ছাত্রসহ সব পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেছে অগ্রবর্তী দল: জাতিসংঘ
৩১ আগস্ট ২০২৪ ০৮:৩২
কোটা সংস্কার থেকে সরকার পতনের দাবিতে রূপ নেওয়া ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে অন্যায্যভাবে বলপ্রয়োগ, সহিংসতা, প্রাণহানি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্ত করবে জাতিসংঘ। এরই মধ্যে সংস্থাটির মানবাধিকার কার্যালয় থেকে পাঠানো একটি অগ্রবর্তী দল বাংলাদেশ সফর করেছে। সপ্তাহব্যাপী এই সফরে তারা আন্দোলনে যুক্ত শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পক্ষের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছে।
শুক্রবার (৩০ আগস্ট) এক বিবৃতিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের কার্যালয় এ তথ্য জানিয়েছে। হাইকমিশনারে মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানি বিবৃতিতে জানিয়েছেন, ২২ থেকে ২৯ আগস্ট পর্যন্ত এই দলটি বাংলাদেশ সফর করেছে। এরপর একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিম আসবে বাংলাদেশে। তারা এসব ঘটনা তদন্তের পর স্থায়ী সংস্কারের জন্য সুপারিশও করবে।
সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে গত ১ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। ১৬ জুলাই সেই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষে ঢাকা, রংপুর ও চট্টগ্রামে ছয়জন নিহত হন। আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষ-সহিংসতা বাড়তে থাকলে একপর্যায়ে সে আন্দোলন সরকার পতনের দাবিতে রূপ নেয়।
আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও এর আগে মাত্র তিন সপ্তাহ সময়ে শিশুসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার সহস্রাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে এই আন্দোলন ঘিরে। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। এই আন্দোলন দমন করতে অন্যায্যভাবে বলপ্রয়োগের অভিযোগ ওঠে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে, অভিযোগ ওঠে মানবাধিকার লঙ্ঘনেরও।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই আন্দোলন চলাকালে সহিংসতার ঘটনায় জাতিসংঘের নেতৃত্বে তদন্তের দাবি উঠেছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে যোগাযোগের ভিত্তিতেই জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল অগ্রবর্তী দল।
জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানি বিবৃতিতে বলেছেন, তদন্তের কাজে বাংলাদেশে পাঠানো অগ্রবর্তী দলটি গত সপ্তাহে ছাত্রনেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এসব ছাত্রনেতাদের অনেকেই আন্দোলন চলাকালে আটক বা আহত হয়েছিলেন।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের বেশির ভাগ উপদেষ্টা, প্রধান বিচারপতি, পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মর্তাদের সঙ্গেও এই দলটি আলোচনা করেছে। পাশাপাশি আইনজীবী, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি এবং সংখ্যালঘু ও আদিবাদী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও তাদের বৈঠক হয়েছে।
রাভিনা শামদাসানি বলেন, বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে বৈঠকে সাম্প্রতিক আন্দোলন ও সহিংস পরিস্থিতিতে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অন্যায় আচরণের বিষয়ে কোন কোন পদ্ধতি অলম্বন করে তদন্ত এগিয়ে নিয়ে নেওয়া যায়, সে বিষয়ে অগ্রবর্তী দল বিস্তারিত আলোচনা করেছে।
বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জাতিসংঘের কাছে এই তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করতে অনুরোধ করেছে। ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত দেড় মাস সময়ে ঘটে যাওয়া সহিংসতা-বলপ্রয়োগের ঘটনা এই তদন্তের আওতায় রাখা হয়েছে। তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবে একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিম।
১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত দেড় মাসে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেসব অভিযোগ উঠেছে, সেগুলোর নিরপেক্ষ তদন্ত করতে বাংলাদেশে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন পাঠানোর জন্য অনুরোধ জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার টুর্ককে চিঠি পাঠিয়েছিলেন বলে জানানো হয়ে বিবৃতিতে।
রাভিনা বলেন, ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতেই আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিম বাংলাদেশে পাঠানো হবে। এই টিম আন্দোলন চলাকালে সংঘটিত প্রাণহানিসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করবে। কেন এসব ঘটনা ঘটেছে, সেই কারণগুলো বিশ্লেষণ করবে।
প্রতিবেদনে এসব ঘটনার দ্রুত বিচার ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের জন্য সুপারিশ করবে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিম। রাভিনা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনীগুলো জাতিসংঘের তদন্তকাজে পূর্ণ সহযোগিতার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে অগ্রবর্তী দলের কাছে।
বিবৃতিতে গুমের অভিযোগের বিষয়টিও উঠে এসেছে। আওয়ামী লীগের সবশেষ ১৬ বছরের শাসনামলে বিপুল পরিমাণ ব্যক্তি গুমের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এই সময়ে ঘটে যাওয়া গুমের ঘটনাগুলো তদন্তে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করে গত মঙ্গলবারই প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
একই সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের সাপ্তাহিক সভায় ‘আন্তর্জাতিক কনভেনশন ফর দ্য প্রটেকশন অব অল পার্সনস ফ্রম ফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স’ শিরোনামের আন্তর্জাতিক সনদে সই করেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। গুমবিরোধী এই সনদে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়া ও গুমের ঘটনা তদন্তে কমিশন গঠনের ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার।
রাভিনা শামদাসানি বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশে দীর্ঘ দিন ধরে গুমের ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব ঘটনা তদন্তে বাংলাদেশের সরকার যে তদন্ত কমিশন গঠন করেছে, আমরা তাদের সহায়তা করতে প্রস্তুত। কমিশনের গুমের শিকার ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করতে হবে। গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানে প্রচলিত বিধানের পাশাপাশি ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুসরণ করা উচিত।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পাশে থাকার প্রত্যয় জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গণতন্ত্র পুনর্প্রতিষ্ঠা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার সমুন্নত করার এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় সবসময় অন্তর্বর্তী সরকার ও বাংলাদেশের জনগণের পাশে থাকবে।
সারাবাংলা/টিআর
আন্দোলনে প্রাণহানি কোটা সংস্কার আন্দোলন ছাত্র আন্দোলন জাতিসংঘ জাতিসংঘের তদন্ত ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন মানবাধিকার লঙ্ঘন মানবাধিকার হাইকমিশনার রাভিনা শামদাসানি