এখনো ডুবে আছে কুমিল্লা-ফেনী, নোয়াখালীতে সূর্য উঠেছে ৮ দিন পর
২৩ আগস্ট ২০২৪ ১১:৫৫
ঢাকা: টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কুমিল্লা, নোয়াখালী এবং ফেনীর কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ছেন। তলিয়ে গেছে হাজার হাজার হেক্টর এলাকার ফসলি জমি ও মাছের ঘের।
বিস্তারিত আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে:
কুমিল্লা: তীব্র পানির স্রোতে ভেঙে গেছে কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার বুরবুরিয়া এলাকায় গোমতী নদীর বাঁধ। ছোট একটি অংশ ভেঙে লোকালয়ে হু হু করে প্রবেশ করছে পানির প্রবাহ। বাঁধ ভাঙার কারণে ষোলনল ইউনিয়নের বুরবুড়িয়া গ্রাম থেকে বুড়িচং সদর ও ব্রাহ্মণপাড়া দুই উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে যাবার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুল লতিফ বাঁধ ভাঙার তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) রাত ১২টার দিকে বুড়িচং উপজেলার বুরবুরিয়া এলাকায় বাঁধ ধসে গিয়ে পানি ঢুকে পড়েছে বুড়িচং উপজেলার ষোলনল, পীরযাত্রাপুর, ভরাসার, বুড়িচং সদর, বাকশিমুল, রাজাপুরসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের লোকালয়ে। রাতে আতঙ্কিত মানুষ দিগ্বিদিক ছুটোছুটি শুরু করেন। অনেককে গোমতি বাঁধের ওপরে আসবাবপত্র ও গবাদি পশু নিয়ে অবস্থান নিতে দেখা গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড, কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালীউজ্জামান বলেন, ‘টানা বৃষ্টি ও ভারতীয় ঢলের পানি বেড়েছে কুমিল্লার গোমতি নদী ও খালগুলোতে। রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছে এই নদী। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে বুড়বুড়িয়ায় বাঁধে ধস নামার আগ পর্যন্ত বিপৎসীমার ১৩২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে নদীর পানি প্রবাহিত হয়েছে।’
তিনি জানান, গতকাল রাত সাড়ে ১২টার দিকে নগরীর সংরাইশ-টিক্কারচর এলাকায় গোমতি নদীর বাঁধের অংশে গর্ত দিয়ে পানি প্রবেশ করছে বলে স্থানীয় মসজিদে ঘোষণা আসে। পরে এলাকাবাসী যে যার মতো করে বালুর বস্তা নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে ফেলে দেয়। অন্যদিকে কটকবাজার, আড়াইওড়া, চাঁনপুর, মুরাদনগর ও দেবীদ্বারের বিভিন্ন স্থানে বাঁধের গর্ত ও ফাটল দিয়ে পানি প্রবেশ করছে এমন খবর মাইকে প্রচারিত হলে, স্থানীয়রা নিজ উদ্যোগে রাত জেগে সেগুলো মেরামত করেন।
তবে, অনেক জায়গায় গুজব ছড়ানোর কথা জানা যায় বলেও জানান তিনি।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ইতোমধ্যে জেলার ১১টি উপজেলার ৬২টি আশ্রয়কেন্দ্রে চার হাজার ৩০০ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। দ্রুত আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য মাইকিং করা হচ্ছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আবেদ আলি জানান, বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত ১১ উপজেলার দুই লাখ তিন হাজার মানুষ পানিবন্দি।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) পঙ্কজ বড়য়া বলেন, ‘টানা বৃষ্টি ও ভারতীয় উজানের পানি জেলার ১৭ উপজেলায় কম-বেশি প্রবাহিত হচ্ছে, যা এখনো অবনতির দিকে। ইতিমধ্যে জেলায় ৫৮৭টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এতে প্রায় ২০ হাজারের মতো লোক আশ্রয় নিয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৭০ মেট্রিকটন চাল ও নগদ ১২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।’
ফেনী: মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত বন্যায় ফেনী জেলার ছয়টি উপজেলার ১৫টি ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানিবন্দি ও ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় তিন লাখ লোক। জেলার ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া উপজেলায় বন্ধ রয়েছে সড়ক যোগাযোগ, নেই বিদ্যুৎ সংযোগ। বেশির ভাগ এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্কও বিচ্ছিন্ন। বন্যার পানিতে ডুবে জেলায় একজনের মৃত্যু হয়েছে। জেলায় আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে ৭৮টি। মেডিক্যাল টিম চালু করা হয়েছে ৭৬টি। আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন ২০ হাজার জন।
জেলায় সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী উদ্ধারকাজে নিয়োজিত রয়েছে। সেনাবাহিনী থেকে ১৬০ জন সদস্য ও ৪০টি উদ্ধারকারী যান জেলায় পাঠানো হয়েছে। নৌবাহিনীর ৭১ সদস্য ও আটটি উদ্ধারকারী যান কাজ করছে। এ ছাড়া একটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে জেলায়।
বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী ও কোস্ট গার্ডের ২৪টি বোট নিয়োজিত। তাদের পাশাপাশি বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস ও স্বেচ্ছাসেবীরাও উদ্ধার তৎপরতায় যোগ দিয়েছেন। তবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় এবং পানির প্রবল স্রোতের কারণে উদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
সকালে বিপৎসীমার ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল ফেনীর মুহুরী নদীর পানি। ফুলগাজীর সদর ইউনিয়ন, আনন্দপুর, মুন্সীরহাট, আমজাদহাট ইউনিয়নের ৫০টির বেশি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ছাগলনাইয়ার পাঠাননগর, রাধানগর ও শুভপুর ইউনিয়নেরও বেশ কয়েকটি গ্রাম বন্যাকবলিত। এসব এলাকায় তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট, পুকুর ও ফসলি জমি। কিছু কিছু এলাকায় বানের পানি মানুষের ঘরের ছাদ ও টিনের চালও ছুঁয়েছে।
ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রায়হান মেহেবুব বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) বিকেলে বলেন, তিন উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ, বেশির ভাগ এলাকায় পানির নিচে। এ ছাড়া ফেনী সদর, সোনাগাজী ও দাগনভূঁইয়া উপজেলার অনেক এলাকাও বন্যাকবলিত।
তিনি বলেন, তিন উপজেলায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।পানিবন্দি লোকজনকে উদ্ধারে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, স্থানীয় লোকজন ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা কাজ করছে। বুধবার রাত থেকে গতকাল দুপুর পর্যন্ত অন্তত ৫০ হাজারের মতো মানুষকে উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে। বেশির ভাগ উপজেলায় মোবাইল নেটওয়ার্ক ও বিদ্যুৎ নেই।
ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, পাহাড়ি ঢল ও বন্যার কবল থেকে লোকালয় রক্ষা করতে সোনাগাজী উপজেলার বড় ফেনী নদীর ওপর নির্মিত মুহুরী রেগুলেটরের (জলকপাট) ৪০টি গেট খুলে দেওয়া হয়েছে।
ফেনীর জেলা প্রশাসক সেলিনা আক্তার বলেন, বন্যাকবলিতদের উদ্ধারের জন্য সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিজিবি কাজ করছে। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনও মাঠে আছে।
এদিকে, দীর্ঘ ৮ দিন পর নোয়াখালীতে সূর্যের দেখা মিলেছে। শুক্রবার (২৩ আগস্ট) সকালে সুবর্ণচরসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে সূর্যের দেখা মেলে।
জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, সূর্যের দেখা মেলায় কিছুটা স্বস্তি পেয়েছি। তবে ৮ উপজেলার মানুষ এখনও পানিবন্দি।
জানা গেছে, নোয়াখালী পানিবন্দি হয়েছেন ২০ লাখ মানুষ। প্রায় চার শতাধিক আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছেন ৪০ হাজারের বেশি মানুষ। এছাড়া বন্যায় ভেসে গেছে ৮ উপজেলার কয়েক হাজার মাছের প্রজেক্ট, মুরগি খামার, আমনের বীজতলা, শাকসবজি খেত এবং ঝড়ো বাতাসে ভেঙে গেছে কাঁচা গাছপালা। বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে পড়ায় বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে কয়েকটি এলাকা।
জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, পানিবন্দি ও বানভাসি মানুষের জন্য আমাদের ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত আছে। মানবিক সহায়তা হিসেবে আমরা ৫০৫ মেট্রিক টন চাল ও প্রায় ২৫ লাখ টাকা বিতরণ করেছি।
সারাবাংলা/এনইউ