Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘চট্টগ্রাম থেকে বের হয়ে ৪ দিন লাগছে ফেনী পার হতে’

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
২৭ আগস্ট ২০২৪ ০৯:৩৯

ফেনী থেকে: ‘চারদিন ধরে এই রাস্তাতেই আছি। মানুষে কিছু খাওয়া দিলে সেটা খাই আর সেটা না হলে পানি খেয়ে খিদে দূর করি। অনেকে ত্রাণ নিয়ে বিভিন্ন দিকে যাচ্ছে। তারা মাঝেমধ্যে এসে শুকনো খাবার বা খিচুড়ি দিচ্ছে। এভাবেই মোটামুটি চারদিন কাটলো। চট্টগ্রাম থেকে বের হয়ে আজকে চারদিন পরে ফেনী পার হচ্ছি।’

৪১ বছর বয়সী কাভার্ড ভ্যানচালক হাসিব মিঞা হাসিব আলম ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পরিস্থিতি নিয়ে সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে কথাগুলো বলছিলেন।

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) দুপুরের দিকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা উদ্দেশে রওয়ানা দেই। কিন্তু সেদিন বিকেলে বারইয়ার হাট পার হওয়ার পর থেকেই মোটামুটি আটকে গেলাম। একদিন ছিলাম লেমুয়া ব্রিজের আগে। এরপরে ছিলাম লাল পোলের আগে। একদিন কাটালাম মহীপালের আগে। এরপর থেকে আজকে (রোববার, ২৫ আগস্ট) পর্যন্ত চেষ্টা করে মহীপাল আসতে পেরেছি। এখনও ঢাকা কখন যেতে পারি সেটা জানি না।’

তিনি আরও বলেন, ‘গাড়িতে ফেব্রিকস নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা দেই। মাঝরাতে শুনি আবার গাড়ি ডাকাতি হচ্ছে। এরপরে আমরা কয়েকটা কাভার্ড ভ্যানের ড্রাইভার মিলে এই কয়েকদিনে আবার পালা করে পাহাড়া দেওয়া শুরু করলাম গাড়ি। পানি কমার পরে এক হাত দুই হাত করে গাড়ি এগুতে এগুতে এখন মহীপাল পার হলাম। তবে মোহাম্মদ আলী বাজার আসার পরে মনে হচ্ছে আমরা তাও কিছুটা এগুতে পেরেছি। যারা ঢাকা থেকে শিপমেন্টের গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে তারা তো দেখি উল্টোদিকে বসেই আছে।’

সরেজমিনে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিয়াবাজার, চৌদ্দগ্রাম, পদুয়া, মহীপাল, লালপোল এলাকা ঘুরে সড়কের দুই প্রান্তেই হাজার হাজার গাড়ি আটকে থাকতে দেখা গেছে। এর মাঝে আছে যাত্রীবাহী এসি ও নন এসি নানা পরিবহনও। দীর্ঘ সময় জ্যামে আটকে থেকে অনেক ট্রাকে থাকা সবজি ও ফলমূল পঁচে যাওয়ার তথ্য জানালেন চালকেরা।

বিজ্ঞাপন

রোববার (২৫ আগস্ট) সরেজমিনে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের লেমুয়া ব্রিজসংলগ্ন এলাকায় দেখা যায় বিশাল বিশাল গর্ত ভরাট করে গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। একইরকমভাবে লালপোলের দিকেও কাজ করছিলেন তারা।


স্থানীয়রা জানান, বন্যার পানি প্রবাহিত হওয়ার কারণে ফেনীর লালপোল ও লেমুয়া ব্রিজ এলাকায় ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রামে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় উভয় দিকে কয়েক হাজার যানবাহন আটকে পড়ে। ২৪ আগস্ট বিকেলের দিকে লালপোল ও লেমুয়া ব্রিজ এলাকার মহাসড়ক থেকে পানি নেমে গেলেও চট্টগ্রাম লেনের স্থানটি দেবে যায়। পরে সন্ধ্যা থেকে উল্টো লেন দিয়ে হাইওয়ে পুলিশের সহযোগিতায় ধীরগতিতে যানবাহন চলাচল শুরু করে। মহাসড়কের যান চলাচলের খবর পেয়ে ঢাকা এবং চট্টগ্রাম থেকে দূরপাল্লার যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী গাড়ি চলাচল শুরু হওয়ায় মহাসড়কে গাড়ির চাপ আরও তীব্র আকার ধারণ করে।

আটকে থাকা পরিবহন চালকরা জানান, বন্যার পানি রাস্তায় চলে আসার পরে এখানে তীব্র স্রোত ছিল। স্রোতের তীব্রতায় রাস্তায় ক্ষত হয়ে গেছে। আর এখানে গাড়ির চাকা পড়লে সেটা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেজন্য এইসব জায়গায় কাজ করার পরেই গাড়ি চলাচল শুরু করা হয়েছে।

ফেনীর মোহাম্মদ আলী বাজার এলাকায় সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় গ্যাসবাহী একটি গাড়ির চালক রমজান আলীর সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘২২ আগস্ট অর্থাৎ বৃহস্পতিবার চৌদ্দগ্রাম এসে পৌঁছাই। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত চারদিনে মোহাম্মদ আলী বাজার এসে পৌছাতে পেরেছি। চট্টগ্রাম যেতে কয়দিন লাগবে এখনো তা বলতে পারছি না।’

তিনি আরও বলেন, ‘সামনে এক জায়গা থেকে হেলপারকে পাঠিয়ে খাওয়া কিনে আনিয়েছি। যা আনছে তা প্রায় দ্বিগুণ দামে কিনে আনতে হয়েছে। এর মাঝে রাত হলেই শুনি আবার ডাকাতির আতঙ্ক। সেটা কাটাতে রাত জেগে পাহাড়া দেই অন্যান্য ড্রাইভারদের নিয়ে। অনেক দিন ধরে গাড়ি চালাই এই রোডে কিন্তু এমন পরিস্থিতি আমি কখনো দেখি নাই। এমনটা হতেও পারে তাও তো ভাবি নাই।’

ফেনী লালপোল বাজারের আগে রামপুর এলাকায় ট্রাকচালক সগীর আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আজকে (রোববার, ২৫ আগস্ট) সকাল আটটায় গাড়ি স্টার্ট দিয়ে প্রায় সাত ঘণ্টা শেষে তিন কিলো মিটার রাস্তা পার হয়েছি। জানি না ঢাকা যেতে কয়দিন লাগে। গাড়িতে ফলের কার্টন আছে। সেগুলো আদৌ ঠিক আছে কিনা তাও জানি না। মালিকরে ফোন দিয়ে জানিয়েছি। এখন দেখা যাক কি আছে কপালে।’

স্বস্তিতে ছিল না বিভিন্ন বাসে ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা দেওয়া যাত্রীরাও। এর মাঝেই তীব্র বিপদে পড়ে গাড়িতে অপেক্ষা করা বৃদ্ধ, নারী ও শিশুরা। একদিকে খাওয়ার সঙ্কট আর অন্যদিকে টয়লেটে যাওয়ারও কোনো ভালো জায়গা ছিল না।

হাসেম আলী নামে হানিফ পরিবহনের একজন চালক জানান, পানি ওঠার খবর তো আর কেউ আগে জানতো না। রাস্তায় এসে এই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। এরপরে বিকল্প ব্যবস্থা করে কেউ পানি মাড়িয়ে উল্টো চট্টগ্রামের দিকে চলে যায়। আবার যাদের বেশি লাগেজ আছে তারা বক্স থেকে সেগুলো গাড়ির উপরে উঠিয়ে অপেক্ষা করে। তবে আজকে গাড়ি স্টার্ট করে আশা করছি ঢাকা পৌঁছে যেতে পারবো।’


তিনি বলেন, ‘বিগত কিছু দিন যাত্রীদের যে দুর্ভোগ দেখেছি তাতে আসলে আমাদের কষ্ট নিয়ে আলাদাভাবে কিছু বলার নাই। অনেকে ত্রাণ নিয়ে যাওয়া আসার পথে আমাদের জন্য খাওয়ার জিনিস দিয়ে গেছে। আবার অনেকে কিছু যাত্রীকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতেও সাহায্য করেছে। সারাজীবন এই কয়েকটা দিনের কথা মনে থাকবে।’

সোমবার (২৬ আগস্ট) মহাসড়কে গাড়ি চলাচল করলেও এখন পর্যন্ত আসলে তা স্বাভাবিক হয়নি।

মহাসড়কের এক প্রান্ত দিয়ে গাড়ি চলাচল করলেও তা খুবই ধীরগতিতে চলছে। ত্রাণের গাড়ি চলাচলের সুবিধার্থে আলাদাভাবে যেতে দেওয়া হলেও অতিরিক্ত গাড়ির চাপে সেগুলোও চলছে ধীরগতিতে।

হাইওয়ে পুলিশের কুমিল্লা রিজিওনের অতিরিক্ত ডিআইজি খাইরুল আলম বলেন, ‘যান চলাচল স্বাভাবিক করতে দেবে যাওয়া স্থান এবং গর্তগুলো মেরামতের কার্যক্রম চলছে। এছাড়া সড়কে নতুন করে যাত্রী ও পণ্যবাহী গাড়ির চাপ বেড়ে যাওয়ায় এই যানজট সৃষ্টি হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘মহাসড়কের ফেনী লালপোল ও লেমুয়া ব্রিজ এলাকায় দিয়ে বন্যার পানি প্রবাহিত হওয়ায় গত বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে করে সড়কের উভয়পাশে কয়েক হাজার গাড়ি আটকা পড়ে। সড়কে পানি প্রবাহিত হওয়ার কারণে অনেক জায়গা দেবে গেছে এবং কুমিল্লার অংশে অনেক জায়গায় বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। রোববার বিকেল থেকে সড়কের ফেনী অংশ থেকে পানি নেমে যাওয়ায় পুলিশের সহায়তায় যান চলাচল শুরু করা হয়।’

খুব দ্রুতই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন এই কর্মকর্তা।

সারাবাংলা/এসবি/এমও

চট্টগ্রাম ফেনী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর