দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের অনন্য নজির ঢাবির টিএসসি
২৫ আগস্ট ২০২৪ ১৪:৫২
ঢাকা: শনিবার (২৪ আগস্ট) রাত ৯টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির ভেতর থেকে ঘোষণা আসে— ত্রাণ রাখার মতো আর জায়গা নেই। ভেতরের আনাচ-কানাচ পরিপূর্ণ। কিন্তু, মানুষের ঢল যেন থামেই না। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষদের কেউ নগদ টাকা, কেউবা শুকনো খাদ্যসামগ্রী হাতে দলে দলে টিএসসি প্রাঙ্গণে এসে পৌঁছাচ্ছে। যে জায়গাটা আগে কেবল আড্ডা-গল্পে-গানে সীমাবদ্ধ ছিল, সেই টিএসসি এখন দায়িত্ব আর কর্তব্যবোধের অন্যন্য নজির স্থাপন করল।
কেবল টিএসসি নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু ভবন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, জিমনেশিয়ামসহ বিভিন্ন স্থানে চলছে ত্রাণ সংগ্রহ কার্যক্রম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস যেন রূপ নিয়েছে দায়িত্ব-কর্তব্য ও মানবিকবোধের এক অনন্য ক্যাম্পাসে।
গত ২২ আগস্ট বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয় ত্রাণ কার্যক্রম। দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল চলমান বন্যায় আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর জন্য ত্রাণ সহায়তায় নেমেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। কার্যক্রমের প্রথমদিন নগদ অর্থ জমা হয় ২৯ লাখ টাকা। দ্বিতীয়দিন শুক্রবার চারগুণেরও বেশি বেড়ে ১ কোটি ৪২ লাখ ৫০ হাজার ১৯৬ টাকা নগদ অর্থ ওঠে। তৃতীয়দিনেও অর্থ সংগ্রহ চলে সমান গতিতে। রাত ১১টায় গণনা শেষে সংশ্লিষ্টরা জানান, সর্বমোট ২ কোটি ২৫ লাখ ৪৭ হাজার ৪৭০ টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে এদিন।
শনিবার সাড়ে আড়টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি গিয়ে দেখা যায়, লোকে লোকারণ্য হয়ে আছে পুরো এলাকা। স্বেচ্ছাসেবীরা ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। প্রাইভেটকার, ট্রাক কিংবা হাতে করে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে মূল ফটকের দিকে ভিড় করছে মানুষ। বিকেল পৌনে ৫টার দিকে র্যাবের পক্ষ থেকেও দুই ট্রাক ত্রাণসামগ্রী নিয়ে আসা হয়।
মূলফটক পেরিয়ে ভেতরের টিএসসির চিত্র যেন চেনাই যায় না। চারদিকে ত্রাণের স্তূপ। পানি, শুকনো খাবার, চাল-ডাল কিংবা বড় বড় প্যাকেটে ভরে আছে আনাচ-কানাচ। শেষ পর্যন্ত রাত ৯টার দিকে ঘোষণা আসে, আর জায়গা নেই ভেতরে। এর পর স্বেচ্ছাসেবীরা ঘোষণা দেন, জিমনেশিয়ামে ত্রাণ সংগ্রহ করা হবে। তখন মানুষের স্রোত ছোটে সেদিকে।
ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ— সব বয়সের মানুষের আনাগোনা টিএসসিতে। শিশুদের কেউ কেউ মাটির ব্যাংকে জমানো টাকা, কেউ আবার মাটির ব্যাংক নিয়েই হাজির হচ্ছে টিএসসিতে। শনিবার বিকেলে দ্বিতীয় শ্রেণি পড়ুয়া এক শিশু মাটির ব্যাংক হাতে এসে হাজির হন। বুথে থাকা শিক্ষার্থীরা আদরে-যত্নে বুঝে নেন শিশুর দেওয়া মাটির ব্যাংকটি। এ ছাড়া, ত্রাণ সংগ্রহের প্রথমদিনে ওমরার জন্য জমিয়ে রাখা ১৪ হাজার টাকা দেন এক শিশু। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ মূলধারার গণমাধ্যমগুলোতেও বেশ আলোচনার জন্ম দেয় ঘটনাটি।
ক্যাম্পাসের আবাসিকগুলোতেও চলছে আলাদাভাবে ত্রাণসংগ্রহ কার্যক্রম। হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল, সূর্যসেন হল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলসহ বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীরা হলগুলোর অ্যালামনাইদের সহযোগিতায় আলাদাভাবে বন্যাপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন।
হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে গিয়ে দেখা যায়, হলটির অতিথিকক্ষে চলছে প্যাকেজিংয়ের কাজ। টিভিরুমের পাশে শিক্ষার্থীদের কাপড়ের স্তূপ। শুকনো কাপড়ের চাহিদা মেটাতে নিজেদের পরনের কাপড়টুকুও বিলিয়ে দিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। অন্য হলগুলোর চিত্রও একইরকম।
এদিকে, শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ২৫ ট্রাক ত্রাণ ফেনী-কুমিল্লায় পাঠিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সহ-সমন্বয়কদের একজন মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘আমরা জনসাধারণের কাছ থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছি। মানুষ তাদের সাধ্য অনুযায়ী যে যা পেরেছে দান করেছে। আজ ভোত রাত পর্যন্ত আমরা ২৫ ট্রাক ত্রাণ সামগ্রী পাঠাতে পেরেছি। ইতোমধ্যে টিএসসি ক্যাফেটেরিয়া, গেমস রুম ও বারান্দাগুলো পূর্ণ হয়ে আছে। আজ রাতে ডজনখানেক ট্রাক বিভিন্ন বন্যা কবলিত এলাকায় পৌঁছে যাবে। ছাত্র-জনতার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা এই দুর্যোগ কাটিয়ে উঠব।’
অপরদিকে, ব্যস্ত সময় পার করা স্বেচ্ছসেবীদের মাঝে যেন ক্লান্তির ছোঁয়া নেই। স্বেচ্ছাসেবকদের একজন আরিফুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীরাই দেশের ক্রান্তিকালে এগিয়ে আসে। বাংলাদেশে এটা নতুন নয়। আমরা নতুন এক বাংলাদেশে আছি। এখন দায়িত্ব আরও বেশি। ক্লান্তি, আলস্য এর কিছুই ম্যাটার করে না। দেশটা আমার, আমাদের। দেশের একপ্রান্তে আমার ভাইবোনেরা জীবনঝুঁকিতে আছে। আমরা আরও বসে থাকি কীভাবে?’
জাপানিজ স্টাডিজের পক্ষে ত্রাণবিতরণ কার্যক্রমে যোগ দেওয়া প্রণয় দেবনাথ বলেন, ‘আসলে আমরা চাইলে কি না সম্ভব! একসাথে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করলে এই দেশ তার সঠিক পথ খুঁজে পেতে বেশি সময় লাগবে না। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।’
সারাবাংলা/আরআইআর/পিটিএম