বন্যায় অসুস্থতা এড়াতে সাবধান হওয়ার পরামর্শ
৩১ আগস্ট ২০২৪ ২১:৫৮
ঢাকা: ভয়াবহ বন্যার কবলে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের অনেক এলাকা। কিছু এলাকায় বন্যার পানি কমে এলেও এখনো অনেক জায়গায় পানিবন্দি হয়ে আছে মানুষ। এমন অবস্থায় বন্যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নানাধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেখা দিতে পারে। বন্যার্ত মানুষের পাশাপাশি তাদের উদ্ধারের জন্য বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে যাওয়া স্বেচ্ছাসেবক, উদ্ধারকর্মী, স্বাস্থ্য সেবাদানকারী ও ত্রাণ দিতে যাওয়া মানুষদের মাঝে দেখা দিতে পারে নানা রকমের স্বাস্থ্য সমস্যা। এগুলোর মধ্যে অন্যতম- ডায়রিয়া, টাইফয়েডসহ পানিবাহিত নানা ধরণের রোগ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্যা-পরবর্তী সময়ে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ অনেক বেড়ে যায়। এ ছাড়াও নানা ধরনের চর্মরোগের পাশাপাশি টাইফয়েড, হেপাটাইটিস, অ্যাজমাসহ বা শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত নানা শারীরিক অসুস্থতা দেখা দিতে পারে। এমন অবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি গর্ভবতী নারী, শিশু ও বয়োবৃদ্ধদের শারীরিক সুস্থতার জন্য সাবধানতা অবলম্বনের পরামর্শও দিয়েছেন তারা।
বন্যা পরবর্তী সময়ে কী কী রোগ হতে পারে
আইসিডিডিআর,বি’র (আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ) চিকিৎসক ডা. লুবাবা শারমিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘পানি নেমে যাওয়ার পরে বিশুদ্ধ পানির ঘাটতি দেখা দিতে পারে। কারণ, বন্যার পানিতে স্যুয়ারেজের লাইনের পাশাপাশি নানা ধরনের বর্জ্যের পানিও কিন্তু মিশে গেছে। এক্ষেত্রে বিশুদ্ধ পানি পান না করার ফলে যে অসুখগুলো হয়ে থাকে সেগুলো বাড়তে পারে। এর মাঝে অন্যতম পেটের নানা ধরনের অসুখ।
পানিবাহিত যেসব রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে
১. বন্যার সময় বিশুদ্ধ পানির অভাব এবং অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের কারণে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে। ডায়রিয়ায় সতর্ক না হলে শরীরে পানিশূন্যতা ঘটিয়ে প্রাণহানি ঘটাতে পারে।
২. দূষিত পানি ও খাদ্যের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমিত কলেরা ছড়াতে পারে। তীব্র ডায়রিয়া ও বমি হয়ে থাকে। কলেরায় দ্রুত চিকিৎসা না করলে জীবন সংকাটাপন্ন হতে পারে।
৩. দূষিত পানির মাধ্যমে জন্ডিস (হেপাটাইটিস এ) ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে। যা যকৃৎকে আক্রমণ করে। ফলে চোখ ও ত্বক হলুদ হয়ে যায় এবং শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে।
৪. দূষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে মানুষের শরীরে টাইফয়েডের জীবাণু প্রবেশ করে। টাইফয়েড জ্বরে দীর্ঘস্থায়ী জ্বর, মাথাব্যথা এবং পেটে ব্যথা হয়।
বন্যা পরবর্তী সময়ে হতে পারে নানা ধরনের চর্মরোগ
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘বন্যার পানিতে চলাফেরা করা কারণে মানুষের শরীরে নানা জাতীয় চর্মরোগ দেখা দেয়। আমরা দেখি, বন্যার পরে খোসপাঁচড়া বা চুলকানি জাতীয় অসুখ বেড়ে যায়। এ ছাড়াও ফোসকা পড়া এবং ফাংগাল ইনফেকশন হওয়ার ঝুঁকিও থাকে। এ সব ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।’
দেখা দিতে পারে শ্বাসকষ্ট ও অন্যান্য শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা
ডা. লুবাবা শারমিন বলেন, ‘দীর্ঘ সময় পানির সংস্পর্শে থাকার কারণে বা ঘরে পানি থাকার কারণে অনেকের নিউমোনিয়া, অ্যাজমা বা শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত নানা সমস্যা শুরু হতে পারে। এ ছাড়াও এ সময়ে ঠাণ্ডা আবহাওয়া থেকে সর্দি, কাশি এবং অন্যান্য শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা দেখা দিতে পারে।’
বাড়তে পারে মশাবাহিত রোগ
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বন্যার পর পানি জমে থাকা জায়গাগুলোতে মশার বংশবৃদ্ধি হয়। যা ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া ও চিকুনগুনিয়ার মতো মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটাতে পারে।’
দেখা দিতে পারে পুষ্টির অভাবজনিত নানা শারীরিক অসুস্থতা
ডা. লুবাবা শারমিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বন্যা পরিস্থিতিতে মানুষ কী পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করতে পেরেছেন বা পরিমাণ মতো খেতে পেরেছেন কিনা সেটা একটা বিষয়। এর ফলে যদি কেউ পরিমাণ মতো খাবার না খেতে পারেন তবে তার পুষ্টি ঘাটতি দেখা দিতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘এখন পানি নেমে যাওয়ার ওপর নির্ভর করছে তাদের পর্যাপ্ত খাবার গ্রহণের বিষয়টিও। এতে যদি দীর্ঘ সময় লেগে যায় তবে অপুষ্টিজনিত নানা রোগ দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে বাচ্চাদের বিষয়টি আমাদের গুরুত্ব দিয়ে মাথায় রাখতে হবে।’
হতে পারে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের চাইল্ড অ্যাডোলেসেন্ট অ্যান্ড ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বন্যায় ঘরবাড়ি হারানো, খাদ্য ও পানির সংকট এবং রোগের প্রাদুর্ভাবের কারণে মানুষের মধ্যে মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং হতাশা দেখা দিতে পারে। এই মানসিক সমস্যাগুলো অনেক সময় দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, যদি তা সময়মতো মোকাবিলা না করা হয়।’
এই সমস্যা সমাধানে নিজের এবং পরিবারের মানসিক সুস্থতার দিকে খেয়াল রাখুন। বন্যার সময় মানসিক চাপ কমাতে পরস্পরের সঙ্গে কথা বলুন এবং প্রয়োজনে পেশাদার কাউন্সিলরের পরামর্শ নেওয়ার পরামর্শ দেন ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ।
ডায়াবেটিস ও হাইপারটেনশন আক্রান্তদের দেখা দিতে পারে নানা সমস্যা
ডা. লুবাবা শারমিন বলেন, ‘বয়স্ক মানুষ যারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত তাদের কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। এর মাঝে যারা বিভিন্ন ধরনের ওষুধ খান যেমন ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশনের রোগীরা ঠিকঠাক মতো বন্যা পরিস্থিতিতে হয়তোবা সেগুলো গ্রহণ করতে পারেন নাই। কারণ, বন্যার সময় একটা জায়গায় অনেককে বদ্ধভাবে থাকতে হয় বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে। তাদের শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে, যদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো না যায়। উনাদের অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।’
বাড়তে পারে সাপের উপদ্রব
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. আবু জামিল ফয়সাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘বন্যার পানির কারণে সাপ ঘরে ঢুকতে পারে। এমনকি তারা ঘরে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয়ও নিতে পারে। এক্ষেত্রে যদি কাউকে সাপে কামড় দেয় তবে তাকে যেন অ্যান্টি ভেনম দেওয়া যায় সেটা খেয়াল রাখতে হবে।’
বন্যা পরবর্তী সময়ে করণীয়
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, ‘ডায়রিয়া হলে মানুষ যেন সঙ্গে সঙ্গে স্যালাইন খেতে পারে, সেজন্য উপদ্রুত এলাকার স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণ স্যালাইন সরবরাহ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন কাউন্সিল অফিসের মাধ্যমে প্রচুর ওরস্যালাইন সরবরাহ করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘মূল কথা হলো- মানুষ যেন সহজেই ওরস্যালাইন পায়, সেই ব্যবস্থা করা। এর পাশাপাশি আমাদের অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন হবে। কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যায়ে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে একটি গাইডলাইন তৈরি করে দিতে হবে। উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স, জেলা সদর হাসপাতালগুলোতে আইভি ফ্লুয়িড যথেষ্ট পরিমাণে থাকতে হবে। যথেষ্ট পরিমাণে কলেরা স্যালাইন সাপ্লাই দিতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বন্যা পরবর্তী সময়ে আরও কিছু রোগ, যেমন শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, নিউমোনিয়া, অ্যাজমা এসব হতে পারে। এসব রোগের বিষয়ও আমাদের প্রস্তুতি থাকতে হবে। বন্যা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ হতে পারে। এজন্য আমাদের অ্যান্টিহিস্টামিন ওষুধ ও স্কিনে দেওয়ার জন্য নানা ধরনের লোশনেরও ব্যবস্থা থাকতে হবে। অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধ এবং মলম সরবরাহ করতে হবে।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরে পানি বিশুদ্ধ করে পান করা প্রয়োজন। শুধুমাত্র তাই না, খাওয়ার আগে প্লেট বা গ্লাস ধোয়ার সময়েও বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করা জরুরি। কারণ, দেখা গেলো কেউ পানি বিশুদ্ধ করে পান করছেন কিন্তু গ্লাস-প্লেট ধুচ্ছে সাপ্লাই পানি দিয়ে সেক্ষেত্রে জীবাণু ছড়াতে পারে। আর তাই এদিকটায় নজর দেওয়া জরুরি।’
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের চাইল্ড অ্যাডোলেসেন্ট অ্যান্ড ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘মানুষকে অবশ্যই বন্যা পরবর্তী সময়ে শরীরের পাশাপাশি মনের যত্নটাও নিতে হবে। এক্ষেত্রে অবসর সময়ে মানুষ গান শুনতে পারে, বই পড়তে পারে, খেলাধুলা করতে পারে।
তিনি বলেন, ‘পাশাপাশি যদি মানুষ এ সময় সে আরেকজন ক্ষতিগ্রস্তের পাশে দাঁড়ায় তবে সেটাও মানুষকে মানসিকভাবে সুস্থ রাখবে। দেখা গেল বন্যার কারণে কেউ একজন ক্ষতিগ্রস্ত, কিন্তু তার চেয়েও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত একজন আছে, যার পাশে তিনি চাইলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে দাঁড়াতে পারছেন। এক্ষেত্রে যিনি সাহায্য করবেন তার মানসিক প্রশান্তি বাড়বে।’
কর্তৃপক্ষ যা বলছে
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘ইতোমধ্যেই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সবাই যেন পর্যাপ্ত ওরস্যালাইন পায় সে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।’
সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম