Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কমছে বন্যার পানি, ক্ষত নিয়েই ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে ফেনী শহরবাসী

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
২৬ আগস্ট ২০২৪ ১০:৪০

ফেনী থেকে: কোলের দুই শিশুকে নিয়ে ফেনী শহরের সহদেবপুর এলাকার একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন মিহির পাল ও তার স্ত্রী শিখা পাল। তবে বন্যার পানি বাড়ার পরে উপায় না দেখে শিশুদের নিয়েই বাসা থেকে বের হয়ে আসতে হয় তাদের। কিন্তু প্রায় বুক সমান পানিতে শিশুদের নিয়ে বের হওয়াটাও সহজ ছিল না। আর তাই কলাগাছ যোগাড় করে ভেলা বানিয়ে তাতে উঠিয়ে দেন দুই শিশুকে। আর সেটি ধরে দু’জন দুইদিকে বন্যার পানি সরিয়ে পায়ে হেঁটেই চলে আসেন বাঁশপাড়া এলাকায় থাকা এক আত্মীয়ের বাড়িতে।

বিজ্ঞাপন

গতকাল রোববার (২৫ আগস্ট) বাঁশপাড়া রাস্তার সম্মুখে প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হলে দু’জনেই কান্না শুরু করেন।

মিহির পাল বলেন, ‘কী করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। একদিকে বাসার জিনিসপত্র আর অন্যদিকে দুইটা বাচ্চা। মোবাইলে নেটওয়ার্ক না থাকার কারণে কাউকে ফোনেও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। উদ্ধারকারী দলের জন্য অপেক্ষা করলে বাচ্চাগুলোর কী হবে। আশেপাশে স্পিড বোট বা নৌকা ছিল না তখনো। বাইরে বের হয়ে দেখি প্রায় বুকসমান পানি। কোনোমতে একটা কলাগাছ যোগাড় করে ভেলা বানিয়ে তাতে মেয়ে দুইটাকে বসিয়ে চলে আসি আত্মীয়ের বাড়িতে।’

তিনি বলেন, ‘শুনেছি আজ পানি কমেছে আমার বাসার ওদিকে। কিন্তু সেখানে গিয়ে তো দেখবো আর কিছুই হয়তো বা ঠিকঠাক নেই। মেয়ে দুইটাকে নিয়ে দিনের পর দিন তো আর আত্মীয়ের বাসায় থাকা যাবে না। শুনেছি দোকানপাট খুলেছে আর তাই বের হয়ে আপাতত কিছু জিনিসপত্র কিনে তাও বাসায় ফেরার চেষ্টা করছি এখন।’

সকাল ১১টার দিকে যখন প্রতিবেদকের সঙ্গে এই কথা হচ্ছিল তখনো মোবাইলের নেটওয়ার্ক সম্পূর্ণভাবে ফিরে আসেনি ফেনী শহরে। আর তাই তিনি অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে এখনো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। তবে এই সময়ে বাঁশপাড়া এলাকার সম্মুখভাগে দেখা যায়, বন্যার পানি নেমে গেছে। তবে মাস্টারপাড়ার দিকের সড়কে পানি তখনও ছিল।


সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফেনী তুলাবাড়ীয়া এলাকার ৪০ থেকে ৫০ জন নাগরিকের পানিবদ্ধ হয়ে আটকের থাকার তথ্য জানা যায়। এর পাশাপাশি খাদ্য ও পানি সংকটে থাকার কথাও জানা যায়। তুলাবাড়ীয়া গিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়। তবে তারা বর্তমানে নিরাপদে আছেন জানালেও এখন পর্যন্ত বিগত কিছুদিনের ভয়াবহতা ভুলতে পারেননি বলেই জানালেন।

বিজ্ঞাপন

দুপুর ১২টার দিকে সরেজমিনে দেখা যায়, ফেনীর ট্রাঙ্ক রোড হয়ে মাস্টার পাড়া, সহদেবপুর ও পরবর্তীতে অ্যাকাডেমি রোড, মিজান রোডের দিকে বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। ট্রাঙ্ক রোডের দিকে পানি কমলেও মহীপাল যাওয়ার রাস্তায় এখনো কিছু অংশে ভালো মাত্রাতেই বন্যার পানি আছে।

তবে হ্যাঁ, কমতে শুরু করেছে ফেনীর শহর এলাকার বন্যার পানি। আপাতত রোববার (২৫ আগস্ট) পর্যন্ত এটাই ফেনী শহরে নাগরিকদের কাছে একমাত্র সুখবর। তবে বন্যার পানি নেমে গেলেও স্বস্তি ফেরেনি নগরবাসীর মনে। একদিকে পুরো শহরবাসীর মনে বিগত দিনগুলোর বন্যা পরিস্থিতির কারণে সৃষ্টি হওয়া ক্ষত আর অন্যদিকে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার কারণে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে নানা রকমের ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন।

শুধুমাত্র ফেনীতেই নয়, বন্যার পানি নেমেছে ফেনীর আশেপাশের কিছু এলাকাতেও। তবে এখনো পানিবন্দি হয়ে আছে অনেক এলাকার মানুষ। আর তাদের সাহায্যের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবকরা। ত্রাণ বিতরণের পাশাপাশি এখনও উদ্ধার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।

তবে এখনো জেলার অধিকাংশ এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক অচল রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ।

উকিলপাড়া নিবাসী জহিরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখনো বিদ্যুৎসংযোগ স্বাভাবিক হয় নাই। ওয়াপদা অফিসে যোগাযোগ করলে তারা জানিয়েছে, সংযোগ দেওয়া হলেও দুর্ঘটনার আশঙ্কার কারণে এখনো সেটা দেওয়া হচ্ছে না। এ কারণে পানির মোটর ছাড়তে পারছি না। বিভিন্ন জায়গা থেকে ত্রাণ নিয়ে মানুষ আসছে কিন্তু সেটা দিয়ে আর কতদিন? তার ওপর নেই মোবাইল নেটওয়ার্ক। শুনেছি শহরের অধিকাংশ জায়গায় দোকান পাট খুলেছে। এখন তাই বের হয়ে ঘরের জিনিসপত্র কিনতে যাবো।’

বাঁশপাড়া এলাকায় লিমন সাহা নামে একজন যুবক সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিদিন মন্দিরে প্রসাদ দেওয়া হচ্ছে। এর পাশাপাশি মসজিদ থেকেও খাওয়া বিতরণ করা হচ্ছে। আপাতত তাই এটা মানুষের অনেক উপকারে আসছে।’

মসজিদ এলাকায় কথা হলো ষাটোর্ধ্ব রাজীবুল আহসান নামে একজন ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘বুধবার (২১ আগস্ট) থেকে তার নিজ বাড়ি দাগনভুঞাতে পানি প্রবেশ করে। এর এক দিনপর তিনি পরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গে এখানে চলে আসেন।’

তিনি বলেন, ‘এর আগে টিভিতে দেখেছি কিন্তু বন্যা এমনও হয় তা এই প্রথম দেখলাম। এখনো নাকি পানি কমে নাই। কমলে আগে আমি বাড়িতে যাবো। আর তারপরে অন্যদের নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবো।’

সহদেবপুর এলাকার প্রবেশ মুখেই দেখা গেলো লাইন ধরে ত্রাণের জন্য মানুষের অপেক্ষা। এর মাঝেই আবার অনেকে বিভিন্ন স্থান থেকে পানিসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে বাড়ি ফিরছিলেন।

রাজীব চৌধুরী নামে একজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘পানি তো কমা শুরু করেছে। আর তাই ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার চেষ্টাটা তো করতেই হবে। সেটাই করে যাচ্ছি। বাকিটা নিয়তিতে যা লেখা আছে তা হবে।’

মাস্টারপাড়ার দিকে যাওয়ার পথে দেখা গেলো, যাদের বাড়ি নিচতলায় তাদের অনেকেই বিছানার তোষক, সোফার গদিসহ নানা কিছু বাড়ি থেকে বের করে রাস্তায় রেখেছে।

ইফতি ইসলাম নামে একজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘রোদ উঠলেও হয়তোবা কিছুটা উপকার হতো। কিন্তু এখনো মাঝে মধ্যে গুঁড়ি গুঁড়ি আবার মাঝে মধ্যে বেশ ভালোই বৃষ্টি হচ্ছে। আর তাই জানি না কিভাবে এগুলো শুকাবো। আর শুকালেও এগুলো ব্যবহার করা যাবে কিনা তাও জানি না। বর্তমান সময়ে এগুলো তো ব্যবহারও করা যাবে না। আবার কেনাও সম্ভব না নতুন করে। আপাতত তাই বাইরে বের করে রেখেছি। আশা করছি সব কিছু দ্রুত স্বাভাবিক হবে। কারণ বন্যার রেশ ধরে চুপচাপ বসে থাকলে তো আর জীবন চলবে না।’


ট্রাঙ্ক রোডের পাশেই নবী হোটেলের সামনে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানের ভেতর থেকে মোটর দিয়ে পানি বের করা হচ্ছে।

হোটেলের একজন কর্মী সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখানে চাকরি করেই তো খেতে হয়। এতদিন পানি থাকার কারণে বেকার বসে বসে ত্রাণের অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে। এখন পানি কমেছে আর তাই মালিকের ডাকে এসেছি। দ্রুত শুরু হলে আমরাও চাকরি শুরু করবো। বাড়িতে এখনো পানি কমে নাই। কিন্তু সেটার জন্য তো আর দিনের পর দিন বেকার বসে থাকা যাবে না।’

ফেনী জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে গতকাল পর্যন্ত ৫০ হাজার মানুষকে উদ্ধার করে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ৪০ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। ৪০ লাখ টাকা এবং ২ হাজার টন চাল ত্রাণকাজের জন্য বরাদ্দ এসেছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে খিচুড়ি ও শুকনা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার বলেন, ‘সেনাবাহিনী, কোস্টগার্ড, র‌্যাব, ফায়ার সার্ভিস এবং ছাত্র-জনতার সমন্বয়ে উদ্ধার কাজ চলমান। নৌকা ছাড়াও হেলিকপ্টারের মাধ্যমেও শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।’

সারাবাংলা/এসবি/এমও

ফেনী ফেনী শহর বন্যা বন্যার পানি

বিজ্ঞাপন

আদানি গ্রুপের নতুন সংকট
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১৫:৩৬

নতুন ইসির শপথ রোববার দুপুরে
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১৪:২৩

আরো

সম্পর্কিত খবর