৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকা ব্যয়েও শেষ হয়নি ডাকঘরের নির্মাণ কাজ
২৮ আগস্ট ২০২৪ ১০:০৮
চুয়াডাঙ্গা: জরাজীর্ণ ভবনে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে চুয়াডাঙ্গা প্রধান ডাকঘরের কার্যক্রম। পুরাতন ভবনে ফাটল ধরেছে, আর ছাদের পোলস্তরা খসেখসে পড়ছে। ডাকঘরের স্টাফ ও সাধারণ গ্রাহকরা যেকোনো সময় দুর্ঘটনার শিকার হতে পারেন। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের গাফলতির কারণে দীর্ঘ দিনেও শেষ হয়নি নির্মাণ কাজ।
স্থানীয় ঠিকাদার ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি খুস্তার জামিল ক্ষমতার অপব্যবহার করে কাজটি নির্দিষ্ট সময়ে শেষ না করেননি। বারবার কাজের মেয়াদ শেষ হলেও কৌশলে মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়েও নির্ধারিত বর্ধিত সময়ের চেয়ে দুই মাস বেশি অতিবাহিত হলেও এখনও শেষ হয়নি কাজ। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর নানা অপকর্মের হোতা খুস্তার জামিল গাঁ ঢাকা দিয়েছেন।
চুয়াডাঙ্গা প্রধান ডাকঘর কর্তৃপক্ষ সূত্রমতে, চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার বড়বাজার পাড়ায় দেশের প্রথম প্রধান ডাকঘরটি প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রিটিশ আমলের ১৮৬০ সালে। ভারতের কোলকাতার জিপিও জেনারেল পোস্ট অফিস) পরে প্রথম চুয়াডাঙ্গায় ডাকঘর নির্মিত হয়। পাতলা ইট আর চুন-সুরকির গাঁথুনিতে ভবনটি তৈরি হয় ১৬৩ বছর আগে। ১৯৮৪ সালে ৬ বিঘা জমির উপর পূর্ণাঙ্গরূপে চুয়াডাঙ্গা প্রধান ডাকঘরের কার্যক্রম চালু হয় ২৪ জন স্টাফ নিয়ে। সরকারি ও বেসরকারি অফিসের চিঠিপত্রসহ অন্য কাজ আগের মতোই চলমান রয়েছে। প্রাধান ডাকঘরে চালু রয়েছে সঞ্চয়পত্র, সঞ্চয় ব্যাংক, চিঠি, পার্সেল, অফিসিয়াল চিঠি, মানি অর্ডার, দেশ-বিদেশ থেকে চিঠি আসা-যাওয়ার কাজ।
ব্রিটিশ আমলে নির্মিত দেশের সর্ব প্রথম ডাকঘর ভবনটি ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষণ না করে সেটা ভেঙে নতুন করে নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। ঝালকাঠি জেলার নলছটি উপজেলার মাহফুজ খান লিমিটেড নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টেন্ডারে অংশগ্রহণ করে চুয়াডাঙ্গার প্রধান ডাকঘর নির্মাণ কাজটি পায়। ডাকঘর নির্মাণের ব্যয় ধরা হয় ৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। ওই প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ কাজ করার কথা থাকলেও চুয়াডাঙ্গার স্থানীয় ঠিকাদার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি খুস্তার জামিল কাজটি নিয়ে নেন।
২০২০ সালের জুলাই মাসে চুয়াডাঙ্গা ডাকঘরের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। নির্ধারিত সময়ের দুই মাস পর কাজটি শুরু করেন ঠিকাদার খুস্তার জামিল। ২০২১ সালের জুন মাসে নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সেটা সম্ভব হয়নি। কয়েকবার কাজের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হলেও তাতেও সম্ভব হয়নি কাজ শেষ করার। সর্বশেষ ২০২৪ সালের জুনে নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। নির্মাণ কাজ চলমান থাকা অবস্থায় ঠিকাদার খুস্তার জামিল সাবেক সংসদ সদস্য সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুনের দেওয়া ডিও লেটার ব্যবহার করে ব্যয় বাড়িয়ে নেন।
এর আগে, ব্যয় বৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ নির্মাণ কাজের ব্যয় বৃদ্ধি করে ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। প্রকল্পের মোট নির্মাণ ব্যয় দাঁড়ায় ৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। এ বরাদ্দের পরও নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। দ্বিতল বিশিষ্ট ভবন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে অনেক বেশি, যা রহস্যজনক।
এ প্রকল্পের সঙ্গে অন্য জেলার ডাকঘরগুলোর নির্মাণ কাজ শেষ হলেও, চুয়াডাঙ্গার ডাকঘর নির্মাণ কাজ কোনভাবেই শেষ হচ্ছে না। নতুন ভবন নির্মাণ না হওয়ায় নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে ডাকবিভাগে কর্মরতদের। তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েই প্রতিদিন কাজ করতে হচ্ছে পরিত্যক্ত জরাজীর্ণ ভবনে। সাধারণ গ্রাহকরাও ঝুঁকির মধ্য রয়েছেন। ডাকঘরের মধ্যে দাঁড়ানোর মতই অবস্থা নেই। বসার জায়গা তো দূরের কথা। নেই প্রয়োজনীয় কোন সুযোগ-সুবিধা।
এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ নথিগুলো সংরক্ষণে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে। ভোগান্তি বাড়ছে সাধারণ সেবাপ্রত্যাশীদের। সেবা দেওয়ার মত পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় গ্রাহক হ্রাস পাচ্ছে। এ প্রতিষ্ঠান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে সাধারণ মানুষ।
চুয়াডাঙ্গা ডাকঘরে আসা গ্রাহক জেসমিন খাতুন ও মসলেম উদ্দিন জানান, বিল্ডিং অনেক পুরাতন। ভেতরে প্রবেশ করলেই ভয় লাগে, কখন ভেঙে পড়ে মাথার উপর। বসা ও দাঁড়ানোর মতো কোন জায়গা নেই। ভেতরের পরিবেশ অনেক নোংরা। সম্পূর্ণ পোস্ট অফিস চত্বর জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। এখানে প্রয়োজনীয় কাজে আসি, কিন্তু পরিবেশ দেখে ভালো লাগে না।
ঝালকাঠি জেলার নলছটি উপজেলার মাহফুজ খান লিমিটেড নামের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মালিক মাহফুজ খান এ বিষয়ে কোনো কথা বলেননি। পলাতক স্থানীয় ঠিকাদার খুস্তার জামিলের মোবাইল ফোন নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
চুয়াডাঙ্গা প্রধান ডাকঘরের পোস্ট মাস্টার রিয়াজুল ইসলাম বলেন, ‘অন্য জেলায় পোস্ট অফিস নির্মাণ কাজ শেষ হলেও এখানে এখনও শেষ হয়নি। ১৯৭০ সালে নির্মিত ভবনটিতে কার্যক্রম চলছে। ভবনের ছাদ যে কোন সময় ধসে পড়তে পারে। নতুন ভবন নির্মাণ কাজ খুবই ধীরগতিতে চলছে। দ্রুত সময়ে নতুন ভবনে যাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রীয় বা অফিসের রেকর্ডপত্র রয়েছে তা যদি কোন কারণে তছরূপ হয়, প্রকৃতিক দুর্যোগে নষ্ট হয়, ভিজে যায় তা হলে সমূহ বিপদের সম্মুখীন হতে হবে। এ থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষতি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।’
সারাবাংলা/এমও