Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘আত্মহত্যা’র আগে বাসা ভাড়ার টাকা পাঠান সাংবাদিক সারা

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
২৮ আগস্ট ২০২৪ ২২:৩৫

ঢাকা: ‘জীবন্মৃত হয়ে থাকার চাইতে মরে যাওয়াই ভালো’। মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট) রাত ১১টার দিকে রেহনুমা সারা (৩২) ফেসবুকে এমনই একটা পোস্ট দেন। তার এক ঘণ্টা আগে বন্ধু ফাহিম ফয়সালকে নিয়ে আরেকটি পোস্ট করেন তিনি। সেখানে তিনটি ছবির সঙ্গে লিখেছেন– ‘তোমার মতো বন্ধু পেয়ে ভালো লাগলো। ঈশ্বর তোমাকে সর্বদা মঙ্গল করুন। আশা করি, শিগগিরই তোমার সব স্বপ্ন পূরণ হবে। আমি জানি আমরা একসঙ্গে অনেক পরিকল্পনা করেছি। দুঃখিত, আমাদের পরিকল্পনা পূরণ করতে পারছি না। ঈশ্বর তোমার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আশীর্বাদ করুন’। আর তিন দিন আগে নিজের ফেসবুকে প্রোফাইলের ছবিও পরিবর্তন করে সেখানে ‘টাইম টু স্যে গুডবাই‘– লেখা কার্ড দেন।

মঙ্গলবার রাত পৌনে ২টার দিকে রাজধানীর হাতিরঝিল লেক থেকে রেহনুমা সারাকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে কয়েকজন পথচারী। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। সারা জিটিভির নিউজরুম এডিটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০২১ সালের শেষের দিকে জিটিভিতে যোগ দেন তিনি। এর আগে, এনটিভি অনলাইনে নিউজরুম এডিটর ছিলেন। তার বাড়ি নোয়াখালী সদরের মাইজদীতে। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সারা ছিলেন দ্বিতীয়। তার বাবা বখতিয়ার শিকদার মাইজদী প্রেসক্লাবের বর্তমান সভাপতি।

সারার স্বামী দাবি করা সায়েদ শুভ্র নামে এক ব্যক্তি সাংবাদিকদের বলেন, “ঢাকার কল্যাণপুরের একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন তারা। প্রেমের সম্পর্কের সূত্র ধরে সাত বছর আগে তারা পরিবারকে না জানিয়ে বিয়ে করেন। মঙ্গলবার সারাহ অফিসে গিয়ে রাতে আর বাসায় ফেরেননি। এক ব্যক্তিকে দিয়ে রাত সাড়ে ১০টার দিকে বাসা ভাড়ার টাকা পাঠিয়ে দেন। পরে তাকে ফোন করলে ‘ব্যস্ত আছি’ বলে ফোনের লাইন বিছিন্ন করে দেয়। রাত ৩টার দিকে খবর পাই, সে হাতিরঝিল লেকের পানিতে ঝাঁপ দিয়েছে।”

শুভ্র বলেন, ‘আমাদের মধ্যে মনমালিণ্য হয়নি, কিছুদিন আগ থেকে সারা আলাদা হতে চাচ্ছিলেন। পরে আমরা দু’জনই কাজী অফিসে গিয়ে বিবাহ বিচ্ছেদ করব বলে সিদ্ধান্ত হয়। দেশের এই পরিস্থিতিতে আর কাজী অফিসেও যাওয়া হয়নি।’

বুধবার (২৮ আগস্ট) ডিএমপির হাতিরঝিল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘হাতিরঝিল লেকের পানিতে একজনের নিথর দেহ ভাসতে দেখে পথচারীরা উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তবে এটা আত্মহত্যা না কি হত্যা, তা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। মৃত্যুর সঠিক কারণ জানতে ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেলেই সঠিক কারণ জানা যাবে।’

তিনি বলেন, ‘এ ঘটনায় সারার বাবা বখতিয়ার শিকদার হাতিরঝিল থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করেছেন। বিষয়টি গুরুত্বসহকারে তদন্ত করা হচ্ছে।’ স্বামীর বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘পরিবারে সদস্যরা অবিবাহিত বলে দাবি করেছেন। এ ছাড়া স্ত্রীর পরিচয়ে কেউ থানায় এসে অভিযোগও দেয়নি। তবে আমরা তদন্তের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আসব।’

হাতিরঝিল থানা পুলিশ সারার মৃতদেহের সুরতহাল প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, ‘মৃত্যুর সুনিদিষ্ট কোনো কারণ জানা যায়নি। তার শরীরে কোনো আঘাত বা জখমের চিহ্ন নেই। এমনকি যৌন নিপীড়নের কোনো আলামতও পাওয়া যায়নি।’

সারার বড় বোনের স্বামী ব্যাংক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আসিফুল বারী বলেন, ‘আমি পরিবার নিয়ে শ্যামলীতে থাকি। আর সারা কল্যাণপুরে থাকতো। সেখানে বাসা ভাড়া নিয়ে একাই থাকত বলে জানতাম। তবে তার বাসায় কখনো আমরা যাইনি। সে আমাদের বাসায় যাওয়া-আসা করত। তবে আজ শুনছি– সারা বিবাহিত ছিল। কিন্তু এ বিষয়ে কিছুই বলতে পারছি না। পুলিশের তদন্তে প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে বলে মনে করছি।’

তিনি বলেন, ‘বিকেল ৩টার দিকে ময়নাতদন্ত শেষে পুলিশ পরিবারের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করে। এরপর মোহাম্মদপুরে জানাজা শেষে তাকে ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। সেখানে তার মায়ের কবরও রয়েছে।’

সাংবাদিক সারার মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়তেই তার বন্ধু ও সহকর্মীরা তাকে নিয়ে ফেসবুকে বিভিন্ন পোস্ট দিচ্ছেন। সেখানে বন্ধু ও পরিচিতজনরা সারা ডিপ্রেশনে (মানসিক অবসাদ) ভুগছিলেন বলে দাবি করেন। মৃত্যুর আগে সারা যেই বন্ধু ফাহিমকে নিয়ে পোস্ট করে। তিনি মৃত্যুর সংবাদ পাওয়ার পর তার ফেসবুকে লেখেন— ‘আমার বন্ধুটা আর নেই, কাল রাতে শেষ কথা আমার সাথেই হয়েছিল। যদি বুঝতে পারতাম এটাই আমাদের শেষ কথা তাহলে কখনই যেতে দিতাম না!’

এ ছাড়া সারার বন্ধু সৈয়দ নাজমুস সাকিব তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘সারা অনেকদিন থেকে ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন, চিকিৎসাও নিয়েছিলেন। সবাই তাকে আশ্বস্ত করেছিল যে, তিনি ঠিক হয়ে যাবেন।’

সারার মৃত্যুতে শোকে স্তব্ধ বন্ধু ডা. মেজবাহ উল আজিজ লিখেছেন, ‘যে ডিপ্রেশনের জন্য আমরা লড়াই করতে চেয়েছিলাম, সেই ডিপ্রেশনের কাছেই আজ আমরা আবার হেরে গেলাম। সুইসাইড প্রজেক্টে কাজ করতে চাওয়া, ডিপ্রেশনের রাস্তা থেকে ফিরিয়ে আনতে চাওয়ার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে হাতিরঝিলের পানিতে নিথর ভেসে আছে আমাদের অপরাজিতা হসন্ত।’

জিটিভির হেড অব নিউজ ইকবাল করিম নিশান বলেন, ‘মঙ্গলবার সারা অফিসে এসে কোনো কাজ করেননি। বিকেলের দিকে অফিসে এসে বেতন তুলে কিছু সময় থেকে চলে যায়। রাতে তার মৃত্যুর খবর পেয়ে সহকর্মীরা হাসপাতালে ছুটে যাই। একজন মেধাবী সাংবাদিকের এমন মৃত্যুতে জিটিভি পরিবারের পক্ষ থেকে গভীর শোক প্রকাশ করছি।’

সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম

আত্মহত্যা টপ নিউজ টাকা বাসা ভাড়া রেহনুমা সারা সাংবাদিক


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর