভয় পাচ্ছেন এই এলাকার বাসিন্দারা।
বৃষ্টি এবং গোমতী নদীর পানি বৃদ্ধি— কোনোটিই থামেনি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত। আবহাওয়া অধিদফতরের এ দিনের সন্ধ্যা ৬টার তথ্য বলছে, আগের ২৪ ঘণ্টায় কুমিল্লায় বৃষ্টি হয়েছে, যা এই সময়ে পাওয়া তথ্যে সারা দেশে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। প্রবল এই বর্ষণে গোমতী নদীর পানি সন্ধ্যা পর্যন্তও বাড়ছিল। অবিরাম বৃষ্টি হওয়ায় নদীর আশপাশের এলাকা দ্রুতই প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন স্থানীয়রা।
৭৪ বছর বয়সী রহিমা বেগম সারাবাংলাকে বলেন, গত ১৮-২০ বছরে এত পানি দেখা যায়নি গোমতীতে। হঠাৎ করেই পানি এত বেশি বেড়ে গেছে যে অনেকেই আসলে কিছু বুঝে উঠতে পারিনি। কেউ কেউ এক কাপড়েই ঘর ছেড়েছে। এখন টানা বৃষ্টির জন্য রাস্তায় পলিথিন দিয়ে ছাউনি করে কোনোমতে দিন কাটাতে হচ্ছে।
গোমতীর দুই তীরেই এখন নির্ঘুম রাত কাটতে লাখো মানুষের। জেলা প্রশাসনের তথ্য বলছে, কুমিল্লার বিভিন্ন উপজেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ১০ লাখের বেশি মানুষ। জলাবদ্ধ হয়ে পড়েছেন কুমিল্লা নগরীর বাসিন্দারাও। বর্তমানে নদীতে যে তীব্র স্রোত, তাতে যেকোনো সময় গোমতীর শহর রক্ষা বাঁধ ধসে পড়ার আশঙ্কায় রয়েছেন স্থানীয়রা। তাদের সে আশঙ্কা উড়িয়েও দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ কেবল সদর উপজেলাতেই অন্তত ১২টি জায়গায় বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। নগরীসংলগ্ন বাঁধ ধসে পড়লে পুরো নগরী পানিতে তলিয়ে যাবে বলে আশঙ্কায় দিন কাটছে স্থানীয়দের।
কুমিল্লার দক্ষিণাঞ্চলের উপজেলা নাঙ্গলকোট, মনোহরগঞ্জ ও চৌদ্দগ্রামের অধিকাংশ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। কুমিল্লা আদর্শ সদর, লাকসাম, বুড়িচং, বরুড়া, দেবিদ্বার, মুরাদনগর ও দাউদকান্দির নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় নিদারুণ কষ্টের মধ্যে পড়েছেন ওইসব এলাকার মানুষ।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ২৭ বছরের রেকর্ড ভেঙে বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টার দিকে বিপৎসীমার ১১৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে গোমতীর পানি। নদীর পানি এখন পাড়সমান। অনেক এলাকাতেই নদীর পাড়ে ফাটল প্রকট হয়ে উঠছে। এর মধ্যে কুমিল্লার শহরের চানপুর ব্রিজের কাছে ও বুড়িচংয়ের ময়নামতি ইউনিয়নের কাঠালিয়া এলাকায় পাড় ছিদ্র হয়ে পানি বের হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জমান বলেন, ১৯৯৭ সালে গোমতীর পানি বিপৎসীমার ৯৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল। কিন্তু গত দুই দিনে পানি বাড়তে বাড়তে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে।
নির্বাহী প্রকৌশলী আরও বলেন, বাঁধ রক্ষায় সেনাবাহিনী, জেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড, উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ, জনপ্রতিনিধি, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, শিক্ষার্থী ও স্থানীয় বাসিন্দারা কাজ করছেন। বাঁধের বেশ কিছু ঝুঁকিপূর্ণ অংশ দিয়ে বুধবার রাত থেকে চুইয়ে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। যেখানেই আমরা খবর পাচ্ছি, স্থানীয় লোকজনকে সহায়তায় করছি। পাশাপাশি পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছি।
কুমিল্লা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবেদ আলী জানান, বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করায় কুমিল্লায় বুধবার পর্যন্ত ১৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। পানি বাড়তে থাকায় বৃহস্পতিবার আরও কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। বন্যাদুর্গতদের চাল ও শুকনো খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে।
কুমিল্লার জেলা প্রশাসক খন্দকার মু. মুশফিকুর রহমান বলেন, নদী তীরবর্তী সবাইকে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য বারবার আহ্বান করা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামতে কাজ চলছে। ভারতীয় ঢল ও বৃষ্টি না কমলে বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হবে না।
সারাবাংলা/এসবি/টিআর